Image description

ভেবেছিলাম ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি নিয়ে কিছু লিখবো না। কারণ যাদের নিয়ে লিখবো এই কোমলমতি শিশুদের কথা চিন্তা আসলেই মাথা ঘুরপাক খায়। তারপরেও নিজের বিবেকের কাছে হয়তো দায়বদ্ধতা রয়েছে বিধায়ই মন বার বার বলছে কোমলমতি শিশুদের নিয়ে লিখতে। এ লেখাটি যখন শুরু করেছিলাম তখন নিজেকে যেমন অপরাধী মনে হচ্ছিল, কারণ কোমলমতি শিশুদের মৃত্যু নিয়েও রাজনীতি; এই সভ্য সমাজে আমরা বাস করছি। 

নামধারী সভ্য সমাজে আমরা দিন দিন অসভ্যতার পরিচয় দিচ্ছি। ঢাকা শহরের যান্ত্রিক এক দুপুর হঠাৎই দগ্ধ হলো আগুন আর আর্তনাদে। উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে ২১ জুলাই দুপুর ১টার পর বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে, তা-ও ক্লাস চলাকালীন। ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়তেই স্কুলগেটের কাছাকাছি নামে উৎসুক জনতার ঢল। সামনে এগোনোই যেখানে দায়, তার মাঝেই চোখে পড়ে অসংখ্য নাড়ি ছেঁড়া ধন হারানো মায়ের আর্তনাদ, বাবার আহাজারি। 

চোখে পানি, মুখে একটাই কথা, ‘আমাদের ছোট ছোট সোনামনিরা স্কুলের ভেতর আটকে আছে, ভাই, কেউ ওদেরকে উদ্ধার করুন!’ কেউ অপেক্ষায় রয়েছে, কেউ দৌড়াদৌড়ি করছে, কেউ কেউ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে লাশের উপরে, আবার অনেকে খবর শুনে রওনা হয়েছে। কিন্তু মা-বাবার মন তো মানে না। তাদের সন্তানকে ফিরে পাওয়ার আর্তি। ভেতরে তখন ভয়াবহ অবস্থা। বাতাসে পোড়া গন্ধ। চারদিকে হাহাকার। কারও দগ্ধ শরীরে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া ইউনিফর্মের অংশ লেপ্টে আছে। 

কারও পুরো শরীর আগুনে পোড়া, শুধু পায়ে স্কুলের জুতা। পোড়া দেহ নিয়ে এভাবেই হেঁটে হেঁটে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বের হতে থাকে শিশুরা। সন্তানকে ফিরে পাওয়ার আকুতিতে ভারী হয়ে উঠেছে যেখানে কিছুক্ষণ আগেও শিশুদের চাঞ্চল্যে ভরে থাকা স্কুল প্রাঙ্গণ। ধ্বংসস্তূপে ভাঙা চেয়ার জানালার মাঝে একটি আধপোড়া ছোট্ট জুতা দেখেও ছুটছে বাবা-মা, এই বুঝি তার সন্তান। এমন ট্র্যাজেডি দেখে বুকটা হু-হু করে ওঠে। কত স্বপ্ন, কত প্রাণ নিমেষেই ঝরে গেল! এ যেন এক বিভীষিকাময় দিনের ক্ষত, যা পুরো জাতিকে কাঁদিয়ে গেল।

দেশ-বিদেশে অসংখ্য বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় অনেক মানুষের প্রাণহানিও হয়েছে। কিছু কিছু দুর্ঘটনা মানতে না পারলেও কখনো কখনো মেনে নেয়া যায়, কিন্তু কিছু কিছু ট্র্যাজেডি বা ঘটনা আছে ভুলতে চাইলেও ভোলা যায় না, মানাও কষ্টকর হয়ে যায়। ঠিক এমন একটি দুর্ঘটনা মাইলস্টোন। ছোট ছোট শিশুদের স্বপ্নভঙ্গ আর আর্তনাদের এই মর্মান্তিক দৃশ্য আমাদের দেখতে হয়েছে। এমন ঘটনা নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কোনো উপায়ও যে নেই। কিন্তু কখনো কখনো এমন ট্র্যাজেডি নিয়ে যখন রাজনীতি হয় বা ট্রল করে এমনকি তথ্যবিভ্রাট ঘটে তখন আরও কাঁদায় জাতিকে। 

