Image description

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে ভোট গ্রহণ ও গণনা প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও ‘গরমিলের’ অভিযোগে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ক্যাম্পাস। ৩৩ বছর পর অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাস থাকলেও, ভোট গণনার দীর্ঘসূত্রিতা, হাতে গণনার ভুল এবং ফলাফলে অসঙ্গতির অভিযোগে সেই উৎসাহ ম্লান হয়েছে। খোদ কর্তৃপক্ষ একটি হলের ভোট গণনায় ‘তারতম্য’ স্বীকার করেছে, যার ফলে একটি পদে বিজয়ীর নাম পরিবর্তন হয়েছে।

নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও ভোট গ্রহণ

প্রায় ১২ হাজার শিক্ষার্থীর এই ক্যাম্পাসে গত বৃহস্পতিবার দিনব্যাপী ভোট গ্রহণ শেষে নির্বাচন কমিশন জানায়, ৬৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। ভোট গণনা শুরু হয় রাত ১০টায়, তবে ফল ঘোষণা করতে সময় লাগে শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত। দীর্ঘ ৪৮ ঘণ্টার এই গণনা প্রক্রিয়াকে কর্তৃপক্ষ ‘নির্ভুলের চেষ্টা’ হিসেবে দাবি করলেও, শিক্ষার্থী ও প্রার্থীদের একাংশ এটিকে ‘সুস্পষ্ট কারচুপি ও অব্যবস্থাপনার বহিঃপ্রকাশ’ বলে অভিযোগ করেছেন।

ভোট গণনায় গরমিলের অভিযোগ

ভোট গণনায় গরমিলের অভিযোগ উঠেছে শহীদ রফিক-জব্বার হল, জাহানারা ইমাম হল এবং মওলানা ভাসানী হলে। এর মধ্যে শহীদ রফিক-জব্বার হলের ডাইনিং ও ক্যান্টিন সম্পাদক পদে ভোটের হিসাবে উল্লেখযোগ্য ত্রুটি ধরা পড়েছে। ঘোষিত ফলে এই পদে চার প্রার্থী মিলে ৫১৩ ভোট পেয়েছেন, অথচ হলে মোট ভোট পড়েছে ৪৬৯টি, অর্থাৎ ৪৪ ভোটের গরমিল হয়েছে।

এই পদে আশরাফুল ইসলামকে ১৩২ ভোটে বিজয়ী ঘোষণা করা হলেও, হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার জয় স্বীকার করেন, বাংলা সংখ্যা ‘৪’-কে ইংরেজি ‘৮’ ভেবে গণনায় ভুল হয়েছে। ফলে আশরাফুলের প্রকৃত ভোট ৯২, এবং তিনি আর বিজয়ী থাকেন না। এই ভুল সংশোধনের পরও মোট ভোট ৪৭৩ দেখানো হয়, যা গৃহীত ভোটের চেয়ে ৪টি বেশি। নতুন বিজয়ীর নাম এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়নি।

জাহানারা ইমাম হলে মোট ভোট পড়েছে ২৪২টি, কিন্তু ফলে দেখানো হয়েছে ২৪৭টি, যা ৫ ভোট বেশি। এই হলের এজিএস পদে লামিয়া জান্নাত ও সাদিয়া জান্নাত দুজনেই ১১৩ ভোট পেয়ে যুগ্ম বিজয়ী ঘোষিত হন। তবে লামিয়া অভিযোগ করেন, তার একটি ভোট ‘টিক চিহ্ন বক্সের বাইরে’ থাকায় বাতিল করা হয়েছে, যদিও অন্য হলে এমন ভোট বাতিল হয়নি। হলের রিটার্নিং অফিসার নাসরিন খাতুন জানান, নির্দিষ্ট স্থানের বাইরে টিক থাকলে ভোট বাতিলের নির্দেশনা ছিল।

মওলানা ভাসানী হলে ‘সম্প্রীতির ঐক্য’ প্যানেলের প্রার্থী নীহ্লা অং মারমা কার্যকরী সদস্য পদে ‘শূন্য ভোট’ পেয়েছেন বলে ফল ঘোষিত হলেও, তার সমর্থক রেলং খুমি দাবি করেন, তিনি নীহ্লাকে ভোট দিয়েছেন। রেলং প্রশ্ন তোলেন, তার ভোট কোথায় গেল? পরে রিটার্নিং অফিসার কাজী মহসিন জানান, যাচাই-বাছাইয়ে নীহ্লার ১৭ ভোট পাওয়ার কথা নিশ্চিত হয়েছে, যা ফাইনাল শিটে ভুলবশত উঠেনি। এটি সংশোধন করে ওয়েবসাইটে আপডেট করা হয়েছে।

হাতে গণনার সিদ্ধান্ত ও অভিযোগ

ভোট গণনায় ওএমআর মেশিনের পরিবর্তে হাতে গণনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় জামায়াত সংশ্লিষ্ট একটি কোম্পানি থেকে ব্যালট পেপার ও মেশিন কেনার অভিযোগের কারণে। নির্বাচন কমিশন এই সিদ্ধান্তকে ‘নির্ভুলতার চেষ্টা’ হিসেবে দাবি করলেও, এটিই গরমিলের মূল কারণ বলে অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষার্থী ও প্রার্থীরা এটিকে ‘অনিচ্ছাকৃত ভুল’ মানতে নারাজ, বরং ‘কারচুপি’ হিসেবে দেখছেন।

