
স্বস্তি-অস্বস্তিতে সময় পার করছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কিছু কর্মকাণ্ডে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচনের বিষয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। সরকারের ভেতরের একটি অংশ ও কয়েকটি দল নির্বাচন বিলম্বিত করার ‘ষড়যন্ত্র’ করছে বলে মনে করছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। একই সঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, নির্বাচন প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো এখনো সরকারের প্রতি আস্থা রাখতে পারছে না। এরই মধ্যে এসেছে নির্বাচন পদ্ধতির বিতর্ক। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর নির্বাচনী ব্যবস্থা নাকি সরাসরি ভোট- এ নিয়ে দলগুলোর পাল্টাপাল্টি অবস্থান এখন দৃশ্যমান।
এই প্রেক্ষিতে বিএনপি এবং এর মিত্র কিছু দল সংসদীয় আসনে সরাসরি ভোটের বিদ্যমান ব্যবস্থার পক্ষেই রয়েছে। কিন্তু জামায়াতসহ ইসলামপন্থি বিভিন্ন দল ও কিছু বামপন্থি দলও সংখ্যানুপাতিক হারে ভোট এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিকে সামনে এনেছে। আর এমন প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের অবস্থান এখনো অস্পষ্ট। একইসঙ্গে দলগুলোর মতপার্থক্য বা পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কারণে রাজনীতিতে অস্থিরতা এবং নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে।
এদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গত ২০ জুলাই একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো একটি অংশের সহায়তায় দেশে কেউ উদ্দেশ্যমূলক পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছে কি না। একই সঙ্গে সরকারের প্রতিশ্রুত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে কেউ সময়ক্ষেপণ করতে চাইছে কি না সে বিষয়ে সবাইকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার আহ্বান জানান তিনি। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের এমন বক্তব্যের পর অস্বস্তিতে রয়েছে নেতাকর্মীরা। প্রধান উপদেষ্টার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে মাঠে নামার কথা ভাবছে বিএনপি।
দলটির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দাবিতে আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে মাসব্যাপী কর্মসূচির একটি খসড়া রূপরেখা তৈরি করতে যাচ্ছে বিএনপি। এতে রোড মার্চ, বিভাগীয় সমাবেশ, আসনভিত্তিক পদযাত্রাসহ একগুচ্ছ কর্মসূচির প্রস্তাবে আছে। আর এমন প্রেক্ষাপটে দলটি নতুন রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। কর্মসূচি দিয়ে চাপে রাখার এই কৌশলের অন্যতম বলে জানান নেতারা।
নির্বাচন ও কর্মসূচি প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন ছাড়া আর কোনো পথ নেই। সংস্কারের, ঐক্যমতের কথা বলা হচ্ছে, সব ঠিক আছে। তবে এর বাইরে সময় নষ্ট না করে, লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে ড. ইউনূসের যে বৈঠক হয়েছে, সেটি অনুযায়ী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের মালিকানা তাদের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। এর বাইরে আর কোনো পথ নেই।
বিএনপির এই নেতা আরো বলেন, দেশের মানুষ একটি স্থিতিশীল, সহনশীল বাংলাদেশ চায়, পরস্পর সম্মানবোধের জায়গায় যেতে চায়।
দেশের মানুষ একটা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ চায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষের সাংবিধানিক, রাজনৈতিক, গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পেতে চায়। সুতরাং একটাই পথ, দ্বিতীয় আর কোনো পথ নেই, দেশের মালিকের ভোটে নির্বাচিত সংসদ ও সরকার, এর কোনো ব্যতিক্রম নেই।
বিএনপি সূত্র জানায়, আাগামী তিন মাসে কর্মসূচি বাস্তবায়নে মাঠে যারা মাঠে থাকবেন তাদের নিয়ে গত সপ্তাহ একটি বৈঠক করে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
বৈঠক সূত্র জানায়, প্রতিটি আসনে দলের একাধিক নেতা মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে মাঠে কাজ শুরু করেছেন। এ নিয়ে নেতাদের মধ্যে নির্বাচনী এলাকায় দলে বিভক্তি দূর করতে এবং দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাদের একই প্লাটফর্মে থেকে দলীয় কর্মসূচি পালনের পক্ষে মতামত দেন নেতারা। তফসিল ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত রাখতে বলা হয়। পাশাপাশি দলীয় সিদ্ধান্ত যারা না মানবেন তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিকভাবে আরো কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণেরও মতামত দেন তারা। সভায় বিভাগীয় সাংগঠনিক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদকরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নেতা বলেন, নির্বাচনের দাবিতে মাঠের কর্মসূচি জোরদার করার সুপারিশ করা হয়েছে।
বৈঠকে উপস্থিত একজন নেতা বলেন, দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নেতাদের মতামত শোনেন। সাধারণ মানুষ কী মনে করছে, নির্বাচন নিয়ে তাদের ভাবনা কী এবং এখন বিএনপির করণীয় কী এসব বিষয়ে তারেক রহমানের জিজ্ঞাসার জবাব ও সুপারিশ তুলে ধরেন নেতারা। বেশির ভাগ নেতা মনে করেন, নির্বাচন নিয়ে তাদের সুস্পষ্ট কর্মসূচি থাকা উচিত। কারণ জনগণের মাঝে এত দিন নির্বাচন নিয়ে দোলাচল থাকলেও এখন সবাই অনুধাবন করছেন, অনির্বাচিত সরকার সঠিকভাবে দেশ চালাতে পারছে না।
জানা গেছে, প্রস্তাবগুলো নিয়ে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে সাংগঠনিক টিমের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের আবারও বৈঠক করার কথা রয়েছে। ওই বৈঠকে দলের কর্মসূচি আরো সুনির্দিষ্ট করে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সামনে তুলে ধরা হবে। পরে তা দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে।
Comments