বিমান দুর্ঘটনার পরদিন পর উত্তাল হয়ে উঠেছে রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণ। বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী আন্দোলন করছেন। তারা দাবি করছেন, দুর্ঘটনায় নিহত প্রকৃত লাশের সংখ্যা লুকানো হচ্ছে। প্রকৃত লাশের হিসাব দাবি করছেন তারা। সেইসঙ্গে এই দুর্ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড উল্লেখ করে বিচার দাবি করছেন। যেখানে বিশ্বস্ততার প্রতীক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মাঠে তখন এমন অভিযোগ সত্যিকারের কাম্য নয়। তাছাড়া যখন ছোট-বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে সেই ঘটনা ভিন্নখাতে নিতে রাজনীতির মতো হাতিয়ার ব্যবহার করতে দেখা গেছে। দেখতে হয়েছে ১০০ টাকার রিকশা ভাড়া ৩০০ টাকা আর ৬০ টাকার দুই লিটার পানির দাম ৬০০ টাকা। 

আমাদের দেশে এখন এমন সংস্কৃতি শুরু হলো যে, লাশ নিয়েও আমরা রাজনীতি করছি। সেই ব্যাখ্যা আমি মুহূর্তে লিখতে চাই না। এমন অপরাজনীতি জাতি দেখছে বিমান দুর্ঘটনার মধ্য দিয়েও তা স্পষ্ট। আবার আমরা এও দেখেছি মাইলস্টোনে বিমান দুর্ঘটনায় হতাহতের জন্য রক্ত দিতেও হাজার হাজার মানবিক মানুষের দীর্ঘ লাইন। আবার এটাও দেখা যাবে আরেক ইস্যু সামনে আসার পর গোটা জাতি বেমালুম ভুলে যাবে। এখন কত আবেগ, কত বিবেক আর কত আর্তনাদ সবই আমাদের নামধারী সভ্য সমাজে অসভ্যতার যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে যাবে। কয়েকদিন পর বিচারও চাইবে না হতাহতের স্বজনরা, সরকারের পক্ষ থেকে ভুলেই যাবে আর বিমান কর্তৃপক্ষের সান্ত¡নার বাণী তাও বন্ধ হয়ে যাবে। 

বিমান দুর্ঘটনা থেকেই অনলাইন নিজউপোর্টাল এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নজর দিয়েছি প্রতি মুহূর্ত। দুর্ঘটনার পরদিন মঙ্গলবার সকালেই চোখে পড়লো সংবাদপত্রের শিরোনাম। বিভীষিকাময় এমন দুর্ঘটনার প্রতিটি শিরোনাম বুক ফেটে যাওয়ার মতো। জানি না নিহত শিশুর সন্তানদের অভিভাবকদের কি অবস্থা। কীভাবে সহ্য করছেন তারা। এ মুহূর্তে বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় গায়ক হায়দারের জনপ্রিয় গানের কথা। ‘যার চলে যায় সেই বুঝে হায়, বিচ্ছেদে কি যন্ত্রণা। অবুঝ শিশুর অবুঝ প্রশ্ন কি দিয়া দেব সান্ত¡না। আমি চিৎকার করে কাঁদিতে চাহিয়া করিতে পারিনি চিৎকার।’ আসলেই যার চলে যায় সেই বুঝে কত কষ্টের, কত বেদনার। 

আবার সেখানেও জাতির কিছু কুলাঙ্গার নির্লজ্জতার পরিচয় দেয়। বুকের ব্যথা বুকে চাপিয়ে নিজেকে ধিক্কার দেয়া ছাড়া কিছুই নেই সভ্য মানুষ হিসেবে। বিমান দুর্ঘটনার পরদিন কালের কণ্ঠ লিখেছে ‘মর্মান্তিক বিভীষিকা, শোকার্ত দেশ’, বাংলাদেশ প্রতিদিনের শিরোনাম ‘স্কুলে বিমান বিধ্বস্তে লাশের সারি’, প্রথম আলো লিখেছে- ‘স্কুলে ভেঙে পড়ল বিমান, নিহত ২২’, সমকালের শিরোনাম ‘শিশুদের আর্তনাদ, স্বজনের কান্নার একদিন’, রুপালী বাংলাদেশ শিরোনাম করেছে ‘ক্লাস শেষ, হলো জীবনেরও শেষ’, যুগান্তর লিখেছে ‘জাতির কাঁধে সন্তানের লাশ’, ইত্তেফাকে ‘বড় বেদনাবিধুর প্রাণের বিয়োগ’, নয়াদিগন্ত লিখেছে ‘উত্তরা ট্র্যাজেডিতে স্তব্ধ দেশ’, বণিক বার্তা লিখেছে ‘উত্তরায় স্কুল ভবনে বিমান বিধ্বস্ত, শিক্ষার্থীসহ নিহত অন্তত ২২’, আজকের পত্রিকায় এসেছে, ‘শিশুদের উচ্ছ্বাস ভেসে গেল আর্তনাদে’, দেশ রূপান্তরের শিরোনাম ‘স্কুলে বিধ্বস্ত বিমান, কাঁদছে দেশ’, কালবেলায় ‘যেন আকাশ ভেঙে পড়ল!’, ইনকিলাবে ‘বিভীষিকাময় উত্তরা ট্র্যাজেডি’, জনকণ্ঠ করেছে ‘উত্তরায় প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত’, আমাদের সময়ে এসেছে ‘শোকে মুহ্যমান সারাদেশ’, আর মানবজমিনের শিরোনাম শুধু এক শব্দেই এই ভয়াবহতা প্রকাশ করেছে ‘বিভীষিকা’। পত্রিকার শিরোনামগুলো ধারাবাহিক পড়তে পড়তে চোখে অজান্তেই পানি এসে যায়। 

