রাজশাহীতে শতবর্ষী খেলার মাঠ দখলের চেষ্টা : ক্রীড়ামোদীদের বাধায় নির্মাণকাজ স্থগিত

রাজশাহীর তানোর উপজেলায় একটি শতবর্ষী খেলার মাঠ জালিয়াতির মাধ্যমে দখল করে মাদ্রাসার ভবন নির্মাণের চেষ্টা স্থানীয় ক্রীড়ামোদী জনতা রুখে দিয়েছে। সোমবার (২৩ জুন) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত স্থানীয় খেলোয়াড় ও সাধারণ মানুষের তীব্র প্রতিরোধের মুখে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ভবনের নির্মাণকাজ স্থগিত করতে বাধ্য হয়। এ সময় অনেকে খননযন্ত্রের (ভেকু) সামনে শুয়ে পড়ে প্রতিবাদ জানান।
স্থানীয় ভূমি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ওই মাঠের নাম গোকুল মথুরা খেলার মাঠ। বাংলাদেশ সরকারের আরএস খতিয়ানে এটি তানোর উপজেলার মথুরা মৌজায় অবস্থিত (জেএল নম্বর ১৫৩, খতিয়ান নম্বর ৩৮, দাগ নম্বর ৯৩)। এর শ্রেণি 'খেলার মাঠ' এবং পরিমাণ ১ একর ৬ শতাংশ। খতিয়ানে মালিক হিসেবে 'গোকুল মথুরা ফুটবল ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক (সেক্রেটারি)' উল্লেখ থাকলেও, নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির নাম নেই।
সূত্রমতে, মাঠসংলগ্ন গোকুল মথুরা দাখিল মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ১৯৯৯ সালের ৪ আগস্ট একটি দান দলিলের মাধ্যমে ৬ শতাংশ এবং ওই বছরের ৮ আগস্ট একইভাবে ৩৪ শতাংশ জমির মালিকানা দাবি করে। এরও আগে, ১৯৮৩ সালের ৫ জুন গোকুল মথুরা প্রাথমিক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি "প্রতারণামূলক দান দলিলের" মাধ্যমে ৬৬ শতাংশ জমির মালিকানা নিয়েছিল। অভিযোগ রয়েছে, এই তিনটি দলিলের মাধ্যমে অতি গোপনে মাঠের সব জমি গ্রাস করা হয়েছে। অথচ আইন অনুযায়ী, খেলার মাঠ হস্তান্তর বা অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যায় না।
খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০ এর ৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী, খেলার মাঠ হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না বা এরূপ জায়গা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার করা যাবে না। এমনকি ভাড়া, ইজারা বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তরও করা যাবে না। এসএ খতিয়ানেও মাঠটি 'গোকুল মথুরা ফুটবল ক্লাবের সেক্রেটারি'র নামেই ছিল।
সম্প্রতি স্থানীয় গোকুল মথুরা দাখিল মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে চার তলাবিশিষ্ট ভবন নির্মাণের প্রস্তুতি নিলে বিষয়টি জানাজানি হয়। বর্তমানে ক্লাবের সভাপতি মো. রফিকুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক হারুন-অর-রশিদ জানান, ভূমি কার্যালয়ে খোঁজ নিতে গিয়েই তারা এই প্রতারণামূলক দলিলের সন্ধান পান। পুরো মাঠটি দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে খারিজও করে নেওয়া হয়েছে।
বিষয়টি জানার পর গত রোববার (২২ জুন) ক্লাবের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক হারুন-অর-রশিদ এই খারিজ বাতিলের জন্য রাজশাহী জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করেছেন। এর আগে ২ জুন ফুটবল ক্লাবের সভাপতি মো. রফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারায় একটি মামলা করেন। আদালত প্রতিপক্ষের জবাব দাখিল পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ১৮ জুন মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ আদালতে জবাব দাখিল করে। মামলার পরবর্তী শুনানির তারিখ আগামী ১০ জুলাই।
এছাড়াও, ৪ জুন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের উন্নয়ন শাখা থেকে রাজশাহী জেলা প্রশাসককে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু এর আগেই মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ভবন নির্মাণকাজ উদ্বোধনের প্রস্তুতি নেয়।
সোমবার সকালে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা ও মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মাদ্রাসার ভবনের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করতে যান। কিন্তু স্থানীয় লোকজনের তীব্র বাধার মুখে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করা যায়নি। ঠিকাদারের লোকজন মাটি খননের চেষ্টা করলে স্থানীয় খেলোয়াড়েরা খননযন্ত্রের সামনে শুয়ে পড়েন। একপর্যায়ে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ভবন নির্মাণের কাজ স্থগিত ঘোষণা করে। বিকেলের দিকে ঠিকাদারের লোকজন ও যন্ত্রপাতি নিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. হোসেন খান একটি গণমাধ্যমকে বলেন, তারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে ওই ভবনের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন। তারা উদ্বোধন ঘোষণা করে এলেও স্থানীয় লোকজনের বাধায় কাজ শুরু হয়নি বলে তিনি শুনেছেন।
এর আগেও এই মাঠ রক্ষায় এলাকাবাসী সক্রিয় ছিলেন। গত ১৪ এপ্রিল তারা একটি মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। পরের দিন তানোর থেকে রাজশাহী জেলা পরিষদ কার্যালয় অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচি এবং জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে স্মারকলিপি দেন। একই দাবিতে ২৫ মে রাজশাহীতে গোকুল মথুরা ফুটবল ক্লাবের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে 'স্বপ্নচারী যুব উন্নয়ন সংস্থা' ও 'ইয়ুথ অ্যাকশন ফর সোশ্যাল চেঞ্জ-ইয়্যাস' সংবাদ সম্মেলন করে।
রাজশাহী জেলা প্রশাসক আফিয়া আখতার জানিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে তিনি অবগত আছেন এবং এ বিষয়ে তদন্ত করে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
Comments