
দক্ষিণ এশিয়ার দুই পরাশক্তি চীন ও ভারত দীর্ঘদিনের বিরোধ ভুলে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) সম্মেলনে অংশীদারিত্বের নতুন অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। চীনের তিয়ানজিনে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঐক্যবদ্ধ উপস্থিতি বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন সমীকরণের ইঙ্গিত দিয়েছে। এই ঘনিষ্ঠতার পেছনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিকে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
সম্মেলনে ঐক্যের বার্তা
তিয়ানজিনে এসসিও সম্মেলনের প্রথম দিনে মোদি, পুতিন ও জিনপিংকে একান্ত আলোচনায় মেতে উঠতে দেখা গেছে। তাদের হাস্যোজ্জ্বল ছবি এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ মুহূর্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। মোদি ফেসবুকে লিখেছেন, “প্রেসিডেন্ট পুতিন ও প্রেসিডেন্ট শির সঙ্গে তিয়ানজিনে কথোপকথন সবসময়ই অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ। এসসিও সম্মেলন বহুত্ববাদী ও ঐক্যবদ্ধ বিশ্ব গড়তে পথপ্রদর্শক হবে।”
চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সম্মেলনে বলেন, “এসসিও সদস্য দেশগুলোর বিশাল বাজার ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার সুবিধা গ্রহণ করতে হবে। জ্বালানি, অবকাঠামো, সবুজ শিল্প, ডিজিটাল অর্থনীতি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।” তিনি আরও জানান, চীন এসসিও সদস্য দেশগুলোর জন্য ২৮ কোটি ডলারের সহায়তা এবং ১০ বিলিয়ন ইউয়ান ঋণ প্রদান করবে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন জোর দিয়ে বলেন, “এসসিও এশিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে সহযোগিতা ও আস্থাকে শক্তিশালী করেছে। এটি এ অঞ্চলে শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের নিশ্চয়তা দেয়।”
ট্রাম্পের নীতি ও নতুন সমীকরণ
বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্প প্রশাসনের ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ এবং একচ্ছত্রবাদী পররাষ্ট্রনীতি এই ঐক্যের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ভারত-চীন সম্পর্কে দীর্ঘদিনের উত্তেজনা থাকলেও, ট্রাম্পের নীতি দুই দেশকে কাছাকাছি এনেছে। রাশিয়ার মধ্যস্থতায় এই সম্পর্ক আরও মজবুত হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, “চীন ও ভারতের এই ঐক্য বিশ্ব রাজনীতিতে একটি নতুন ভারসাম্য তৈরি করতে পারে। ট্রাম্পের একতরফা নীতি এই তিন দেশকে কৌশলগতভাবে এক করেছে। এসসিও এখন শুধু নিরাপত্তা জোট নয়, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সহযোগিতার প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে।”
অর্থনৈতিক ও কৌশলগত অংশীদারিত্ব
এসসিও সম্মেলনে ২০টির বেশি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং ১০টি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছেন। সম্মেলনের বাইরে ভারত, চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকগুলো এই জোটের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের ইঙ্গিত দেয়। শি জিনপিং বলেন, “আমাদের লক্ষ্য একটি ন্যায়সঙ্গত ও পক্ষপাতশূন্য বৈশ্বিক শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা। শীতল যুদ্ধের মানসিকতা ও ব্লক দ্বন্দ্বের বিরোধিতা করতে হবে।”
ভারতের কূটনৈতিক বিশ্লেষক রাজেশ কুমার বলেন, “এই সম্মেলন ভারতের জন্য একটি সুযোগ। চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর পাশাপাশি রাশিয়ার সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক মজবুত করা ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি ট্রাম্পের একতরফা নীতির বিরুদ্ধে একটি বার্তা।”
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত এসসিও বর্তমানে ১০টি স্থায়ী সদস্য এবং ১৬টি সংলাপ ও পর্যবেক্ষক দেশ নিয়ে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ আঞ্চলিক জোট। নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমের পাশাপাশি এটি এখন অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই সম্মেলন যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বহুমেরুকরণের একটি পদক্ষেপ।
চীন-ভারত-রাশিয়ার এই ঐক্য বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন গতিশীলতা আনতে পারে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও কৌশলগত অংশীদারিত্বের মাধ্যমে এসসিও এশিয়ার রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি করছে, যা বিশ্বব্যাপী ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্যে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে।
Comments