এ যেন পুরো একটি প্রজন্মের স্বপ্ন মাটির সঙ্গে মিশে গেল। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ছবি কেবল একটাই কথা বলে এই শোক কোনো কাগজের পাতায় মাপা যায় না, কাগজের পাতায় লিখে স্বজনদের সান্ত¡না দেয়া যায় না। বিমান দুর্ঘটনা নতুন কিছু নয়। ভয়াবহ অনেক দুর্ঘটনার কথা আমরা জানি। বিভিন্ন কারণে ঘটে এ ধরনের দুর্ঘটনা। অসহায়ের মতো সমর্পণ ছাড়া যেন কিছুই করার থাকে না। পাইলট-ক্রুরা হয়ে পড়েন নিরুপায়। বাংলাদেশের কয়েকটি বিমান ভাগ্যেও জুটেছে এমন ঘটনা। 

বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ চলাকালে ১৯৯১ সাল থেকে ৩২টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। ’৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় ছিল সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। সেসময় এক দিনেই ৪৪টি বিমান সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। ২১ জুলাই উত্তরার দুর্ঘটনা- এ তালিকায় বিরল ও ভয়াবহ সংযোজন। যেখানে বিমান সরাসরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিধ্বস্ত হয়ে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে।

বিমানবাহিনীর এর আগের বেশির ভাগ দুর্ঘটনা প্রশিক্ষণ চলাকালেই ঘটে, যা পিটি-৬, ইয়াক-১৩০, এল-৩৯ বা এফ-৭ টাইপ বিমানের ক্ষেত্রে বেশি দেখা গেছে। প্রায় প্রতি দশকেই ফ্লাইট ক্যাডেট এবং স্কোয়াড্রন লিডারদের প্রাণহানি ঘটেছে। বিমান দুর্ঘটনা নিয়ে বিমানের প্রতি বা পাইলটের প্রতি আমার তেমন কোনো অভিযোগ নেই, তদন্তে প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে কিন্তু আমার একটি আক্ষেপের বিষয় হলো দেশে শুধু বিমান দুর্ঘটনাই নয় যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু সেই তদন্ত সত্যিকারে হয় কিনা, হলেও কতটুকু আলোর মুখ দেখেছে বা কতটুকু আইনের আওতায় এনেছে এমনকি কি কারণে দুর্ঘটনা ঘটলো তা থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে অগ্রগতি হয়েছে কতটুকু? আসলে হয়েছে কি... ঘটনা ঘটেছে তদন্ত কমিটি করা দরকার করা হয়েছে, তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার কথা দেয়াও হয়েছে।

কিন্তু বাস্তবতা ঘোড়ার ডিম; পরিশেষে বলতে চাই, যে কোনো দুর্ঘটনা শোকের, কষ্টের। নিজ চোখে সন্তানকে আগুনে পুড়তে দেখেছে মা-বাবা। স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে গেছে গোটা দেশ। কত স্বপ্ন, কত প্রাণ নিমেষেই ঝরে গেল! যাদের একেকটি স্বপ্ন ছিল। এ যেন এক বিভীষিকাময় দিনের ক্ষত, যা পুরো জাতিকে কাঁদিয়ে গেল। আমরা আর এমনভাবে কাঁদতে চাই না, আমরা আর কোনো মায়ের বুক খালি দেখতে চাই না। তদন্ত তদন্ত খেলাও দেখতে চাই না। পেছনের যতগুলো ঘটনার সঠিক তদন্ত করা হোক, প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন করে অপরাধীদের আইনের আশ্রয় নেয়া হোক, এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাই না।  শিশুদের এমন আর্তনাদ জাতি দেখতে চায় না। 

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক