‘ডিগ্রেডেড এয়ারশেড’ সাভার: শিল্পায়নের মাশুল, বায়ু উন্নয়নে উদ্যোগের দাবি

দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো নির্দিষ্ট এলাকাকে ‘ডিগ্রেডেড এয়ারশেড’ ঘোষণা হয়েছে, আর এই এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে রাজধানীর অদূরে সাভার অঞ্চলকে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের জারি করা ১৭ আগস্টের এক পরিপত্রে বলা হয়, বায়ুদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০২২-এর বিধি ৫-এর ক্ষমতাবলে সমগ্র সাভার উপজেলাকে ‘ডিগ্রেডেড এয়ারশেড’ ঘোষণা করা হয়েছে। বিধি ৫ অনুযায়ী, কোনো এলাকার বায়ুমান নির্দিষ্ট মানমাত্রা অতিক্রম করে মারাত্মক দূষিত এলাকায় পরিণত হলে এলাকাটিকে ‘ডিগ্রেডেড এয়ারশেড’ ঘোষণা করা যাবে।
পরিপত্রে বলা হয়েছে, ডিগ্রেডেড এয়ারশেড ঘোষিত সাভারে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কিছু কার্যক্রম সম্পাদন বা পরিচালনা করা যাবে না। নিষিদ্ধ কার্যাবলির মধ্যে রয়েছে—সাভার উপজেলার সব ধরনের ইটভাটায় (টানেল ও হাইব্রিড হফম্যান কিলন ছাড়া) ইট পোড়ানো ও প্রস্তুতকরণ, উন্মুক্ত স্থানে কঠিন বর্জ্য দাহ, এবং বায়ুদূষণের সম্ভাবনা থাকা নতুন শিল্পকারখানার জন্য কোনো অবস্থান বা পরিবেশ ছাড়পত্র দেওয়া। পাশাপাশি প্রণীত কর্মপরিকল্পনায় উল্লেখিত অন্যান্য কার্যক্রমও নিষিদ্ধ রয়েছে।
দীর্ঘ দিন ধরেই নগরায়ন, শিল্পায়নসহ নানা কারণে সাভারের পরিবেশ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এরমধ্যে বিশেষজ্ঞরা বারবার ইটভাটা, ব্যাটারি কারখানা, সীসা কারখানা, পরিবহণের ধোঁয়া ও নির্মাণ প্রকল্পগুলোকে চিহ্নিত করে এসেছেন। সবচেয়ে বেশি প্রকট আকার ধারণ করেছিল অবৈধ ইটভাটাগুলো।
২০২৩ সালে বেসরকারি স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) এক গবেষণায় দেখা গেছে, বায়ুদূষণের পেছনে ইটভাটা ২৮ শতাংশ দায়ী।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সাভারে ১০৭টি ইটভাটার মধ্যে মাত্র দুটি ভাটায় পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। শুষ্ক মৌসুমে এখানকার দূষিত বাতাস ঢাকায় প্রবাহিত হয়ে ঘনবসতিপূর্ণ জনজীবনকে আরও ঝুঁকির মুখে ফেলে। এসবের জেরেই সাভার অঞ্চলকে ‘ডিগ্রেডেড এয়ার শেড’ ঘোষণা করা হয়।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) মো. জিয়াউল হক বলেন, ‘‘নিয়মিত বায়ু দূষণ মনিটরিং করার জন্য আমাদের স্টেশন রয়েছে। পুরো বাংলাদেশে ৩১টা রয়েছে। ঢাকায় চারটি। সাভারে রয়েছে। আমরা দেখছি ৫-৬টা শহর সবচেয়ে দূষণ করে। ঢাকা শহর, ঢাকা জেলা, রংপুর, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, নারায়নগঞ্জ এগুলো প্রথম ৬-৭টা শহরের মধ্যে আছে। ঢাকা শহর যেহেতু মানুষ বেশি, সুতরাং এখানে দূষণ বেশি হলে মানুষের ক্ষয়ক্ষতিও বেশি হবে। এজন্য ঢাকার আশেপাশে কোন জায়গাটায় দূষণ বেশি। দেখা গেছে, সাভার উত্তরে, এবং দূষণের মাত্রা বেশি থাকার সময়টা, অর্থাৎ অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত বায়ু প্রবাহ হয় উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্বে। অর্থাৎ ঢাকার উত্তরের যে বায়ু দূষণ, সব ঢাকা শহরে ঢুকে অক্টোবরের পর থেকে। ফলে সাভারের দূষণ পুরোটাই ঢাকা শহরে ঢুকছে। সাভারে দূষণ কত সেটা আমরা দেখেছি, দেখা গেছে ঢাকা আর সাভারের দূষণ প্রায় সমান। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাভারের দূষণ ঢাকার চেয়ে বেশি। তবে সাভারের দূষণের সোর্স খুব বেশি নয়। ইটভাটা, বর্জ্য পোড়ানো, অল্প দুই একটা কারখানা আছে যেগুলো বায়ু দূষণ করে। এজন্য সাভারকে ধরেছি। সাভারের বায়ু দূষণ যদি কমানো যায়, তাহলে আমাদের ঢাকার দূষণের প্রভাব কমবে।’’
