Image description

জুলাই সনদের বাস্তবায়ন ও আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের দাবিসহ কয়েকটি অভিন্ন দাবিতে একযোগে বিক্ষোভে নামছে জামায়াতে ইসলামীসহ সাতটি রাজনৈতিক দল। আগামী বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) থেকে এই দলগুলো প্রাথমিকভাবে তিন দিনের বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করবে। এরপর নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে জানা গেছে।

কর্মসূচি ঘোষণা ও দলগুলোর ঐক্য

জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস গত রোববার ও সোমবার পৃথক সংবাদ সম্মেলনে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করে। এরপর গতকাল সোমবার রাতে জানা যায়, নতুন করে আরও তিনটি দল—নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা)—এই যুগপৎ কর্মসূচিতে যুক্ত হচ্ছে। খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান হামিদী ও জাগপার সহসভাপতি রাশেদ প্রধান জানান, তাঁরা আজ মঙ্গলবার নিজ নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে কর্মসূচি ঘোষণা করবেন।

কর্মসূচির লক্ষ্য ও দাবি

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই কর্মসূচির মূল লক্ষ্য জুলাই সনদের বাস্তবায়ন এবং নির্বাচনে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করার জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। জামায়াতে ইসলামী ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত কর্মসূচি পালনের পরিকল্পনা নিয়েছে। দলগুলোর অভিন্ন দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে:- ১. জুলাই সনদের ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন; ২. সংসদের উভয় কক্ষে (কেউ কেউ উচ্চকক্ষে) পিআর (প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন) পদ্ধতি চালু; ৩. অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সব দল ও প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা; ৪. বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের জুলুম, গণহত্যা ও দুর্নীতির বিচার দৃশ্যমান করা; ৫. স্বৈরাচারের সহায়ক হিসেবে জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা।

কর্মসূচির সময়সূচি

চারটি দল ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায়, ১৯ সেপ্টেম্বর বিভাগীয় শহরে এবং ২৬ সেপ্টেম্বর সারা দেশে জেলা-উপজেলায় বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। কৌশলগত কারণে দলগুলোর নেতারা মুখে না বললেও এটি কার্যত যুগপৎ কর্মসূচি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এই কর্মসূচির মাধ্যমে জনগণের দাবি আদায়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, সরকার জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি প্রদানে সুস্পষ্ট উদ্যোগ না নিলে বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।

রাজনৈতিক তাৎপর্য

এই যুগপৎ কর্মসূচিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা নির্বাচনী রাজনীতি মাঠে গড়ানোর ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন। কেউ কেউ এটিকে নির্বাচনকেন্দ্রিক সমঝোতা বা বোঝাপড়ার আভাস হিসেবেও বিবেচনা করছেন। জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিরোধের মধ্যে এই চারটি ইসলামি দল প্রথমবারের মতো অভিন্ন দাবিতে একযোগে মাঠে নামছে।

ইসলামপন্থীদের ভোট এক বাক্সে আনার উদ্যোগ

আগামী নির্বাচনে ইসলামপন্থীদের ভোট এক বাক্সে আনার উদ্যোগ নিয়ে তৎপরতা চালাচ্ছেন চরমোনাইয়ের পীর সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম। এই উদ্যোগে শামিল হওয়ার কথা জানিয়েছেন জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান। এ ছাড়া আহমদ আবদুল কাদেরের খেলাফত মজলিস ও মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসও এতে যুক্ত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। আগামী বৃহস্পতিবারের কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এই ঐক্যের যাত্রা শুরু হচ্ছে।

চরমোনাইয়ের পীর বলেন, “কেবল নির্বাচন ও ক্ষমতার পালাবদলের জন্য জুলাই অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়নি। দেশকে স্থায়ীভাবে ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরতন্ত্রের কবল থেকে রক্ষা করতে মৌলিক সংস্কার ছিল এ অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য। কিন্তু সংস্কার ও বিচারকে গুরুত্ব না দিয়ে নির্বাচনকে মুখ্য করে তোলা হয়েছে, যা দেশকে অশুভ বন্দোবস্তে নিপতিত করবে।”

অন্য দলগুলোর অবস্থান

জানা গেছে, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও গণ অধিকার পরিষদ যুগপৎ কর্মসূচিতে অংশ না নিলেও জুলাই সনদ ও সংবিধান সংস্কারের প্রশ্নে তাদের অবস্থান কাছাকাছি। তবে কৌশলগত কারণে এনসিপি ও এবি পার্টি এখনই কর্মসূচিতে যাচ্ছে না। গণ অধিকার পরিষদের দুই মুখ্য নেতার মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। একজন বিএনপির সঙ্গে সমঝোতায় আগ্রহী, অন্যজন এলাকার পরিস্থিতি বিবেচনায় বিএনপির সঙ্গে যেতে আগ্রহী নন। এ ছাড়া আরেকটি দলের শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশ জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতায় আগ্রহী হলেও অন্য অংশের ভিন্নমত রয়েছে, যা দলটিতে ভাঙনের পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।

সরকারের প্রতিক্রিয়া ও আশঙ্কা

গত রোববার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত কোর কমিটির সভায় এই যুগপৎ কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় যে, এই কর্মসূচি দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ ও রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি করতে পারে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান জানান, জুলাই সনদসহ অন্যান্য বিষয়ে সমঝোতা না হলে অবরোধের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এমনকি কোনো কোনো দল এখন আন্দোলনে না থাকলেও শেষ মুহূর্তে তারা যুক্ত হতে পারে, যা একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলকে একা করে দিতে পারে।

সরকারের প্রতি অভিযোগ

জামায়াতসহ অন্যান্য দলের নেতারা মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকার বিএনপির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের পর সরকার বিএনপির চাওয়াকে প্রাধান্য দিচ্ছে বলে তাঁদের অভিযোগ। তাঁরা মনে করেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না।