
নেপালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেন জি বিক্ষোভ তীব্র আকার ধারণ করেছে, যার জেরে প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষে এ পর্যন্ত ২১ জন নিহত এবং শতাধিক আহত হয়েছেন। সরকারি ভবন, পার্লামেন্ট এবং শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বিক্ষোভের সূত্রপাত
গত সপ্তাহে নেপাল সরকার ফেসবুক, ইউটিউব, এক্সসহ ২৬টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্ল্যাটফর্মে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যার কারণ হিসেবে তারা ভুয়া তথ্য, বিদ্বেষমূলক বক্তব্য এবং অনলাইন জালিয়াতি প্রতিরোধের কথা উল্লেখ করে। এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে হাজার হাজার তরুণ-তরুণী, বিশেষ করে জেন জি প্রজন্ম, রাজধানী কাঠমান্ডুতে পার্লামেন্ট ভবনের সামনে বিক্ষোভে নামেন। তবে, বিক্ষোভ শুধু সামাজিক মাধ্যমের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি দীর্ঘদিনের দুর্নীতি, সরকারের আধিপত্যবাদী মনোভাব এবং অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভের প্রকাশ। নেপালে ৪৩% জনগোষ্ঠী ১৫-৪০ বছর বয়সী, এবং দেশটির বেকারত্বের হার প্রায় ১০% এবং জিডিপি পার ক্যাপিটা মাত্র ১,৪৪৭ মার্কিন ডলার।
হিংসাত্মক সংঘর্ষ ও হতাহত
সোমবার (৮ সেপ্টেম্বর) কাঠমান্ডুতে বিক্ষোভকারীরা পার্লামেন্ট ভবনে প্রবেশের চেষ্টা করলে পুলিশ জলকামান, রাবার বুলেট এবং কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে। এক পর্যায়ে পুলিশের গুলিতে ১৯ জন নিহত হন, যার মধ্যে একজন ১২ বছরের শিশুও ছিল। মঙ্গলবার সকালে আরও দুজনের মৃত্যু হয়। শতাধিক বিক্ষোভকারী আহত হন, যাদের মধ্যে ২২ বছরের ছাত্র পবিত তান্দুকারও ছিলেন, যিনি পায়ে গুলিবিদ্ধ হন।
নেতাদের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর
মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) বিক্ষোভকারীরা কারফিউ অমান্য করে কাঠমান্ডু এবং অন্যান্য শহরে রাস্তায় নামেন। তারা প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির ভক্তপুরের বালাকোটে অবস্থিত বাড়ি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবার বাসভবন, রাষ্ট্রপতি রাম চন্দ্র পৌডেল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখক এবং কমিউনিস্ট পার্টি নেতা পুষ্প কমল দাহালের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন। এছাড়া, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরজু দেউবা রানার মালিকানাধীন একটি বেসরকারি স্কুলেও আগুন দেওয়া হয়। পার্লামেন্ট ভবন এবং সরকারি জরিপ বিভাগের ভবনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, যার ফলে ঘন ধোঁয়ায় আশপাশের এলাকা ঢেকে যায়।
প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের পদত্যাগ
হিংসার মুখে সোমবার গভীর রাতে জরুরি মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর সরকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখক সোমবার পদত্যাগ করেন, এবং মঙ্গলবার সকালে কৃষিমন্ত্রী রাম নাথ অধিকারী এবং পানি সরবরাহমন্ত্রী প্রদীপ ইয়াদভ পদত্যাগ করেন। প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি মঙ্গলবার রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন, উল্লেখ করে যে তিনি “সাংবিধানিক পথে সংকট সমাধানের জন্য” এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
বিক্ষোভকারীদের দাবি
জেন জি বিক্ষোভকারীরা শুধু সামাজিক মাধ্যমের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার নয়, পার্লামেন্ট ভেঙে নতুন নির্বাচন এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন। বিক্ষোভকারী বিষ্ণু থাপা ছেত্রী বলেন, “দেশে ব্যাপক দুর্নীতির কারণে তরুণদের জন্য এখানে থাকার কোনো ভিত্তি নেই। আমরা শান্তি এবং দুর্নীতির অবসান চাই।” আরেক বিক্ষোভকারী নারায়ণ আচার্য বলেন, “আমাদের বন্ধুদের হত্যা করা হচ্ছে। আমরা ন্যায়বিচার এবং বর্তমান সরকারের পতন চাই।”
বিশ্লেষকদের মতামত
বিশ্লেষকদের মতে, নেপালের এই বিক্ষোভ শুধু সামাজিক মাধ্যমের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে নয়, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভের প্রকাশ। বিবিসির দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সম্পাদক আনবারাসন ইথিরাজন বলেন, “নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং মন্ত্রীদের পদত্যাগের পরও ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি।” জেন জি বিক্ষোভকারীরা সরকারের জবাবদিহিতা এবং সুশাসনের দাবি জানাচ্ছেন।
বর্তমান পরিস্থিতি
কাঠমান্ডুতে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি থাকলেও বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় নামছেন। ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বন্ধ এবং অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল স্থগিত করা হয়েছে। বিক্ষোভের এক পর্যায়ে ন্যাশনাল ইন্ডিপেন্ডেন্ট পার্টির সভাপতি রবি লামিছানেকে কারাগার থেকে মুক্ত করা হয়েছে। নেপালের যোগাযোগমন্ত্রী পৃথ্বী সুব্বা বলেছেন, “পরিস্থিতি এমন ছিল যে নিরাপত্তা বাহিনীকে বলপ্রয়োগ করতে হয়েছে।” তবে, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক দপ্তর এই বলপ্রয়োগের নিন্দা জানিয়ে স্বচ্ছ তদন্তের দাবি করেছে।
নেপালের রাজনৈতিক সংকট গভীরতর হচ্ছে, এবং বিক্ষোভকারীদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম।
Comments