ইটভাটা পরিচালনার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘সাভার উপজেলায় কোনো ইটভাটা চলবে না। এটা জিরো। আমরা সবার সঙ্গে আলাপ করেছি। ইটভাটা মালিক সমিতির সঙ্গে আলাপ করেছি। উনারাও নীতিগতভাবে রাজি হয়েছেন। আলাপ করেই প্রজ্ঞাপণ দেওয়া হয়েছে। তাদের আমরা ব্লক কারখানা করতে বলা হয়েছে। সহজ শর্তে, কম সুদে ঋণ দেওয়া হবে বলেছি সরকার থেকে। প্রণোদনা দেওয়া হবে। সাভারের তিনভাগের দুইভাগ ইটভাটাই অবৈধ। সেগুলো বন্ধ করতে হবে। ‘ডিগ্রেডেড এয়ার শেড’ ঘোষণার কারণে সাভার উপজেলায় কোনো ইটভাটা পরিচালনা করতে দেওয়া হবে না। সবগুলো বন্ধ থাকবে। ঘোষণা দিয়ে বসে থাকলে চলবে না, ইটভাটা যাতে না চালাতে পারে সে বিষয়েও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
পরিবেশ ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাভারকে ‘ডিগ্রেডেড এয়ারশেড’ ঘোষণা গুরুত্বপূর্ণ, তবে বাস্তবায়ন জরুরি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জামাল উদ্দিন রুনু জানান, “ইটভাটা, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, শিল্পকারখানার ধোঁয়া ও পরিকল্পনাহীন উন্নয়ন সাভারের বায়ুদূষণের প্রধান কারণ। এর ফলে হৃদরোগ, শ্বাসতন্ত্রের সমস্যাসহ স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। মাস্টারপ্ল্যান ছাড়া, কঠোর আইন প্রয়োগ ও সচেতনতা বৃদ্ধি না হলে বায়ুদূষণ থেকে মুক্তি মিলবে না।”
অন্যদিকে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘“সাভারে বায়ুদূষণের কারণে শ্বাসতন্ত্রের রোগ, হাঁপানি, ফুসফুসের ক্যান্সার, হৃদরোগ, কিডনি ফেইলিওর, মানসিক অস্থিরতা ও বন্ধ্যাত্ব বাড়ছে। এটি আয়ু ৬-৭ বছর কমায়। ‘ডিগ্রেডেড এয়ারশেড’ ঘোষণা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু দূষণের উৎস বন্ধে কঠোর উদ্যোগ ও বাস্তবায়ন না হলে কোনো ফল হবে না। চীনের মতো সাফল্যের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি।”
তিনি বলেন, ‘‘ডিগ্রেডেড করা, এটিকে আপগ্রেড করার জন্য অর্থাৎ দূষণের কারণ ঠিক করার যেসব উদ্যোগ সেগুলো নিতে হবে। বাস্তবায়ন করতে হবে। নাহয় এ ঘোষণা কোনো তাৎপর্য বহন করে না। চীন তার বায়ু দূষণ কমানোর জন্য ১০ বছর আগে কাজ শুরু করে। এরমধ্যে তারা অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছে। আমাদের সে কাজগুলো করতে উদ্যোগ নিতে হবে। ঢাকার বায়ু দূষণ পৃথিবীর শীর্ষ দূষিত নগরের একটি, এটি আমরা বলছি, কর্তৃপক্ষ জানে। কিন্তু উদ্যোগ নেই। সাভারের ক্ষেত্রে এমন হলে যা তাই হবে। ঘোষণায় লাভ হবে না। সত্যিকারের উদ্যোগ নেওয়া হলে লাভবান হওয়া যাবে।’’
আইন প্রয়োগ ও নজরদারির আহ্বান, নাগরিক সমাজের
সাভারে দীর্ঘ দিন ধরে কর্মরত জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক তুহিন খান। নিয়মিত লেখালেখি করছেন ইটভাটাসহ বায়ু দূষণ নিয়ে। তিনি বলেন, ‘‘সরকার যেটি ঘোষণা করেছে, এটি কার্যকর করা হলে সেটি অত্যন্ত ইতিবাচক। সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর তদারকি করতে হবে। পৌরসভার ভেতরে ইটভাটা করার বিধান নাই, কিন্তু সাভার পৌরসভায় ইটভাটা আছে। কলকারখানার বর্জ্য, ট্যানারি বর্জ্যেও পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় পরিবেশ বিষময়। ফসলি জমি নষ্ট হচ্ছে। এই উদ্যোগটি ভালো। তবে সরকারকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। ইটভাটা বন্ধ করতে হবে। আরও যেসব তৎপরতা প্রয়োজন নিতে হবে। সেক্ষেত্রে সুফল পাওয়া যাবে। সাভারের সর্বস্তরের মানুষই এটির জন্য ক্ষতিগ্রস্ত। ফলে এই উদ্যোগকে সাধারণ মানুষও স্বাগত জানাচ্ছে।’’
