
বাংলাদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর মার্কিন ক্রেতারা নতুন অর্ডার নিয়ে আলোচনা প্রায় স্থগিত করে দিয়েছে। একইসঙ্গে ইতিমধ্যে যেসব পণ্যের চালান পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে, সেগুলোর ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ হলে বাড়তি খরচের একাংশ বাংলাদেশি সরবরাহকারীদেরকে ভাগ করে নিতে বলছে তারা।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কছাড়ের বিষয়ে অনুষ্ঠিত আলোচনায় কিছু বিষয়ের মীমাংসা হয়নি এখনো। তিনদিনের বৈঠক শেষে দুই দেশ কিছু বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছালেও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একমত হতে পারেনি। এ কারণে শুল্কছাড়ের বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে আবারো বৈঠক হবে বলে জানিয়েছে ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস।
রপ্তানিকারকরা বলেছেন, আগামী ১লা আগস্ট থেকে এই নতুন শুল্ক কার্যকর হওয়ার কথা। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে আগের প্রায় ১৬ শতাংশ ও নতুন ৩৫ শতাংশ শুল্কসহ বেশির ভাগ বাংলাদেশি পণ্যের ওপর মোট শুল্কের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৫১ শতাংশ। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের ৮.৪ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি বাজার, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে। একক রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৮৭০ কোটি ডলারের পণ্য। মোট রপ্তানির মধ্যে পোশাক ৮৫ শতাংশ। পোশাকের মোট রপ্তানির ২০ থেকে ২২ শতাংশের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। এ কারণেই রপ্তানিকারকদের উদ্বেগ বেশি। বিশেষ করে যেসব পণ্যের অর্ডার দেয়া হয়ে গেছে কিন্তু এখনো পাঠানো হয়নি, সেগুলোর খরচ ভাগাভাগি নিয়ে ক্রেতারা নতুন করে আলোচনা শুরু করায় এই উদ্বেগ আরও বেড়েছে।
রপ্তানিকারকরা আশঙ্কা করছেন, দ্রুত আলোচনা করে নতুন শুল্কহার কমিয়ে আনা না গেলে দেশটিতে রপ্তানি কমতে থাকবে। ফলে এসব রপ্তানিকারক ইউরোপসহ অন্যান্য দেশের রপ্তানি বাজারে প্রবেশ করতে গেলে সেখানেও দর কমে যেতে পারে, যা সার্বিকভাবে পোশাক খাতে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে।
এদিকে, সম্প্রতি দু’দফায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০ দেশের ওপর বিভিন্ন হারে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। বাংলাদেশের পণ্যে এ যাত্রায় ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা আসে, যা আগামী ১লা আগস্ট থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। এ হার বিদ্যমান হারের অতিরিক্ত। এতে মোট শুল্ক দাঁড়াবে অন্তত ৫১ শতাংশ। গত মাসে সব দেশের ওপর আরোপিত ১০ শতাংশ বাদ না গেলে শুল্ক ৬১ শতাংশ দাঁড়াতে পারে। বাংলাদেশের মূল প্রতিযোগী চীন, ভিয়েতনাম, ভারত ও পাকিস্তানের নাম না থাকায় অসম প্রতিযোগিতার মুখে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি ব্যাপকহারে কমে যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি ওয়ালমার্ট বাংলাদেশ থেকে পণ্য নিয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি গত বৃহস্পতিবার অর্ডার বাতিল করার কথা জানিয়েছে। বিজিএমইএ’র একাধিক পরিচালক সূত্রে জানা গেছে, একটি প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। এরমধ্যে ১৫০ মিলিয়নের একটি অর্ডার বাতিল করা হয়েছে। ইতিমধ্যে এই অর্ডার ভিয়েতনামে চলে গেছে। বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম যুক্তরাষ্ট্রে ১.২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে থাকেন।
ইতিমধ্যে ৫ শতাংশ ডিসকাউন্ট শর্তের কথা জানিয়েছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তিনি এতে সম্মত হননি। তিনি জানান, এটি দিলে ব্যবসা থাকবে না। যদিও ইতিমধ্যে অমদানিকারকরা লেনদেন বন্ধ করে দিয়েছে। বিকেএমইএ’র আরেক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তার ব্যবসা ১৩০ মিলিয়ন ডলারের। ৫ শতাংশ ডিসকাউন্ট শর্তের কথা বলেছে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারক। আর তাই এই মুহূর্তে এ নিয়ে আলোচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে আছেন তিনি।
সাধারণত রপ্তানি আদেশের চুক্তির পর পণ্যের মান ও নকশায় আর কোনো পরিবর্তনের সুযোগ থাকে না। চুক্তিতে উল্লেখ করা সময়ের মধ্যে ক্রেতাদের হাতে পণ্য পৌঁছাতে আর্থিক লোকসান মেনে নিয়ে আকাশ পথে হলেও পণ্য পৌঁছে দিতে বাধ্য হন রপ্তানিকারকরা। অথচ রাজনৈতিক অস্থিরতা, শ্রম অসন্তোষ, করোনার মতো দুর্যোগ পরিস্থিতিতে দর কমাতে নানা ধরনের অনৈতিক বাণিজ্য চর্চা করে থাকে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো।
