Image description

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় স্বৈরাচার শেখ হাসিনার নির্দেশে পুলিশের গুলিতে হতাহতের ঘটনায় সারাদেশে দায়ের করা ১৬০১টি মামলার মধ্যে ৭৬১টি সরাসরি পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে। এসব মামলায় ১ হাজার ১৬৮ জন পুলিশ সদস্যকে আসামি করা হয়েছে, যাদের মধ্যে সাতজন সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যায়ের সদস্যও রয়েছেন। তবে, এত সংখ্যক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ৬১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দুটি মামলায় ৯ জন পুলিশ সদস্যের বিচার শুরু হলেও বেশিরভাগ মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।

তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা ও পুলিশের বক্তব্য: তদন্তের দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এই মামলাগুলো অত্যন্ত স্পর্শকাতর। যেহেতু অধিকাংশ আসামি এখনো বাহিনীতে কর্মরত, সেহেতু তাড়াহুড়ো করে তদন্ত করলে ভুল হতে পারে এবং বাহিনীর মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হতে পারে। তাই, নির্ভুল এবং প্রশ্নাতীত তদন্ত নিশ্চিত করতে তারা সময় নিচ্ছেন। পুলিশ সদর দপ্তর এবং বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই মামলাগুলোর তদন্ত কার্যক্রম বিশেষভাবে তদারকি করছেন।

পুলিশের সূত্র অনুযায়ী, গত বছরের ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান চলাকালে সারাদেশে হত্যা, হত্যাচেষ্টাসহ বিভিন্ন ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে ৭৬১টি মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার সরকারের মন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি পুলিশ সদস্যদেরও আসামি করা হয়েছে। মামলাগুলো করেছেন জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদদের স্বজন, আহত ব্যক্তি ও তাদের স্বজনরা।

আসামি ১১৬৮ জন পুলিশ সদস্যের মধ্যে রয়েছেন- সাতজন সাবেক আইজিপি, ৪১ জন সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি, ১২ জন সাবেক উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি), ১১ জন বর্তমান ডিআইজি, দুজন সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি, ৪৯ জন অতিরিক্ত ডিআইজি, তিনজন সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি), ৬৬ জন বর্তমান এসপি, ৬৫ জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ৩৫ জন সহকারী পুলিশ সুপার, ১৮৭ জন পরিদর্শক, ৩৪০ জন উপপরিদর্শক (এসআই), ১১৭ জন সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই), ২২৪ জন কনস্টেবল। এছাড়াও টিএসআই, এটিএসআই, নায়েক এবং পদ উল্লেখ না থাকা পুলিশ সদস্যরাও আসামির তালিকায় রয়েছেন।

গ্রেফতারকৃত ৬১ জন পুলিশ কর্মকর্তার মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন- সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক, সাবেক ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার মশিউর রহমান, ডিআইজি মোল্যাহ নজরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার সাইফুল ইসলাম, ডিএমপির সাবেক উপকমিশনার মো. জসীম উদ্দীন মোল্লা, পুলিশ সুপার তানভীর সালেহীন, মহিউদ্দিন ফারুকী, আবদুল মান্নান, এস এম তানভীর আরাফাত, আসাদুজ্জামান, মো. আবদুল্লাহিল কাফী ও জুয়েল রানা, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম, ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহিদুল ইসলাম, খুলনা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. সাদেক কাওছার দস্তগীর, বরিশালের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলেপ উদ্দিন, ডিএমপির মিরপুর বিভাগের দারুস সালাম জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার এম এম মইনুল ইসলাম, ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের সহকারী কমিশনার ইফতেখার মাহমুদ ও মো. তানজিল আহমেদ, ডিএমপির বাড্ডা অঞ্চলের সহকারী কমিশনার রাজন কুমার সাহা, যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান, গুলশান থানার সাবেক ওসি মাজহারুল ইসলাম।

বিশেষজ্ঞদের মতামত: আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এত সংখ্যক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তদন্তের গতি ধীর হওয়া ন্যায়বিচারের পথকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার আব্দুল ওহাব শিকদার মানবকণ্ঠকে বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানে যারা হতাহত হয়েছেন, তাদের পরিবার ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রাখে। পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকায় তদন্তে সতর্কতা প্রয়োজন, তবে এই দীর্ঘসূত্রিতা সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থা সংকট তৈরি করতে পারে। দ্রুত ও স্বচ্ছ তদন্ত নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব।’

পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, প্রতিটি মামলার তদন্ত গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছে এবং সব ধরনের প্রশ্ন ও বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে নির্ভুল তদন্ত নিশ্চিত করাই তাদের লক্ষ্য। তবে, এই ধীরগতির তদন্ত প্রক্রিয়া ন্যায়বিচারের পথকে কতটা মসৃণ করবে, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।