ফলাফল ও বিজয়ীদের তালিকা

নির্বাচনে ১৯টি সম্পাদকীয় পদের মধ্যে ১৫টিতে ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুর রশিদ জিতু ভিপি এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের মাজহারুল ইসলাম জিএস পদে নির্বাচিত হয়েছেন। তবে বর্জন, অনিয়ম ও গরমিলের অভিযোগে ফল ঘোষণার তিন দিন পরও ক্যাম্পাসে আলোচনা-সমালোচনা অব্যাহত রয়েছে।

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য

শহীদ রফিক-জব্বার হলের রিটার্নিং অফিসার অধ্যাপক মাহাবুবুর রহমান ভূঁইয়া গণনার ভুলকে ‘অনিচ্ছাকৃত’ বলে দাবি করেন। তিনি জানান, বাংলা সংখ্যা ৪৪ ও ৪২ কে ইংরেজি ৮৮ ও ৮২ ভেবে যোগ করায় ভোট ৫১৩ দেখানো হয়, যদিও প্রকৃত ভোট ৪২৯। ভুল ধরা পড়ার পর সংশোধিত ফল ঘোষণা করা হয়েছে এবং প্রার্থীদের জানানো হয়েছে। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, কোনো অভিযোগ থাকলে ডকুমেন্টসহ রিটার্নিং অফিসারের কাছে যোগাযোগ করলে সহযোগিতা করা হবে।

মওলানা ভাসানী হলের রিটার্নিং অফিসার কাজী মহসিন প্রথমে দাবি করেন, ভোট গণনায় ভুলের সুযোগ নেই, কারণ প্রার্থীদের এজেন্টদের সামনে বারবার যাচাই করে ফল চূড়ান্ত করা হয়েছে। তবে নীহ্লা অং মারমার শূন্য ভোটের অভিযোগের পর তিনি স্বীকার করেন, টালি শিটে ১৭ ভোট থাকলেও ফাইনাল শিটে ভুলবশত উঠেনি।

জাকসু সভাপতি ও উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল আহসানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনিরুজ্জামান বলেন, “ভোট গণনায় ভুল হলে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসার দেখবেন। ফলাফল নিয়ে আপত্তি থাকলে উপাচার্যের কাছে লিখিত অভিযোগ জানাতে হবে।”

শিক্ষার্থী ও প্রার্থীদের প্রতিক্রিয়া

শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রার্থী আশরাফুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “জয়-পরাজয় বড় বিষয় নয়, কিন্তু সারা দেশ যখন ফল দেখে অভিনন্দন জানিয়েছে, তখন বলা হলো ভুল হয়েছে। এত সময় নিয়েও এমন গুরুতর ভুল দুঃখজনক।” তিনি জানান, কর্তৃপক্ষ তাকে ফোনে ভুলের কথা জানিয়েছেন, তবে তিনি আর ঝামেলা চান না।

জাহানারা ইমাম হলের প্রার্থী লামিয়া জান্নাত বলেন, “শুধু টিক চিহ্ন বাইরে যাওয়ায় আমার ভোট বাতিল করা হয়েছে, যা অন্য হলে হয়নি। হাতে গণনায় এমন বাতিলের যৌক্তিকতা নেই।”

মওলানা ভাসানী হলের নীহ্লা অং মারমা দাবি করেন, তার কোনো এজেন্ট গণনার সময় ছিল না এবং কমিউনিটির ১০-১৫ ভোট পাওয়ার কথা ছিল। তিনি বলেন, “শূন্য ভোট প্রমাণ করে সুস্পষ্ট কারচুপি হয়েছে।” তার সমর্থক রেলং খুমি ফেসবুক পোস্টে প্রশ্ন তোলেন, “আমার ভোট কোথায় গেল? এটা জানা আমার অধিকার।”

নির্বাচনের আমলনামায় ঘটনাপ্রবাহ

৩৩ বছর পর অনুষ্ঠিত জাকসু নির্বাচন নানা নাটকীয়তা ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ভোট গ্রহণে বিশৃঙ্খলা, অধিকাংশ প্যানেলের বর্জন, দীর্ঘ গণনা প্রক্রিয়া এবং নির্বাচনি দায়িত্বে থাকা এক শিক্ষকের মৃত্যুর মতো ঘটনা এই নির্বাচনকে চিহ্নিত করেছে। হাতে গণনার সিদ্ধান্ত, যা ওএমআর মেশিন ব্যবহারের অভিযোগ এড়াতে নেওয়া হয়েছিল, তা-ই এখন বিতর্কের কেন্দ্রে।

নির্বাচনের ফলাফল ও গণনা প্রক্রিয়া নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। অভিযোগগুলোর নিষ্পত্তি এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, তা নিয়ে ক্যাম্পাসে দৃষ্টি রয়েছে।