অনন্ত গার্মেন্টস লিমিটেডের মোট রপ্তানির ২০ শতাংশের বেশি যায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইনামুল হক খান বাবলু বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের মিটিং হয়েছে। তারা পাইপলাইনে থাকা অর্ডারে ট্যারিফের কারণে বাড়তি টাকার একটি অংশ বহন করার জন্য আমাদের বলছে। তিনি বলেন, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের জন্য পাইপলাইনে থাকা মোট ক্রয়াদেশের পরিমাণ ২ বিলিয়ন ডলারের মতো হতে পারে।
আরেক শীর্ষস্থানীয় পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান স্নোটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম খালেদ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সক্ষমতার তফাত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, মার্কিন ক্রেতারা বলছে, বাংলাদেশে ভিয়েতনামের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি ট্যারিফ, কীভাবে অর্ডার প্লেস করবো? উল্লেখ্য, ভিয়েতনামের পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক চূড়ান্ত করা হয়েছে।
আরেকজন রপ্তানিকারক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক ক্রেতা অর্ডার নেগোশিয়েট না করে দেশটির সরকারের সিদ্ধান্ত জানার জন্য অপেক্ষা করছিল এতদিন। এখন ওই অর্ডার নিয়ে আর নেগোসিয়েশনের সম্ভাবনা দেখছি না।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস বায়িং হাউজ এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি কাজী ইফতেখার হোসেন বলেন, বাংলাদেশের পণ্যে ভিয়েতনামের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি ট্যারিফ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করতে হয়, তাহলে এর ১০ শতাংশের মতো ভার সরবরাহকারীর ওপর সেখানকার ক্রেতারা দিতে চাইবে, এটা স্বাভাবিক।
তৈরি পোশাকের নিট খাতের রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিকেএমইএ’র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, শুল্ক এখনো কার্যকর হয়নি। চলমান আলোচনাও শেষ হয়নি। এরমধ্যেই অনেক ব্র্যান্ড-ক্রেতা দর কমানোর জন্য চাপ দিচ্ছে বলে সদস্য কারখানাগুলো বিকেএমইএ’র কাছে অভিযোগ করেছে। কোনো কোনো ক্রেতা ১ ডলার পর্যন্ত দর কম দিতে চায়। অর্থাৎ দীর্ঘদিন ধরে অনৈতিক বাণিজ্যে অভ্যস্ত মার্কিন ব্র্যান্ড ক্রেতাগুলো যেন নতুন করে একটা মওকা পেয়ে গেছে।
সারা বছর যুক্তরাষ্ট্রে একটা ক্রেতা প্রতিষ্ঠানে পণ্য সরবরাহ করে প্যাসিফিক সোয়েটার্স। কারখানাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাশেদ জানান, মার্কিন একটি বড় ব্র্যান্ডের রপ্তানি আদেশের ৬০ হাজার পিস টি-শার্টের কাজ চলছিল তার কারখানায়। নতুন শুল্কের ঘোষণা আসার পর ব্র্যান্ডটি কাজ বন্ধ রাখতে ই-মেইল করেছে। মাঝপথে এখন কাজ বন্ধ রাখতে হচ্ছে। মূলত তারা আগামী বৈঠকের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে।
শনিবার ওয়াশিংটন ডিসি’র বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, তিনদিনের আলোচনার পর বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এ বিষয়ে ইতিবাচক অগ্রগতি হবে বলে আশাবাদ জানিয়েছেন।
ওদিকে, ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন শুল্ক ঘোষণার পর সম্ভাব্য করণীয় নিয়ে আলোচনার জন্য প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে সময় চাওয়া হয়। বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নেগোসিয়েশনের জন্য যাতে লবিস্ট নিয়োগ দেয়া হয়, সে প্রস্তাব আমরা সরকারকে দেবো। এ ছাড়া আমাদের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি তুলে ধরে সমাধানের উপায় নিয়েও আলোচনা করতে চাই।
তৈরি পোশাকের অর্ডার বাতিল ও স্থগিত নিয়ে একটি সংবাদের বিষয়ে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, তার কাছে বা বিজিএমইএ’র কাছে এ ধরনের কোনো তথ্য কেউ দেয়নি, যাদের উদ্ধৃত করে এ ধরনের সংবাদ ছাপা হয়েছে, তারাও কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি।
ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, যদি ৩৫ শতাংশ শুল্ক বহাল থাকে, তাহলে সত্যিই টিকে থাকা কঠিন হবে। বর্তমানে যে পরিমাণ ক্রয়াদেশ পাওয়া যাচ্ছে, তা আর থাকবে না। এখন সরকারকেই করণীয় কার্য ঠিক করতে হবে বলে জানান তিনি।
এদিকে, শনিবার রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, বিশ্বখ্যাত ওয়ালমার্ট বাংলাদেশের পোশাকের কিছু ক্রয়াদেশ পিছিয়ে দিয়েছে, কিছু ক্রয়াদেশ স্থগিত করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের পণ্যে, বিশেষ করে তৈরি পোশাকে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার ঘোষণা দেয়ায় এমন ঘটনা ঘটলো।
রয়টার্স বলছে, প্যাট্রিয়ট ইকো অ্যাপারেল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইকবাল হোসেন জানান, যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত শুল্কের কারণে ওয়ালমার্টের জন্য প্রায় ১০ লাখ সাঁতারের পোশাকের একটি ক্রয়াদেশ গত বৃহস্পতিবার স্থগিত করা হয়েছে। রয়টার্সের পক্ষ থেকে ওয়ালমার্টের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো উত্তর দেয়নি তারা।
Comments