Image description

বাংলাদেশের জনগণের আস্থার দল- ভালোবাসার দল বিএনপি। গত নির্বাচনগুলোই সাক্ষ্য দেয় বিএনপির জনপ্রিয়তার। কিন্তু জনপ্রিয়তার পাশাপাশি দলটির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রেরও শেষ নেই। বিএনপি বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হয়েও বার বার মিডিয়া ট্রায়ালের সম্মুখীন হয়েছে। বিশাল রাজনৈতিক দল বিএনপি জনগণের রাজনীতিতে সবসময় নিজের ব্যস্ত রেখেছে। 

গণকল্যাণে কাজ করেছে সবসময়। কিন্তু মিডিয়াতে নিজেদের লোকবল তৈরির চেষ্টা করেনি কখনও। বরং বলা যায়, বিএনপির হাত দিয়ে জামায়াত মিডিয়াতে লোকবলের শক্তিশালী বলয় গড়ে তুলেছে। এদের মধ্যে বিএনপি অথবা জামায়াতের কে তা নিয়ে বিএনপি কখনো মাথাই ঘামায়নি। এসব উদাসীনতার চূড়ান্ত ফসল মিডিয়া ট্রায়াল।

বিএনপির শক্তিশালী মিডিয়া উইং নেই। সেটি আছে সেখানে প্রকৃত সাংবাদিক নেই। মিডিয়া কর্মীদের সঙ্গে বিএনপির সুসম্পর্ক কখনোই দলগতভাবে গড়ে ওঠেনি। বেশির ভাগ হয়েছে ব্যক্তি সম্পর্ক কেন্দ্রিক। দলকে বাদ দিয়ে ব্যক্তির স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সুবিধা দিচ্ছে তথাকথিত বিএনপিপন্থিরা। অতীতেও এসবের খেসারত দিতে হয়েছে। 

২০০৭ সালের ওয়ান/ইলেভেনের পরও ভয়াবহ মিডিয়া ট্রায়ালের সম্মুখীন হয় বিএনপি। বস্তুত বিশেষ করে নির্বাচনের আগে যখনই বেশির ভাগ মানুষের সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়, তখনই শুরু হয় বিএনপির বিরুদ্ধে মিডিয়া ট্রায়াল। ২০০৭ সালে উগ্র অসাম্প্রদায়িক চেতনার নামে আওয়ামী লীগ এবং বামপন্থিদের দ্বারা মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার হয় বিএনপি। বর্তমানেও উগ্র সাম্প্রদায়িকতার দ্বারা মিডিয়া ট্রায়ালের সম্মুখীন দলটি। বিএনপির মারাত্মক ইমেজ সংকট তৈরি করতে তৎপর হয়ে উঠে পড়ে লেগেছে ষড়যন্ত্রকারীরা। এদের সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে ফ্যাসিস্টের দোসররাও।

প্রথমেই বুঝে নেয়া যাক মিডিয়া ট্রায়াল কী? মিডিয়া ট্রায়াল বলতে বোঝায় কোনো ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে এমনভাবে খবর প্রচার করা, যাতে সাধারণ মানুষ আগে থেকেই তাদের দোষী ধরে নেয়। এমনকি আদালতে বিচারাধীন বিষয়ে রায় ঘোষণার আগেই। এমন হওয়ার কারণ পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদ কাভারেজ, মনগড়া সংবেদনশীল হেড লাইন, বিভ্রান্তিকর চিত্র, তথ্য ও উপস্থাপনা; রাজনৈতিক প্রভাবিত টকশো ও বিশেষ অনুষ্ঠান। 

এই প্রক্রিয়ায় যুক্তি ও তথ্য গৌণ হয়ে পড়ে; মূলত চরিত্রহনন ও জনমত প্রভাবিত করাই হয় মূল উদ্দেশ্য। এতে করে দেশে গভীর ও সুদূরপ্রসারী সংকট তৈরি হয়। গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো স্বাধীন ও নিরপেক্ষ গণমাধ্যম। যেখানে গণমাধ্যম অবাধ ও পক্ষপাতহীন, সেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা টিকে থাকে, সত্য উদ্ঘাটিত হয়, রাষ্ট্রের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে গণমাধ্যমের বড় একটি অংশ আজ দলীয় নিয়ন্ত্রণ ও পক্ষপাতদুষ্ট প্রচারে ব্যবহৃত হচ্ছে। 

এর একটি বড় শিকার হলো অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। বর্তমান সময় বিএনপি যেন একটি ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ এর চক্রে আটকে গেছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের সময়ও একই চিত্র আমরা দেখতে পেয়েছি। নানা ইস্যুতে দলটির বিরুদ্ধে বিচারপূর্ব অপবাদ, রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্রহনন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রতিবেদনের মাধ্যমে বার বার সমাজে একটি বিভ্রান্তিকর চিত্র গড়ে তোলা হয়েছে। এতে করে শুধু বিএনপি নয়, ক্ষতি হয়েছে গণতন্ত্র ও মতবাদের বহুত্ববাদ যা সাম্প্রতিক সময়ে ঘটা গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে। কথিত গণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটেছে স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্টরূপে।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও রেহাই পাননি ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ এর এই চক্র থেকে। তার বিরুদ্ধে নানা মামলার রায়ের আগে থেকেই তাকে ‘অপরাধী’, ‘দুর্নীতিবাজ’, ‘জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক’ হিসেবে প্রচার করা হয়। অথচ কোনো মামলার পূর্ণাঙ্গ বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দোষী বলা আইন বিরুদ্ধ। 