সাভার নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক সালাউদ্দিন খান নঈম বলেন, ‘‘পরিবেশ অধিদপ্তর যে উদ্যোগ নিয়েছে, আমরা এটিকে স্বাগত জানাই। মানুষের স্বাস্থ্যের যে চরম ঝুঁকি তৈরি হয়েছিল, আমরা দীর্ঘ দিন ধরে সেটি নিয়ে কথা বলেছি।আমাদের নদী-নালা, খাল বিল পরিবেশ যেভাবে দূষিত হয়েছে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে আমরা এখানে বসবাস করতে পারবো না। এগুলো আমরা বারবার বলেছি। সরকার যে ব্যবস্থা নিয়েছে, শুধু কাগজপত্রে যাতে সেটি সীমাবদ্ধ না থাকে। অবস্থা থেকে বেরিয়ে বাসযোগ্য সাভার গড়তে যা যা প্রয়োজন, সরকার সেগুলো করতে পিছপা হবে না। সাভারের প্রাণ প্রকৃতি ফিরিয়ে আনবে সেটিই আমরা চাই।’’
তিনি বলেন, ‘‘এখানে যথাযথভাবে পরিবেশ বিপর্যয় সংক্রান্ত বিষয়ে উদ্যোগ নিতে একটা ক্রাশ প্রোগ্রাম নিতে হবে। যে পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে না আসে, সেটি চলমান রাখতে হবে। আর এখানকার গুরুত্ব অনুধাবন করে পরিবেশ অধিদপ্তরকে অনুরোধ করবো, এখানে একটা কার্যালয় চালু হোক। যাতে তারা দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারে। না হলে আগে যে অবস্থা ছিল, সেরকমই রয়ে যাবে। এজন্য উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানাই। সেখানে সাভারের নাগরিক সমাজ সর্বোচ্চ সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।’’
এদিকে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপার সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির বলেন, ‘‘বায়ু দূষণের মাত্রা অনুযায়ী এই ঘোষণাটি ভালো। কিন্তু কতটা বাস্তবায়ন হয় সেটিই দেখার। দেশে পরিবেশ আইন আছে। কিন্তু আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন হয় না। ওখানে কতগুলো ইটভাটা রয়েছে। তারা বলে, অনুমতি নিয়ে করছে। আমরা প্রশ্ন করেছি, বৈধ যদি হয়, এগুলো কি দূষণ করে না? দূষিত তো হয়। তাহলে দূষণের জিনিস রেখে কিভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ইটের ভাটা দূষণের অন্যতম সোর্স। কিন্তু সেগুলো সরানো যাচ্ছে না। সেখান থেকে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি দূষিত বায়ু আসে। আমরা শঙ্কিত, এটি আসলেই ঠিকমতো বাস্তবায়ন হবে কিনা। পলিথিনের কোনো বিকল্প দেওয়া যায়নি। ঘোষণা কিন্তু কাজে আসেনি। ফলে বায়ু দূষণের উৎস যদি বন্ধ না করা হয়। তাহলে এই ঘোষণা কোনো কাজে আসবে না।’’
তিনি বলেন, ‘‘ইটভাটার বিষয়ে সরকার বলেছিল ২০২৫ সালের মধ্যে ৮০ ভাগ ব্লক ইটে রুপান্তর হবে। কিন্তু সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। এখন ২০৩৫ সাল পর্যন্ত সেটি বর্ধিত করা হয়েছে। আমরা বলছি, বাইরে না হলেও অন্তত সরকারি প্রকল্পে ব্লক ইটের ব্যবহার হোক। তাহলেই ৫০ ভাগ বাস্তবায়ন হবে। আর যারা বিনিয়োগ করেছে, তাদের প্রণোদনা দেওয়া হোক। তারা ব্লকের দিকে আকৃষ্ট হোক। পরিবেশের যে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, প্রণোদনা দিলে তার চেয়ে কম ব্যয় হবে। এছাড়াও অন্যান্য যেসব সোর্স রয়েছে দূষণের সেগুলো বন্ধে কঠোর উদ্যোগ নিতে হবে।’’
সাভার উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আবু বকর সরকার বলেন, ‘‘আমরা গত অবৈধ ইটভাটার ৩২টি চিমনি ভেঙে দিয়েছি। অর্থদণ্ড, কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অসংখ্য সীসা কারখানা, ব্যাটারি কারখানা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এখনও চলমান। তথ্য পাওয়া মাত্রই সেগুলো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সাভারকে যেহেতু ডিগ্রেডেড এয়ার শেড ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে বায়ু দূষণে ভূমিকা রাখা যেসব অবৈধ ইটভাটা, ব্যাটারি কারখানা, সীসা কারখানা রয়েছে সেগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করা হবে।’’
Comments