কিন্তু টেলিভিশন টকশো, রিপোর্ট ও বিশেষ পর্বে বারবার এই ভাষা ব্যবহার করা হয়। সাথে সাথে দলটির বিরুদ্ধেও নানাবিধ সহিংসতার একতরফা দোষারোপ একটি সামাজিক ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে। মিডিয়ার কিছু অংশ ও পত্রপত্রিকায় আওয়ামী আমলে নেতাদেরকে কখনও ‘ভারতবিরোধী’, কখনও ‘পাকিস্তানপন্থি’ আবার কখনও ‘ইসরায়েলি এজেক্ট’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এগুলোর পেছনে কোনো কারণ ছিল না বরং এগুলো ছিল শুধুই মতবিরোধের প্রতিশোধমূলক প্রচার।

’২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের পর কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সমগ্র দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে বৈষম্যবিরোধী নামের প্লাটফর্ম। সমগ্র বাংলাদেশের জেলাসমূহ, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এমনকি উপজেলায়ও বৈষম্যবিরোধী নামে সমন্বয়ক, সহ-সমন্বয়কের নামে দীর্ঘ তালিকা প্রকাশ করে। এই তালিকায় থাকা নেতাকর্মীদের অধিকাংশই অন্যায্যভাবে রাষ্ট্রীয় সুবিধা ভোগের পাশাপাশি অপকর্মের বৈধতা পেয়ে যায়। 

বৈষম্যবিরোধী প্লাটফর্মে থেকে অন্যায় করলেও আইনের আওতায় আসতে হয় না বিধায় সমন্বয়ক নামে সারাদেশে দখলদারিত্ব শুরু করে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও নিজেদের রক্ষা করতে এই প্লাটফর্মে নাম লেখান। যার ফলে প্রকাশ্যে জনরোষের মুখে পরে বৈষম্যবিরোধী প্লাটফর্মের নেতারা এবং সাধারণ মানুষের চাপে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে প্রশাসন। একদিকে সমাজকল্যাণমূলক কাজে বিএনপির নেতা-কর্মীরা অংশগ্রহণ করায় বিএনপির সুনাম বেড়েই চলেছে, অপরদিকে দীর্ঘদিনের ফ্যাসিবাদীর সুবিধাভোগী এবং সহযোগী গোষ্ঠীর অপকর্মের তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে। 

এই নব্য ফ্যাসিবাদীগোষ্ঠী তখন বিএনপির সুনাম ক্ষুণ্ন করতে বিএনপির বিরুদ্ধে বিভিন্ন কুৎসা রটনা করছে, কখনো প্রকাশ্যে, কখনো অপ্রকাশ্যে। আওয়ামী লীগের প্রশিক্ষিত বাহিনীর সাথে এনসিপি গোপন আঁতাত করে বিএনপির বিরুদ্ধে ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ করছে কি না তাও সময় সাপেক্ষে প্রকাশিত হচ্ছে। ফ্যাসিবাদীর সহযোগী এনসিপি বিভিন্ন গোষ্ঠীর সহযোগিতা নিয়ে, তাদের অপশাসন দীর্ঘ করতে কৌশলে বিএনপির বিরুদ্ধে মিডিয়া ট্রায়াল করছে। 

বিএনপির সুনাম ক্ষুণ্ন করতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগ এনসিপি নেতাকর্মীরা অহরহ মিডিয়ায় প্রকাশ্যে বলছে। ইতোমধ্যে নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে সর্বমহলে আলোচনা চলছে। গণমাধ্যম ও ভার্চুয়াল মাধ্যম সরব হচ্ছে নির্বাচন দ্রুত হওয়া নিয়ে। নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপির বিরুদ্ধে মিডিয়া ট্রায়ালের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত নব্য ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠী। 

তাই গণমাধ্যম হোক, আর ভার্চুয়াল প্রচার মাধ্যম হোক, বিএনপিকে সময় থাকতেই এদিকে মনোযোগ দেয়া জরুরি। গণমাধ্যমে কীভাবে তার নীতি-আদর্শ এবং মিশন-ভিশন তুলে ধরা যায়, এ পদক্ষেপ নিতে হবে। ভার্চুয়াল এবং পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেল মিডিয়ায় নিজস্ব বলয় তৈরি করে দলের প্রচার-প্রচারণার কৌশল অবলম্বন করা দলটির জন্য অপরিহার্য। এসব ক্ষেত্রে, জাতীয়তাবাদী ধারার লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদদের যুক্ত করতে হবে। 

ইতোমধ্যে আগামী নির্বাচনে যেসব দল প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে, তারা সকল মিডিয়ায় বিএনপি বিরোধী প্রচারণায় অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বিএনপিকে ভোট দিলে কী ক্ষতি, তাদের নির্বাচিত করলে কী উপকার হবে, সেসব তথ্য তুলে ধরছে। তাদের এসব নেতিবাচক জবাব দেয়া এবং বিএনপির পক্ষে কথা বলার মতো গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ও ব্যক্তির সংখ্যা খুবই নগণ্য। তাই বিএনপিকে এখন থেকেই মিডিয়াকে অনুকূলে রাখার কৌশল অবলম্বন করতে হবে। এটাই হবে দলের বিরুদ্ধে ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ বন্ধ করার সঠিক উদ্যোগ।

লেখক: সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক, জিয়া স্মৃতি পাঠাগার, কেন্দ্রীয় কমিটি