
৭ বছর পেরিয়ে গেলেও মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার চান্দহরে ধলেশ্বরী শাখা নদীর ওপর নির্মানাধীন ব্রীজের কাজ সম্পন্ন হয়নি। ইতিমধ্যেই তিন দফা বাড়ানো হয়েছে কাজের মেয়াদ। পরিবর্তন করা হয়েছে একাধিক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। সর্বশেষ কাজ পাওয়া ফরিদপুর জান্নাত কনস্ট্রাকশন লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানটিরও কাজের মেয়াদ শেষ হয়েছে চলতি বছরের জানুয়ারিতে। মেয়াদ না বাড়িয়েই চলছে ব্রীজের নির্মাণ কাজ। দীর্ঘদিনেও সেতুটির কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন নদীপাড়ের জনসাধারণ।
এদিকে, ব্রীজটির পিসি গার্ডার নির্মাণে ব্যবহার করা হচ্ছে নিম্নমানের রেডিমিক্স। ঈদুল আজহা উপলক্ষে সরকারি ছুটির দিনেই গত ৯ জুন ব্রীজে বসানো হয়েছে ৪টি পিসি গার্ডার। কাজের মান ও কর্তৃপক্ষের তদারকি নিয়েও ওঠেছে নানা প্রশ্ন।
সরেজমিন রোববার (১৫ জুন) স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৩১৫ মিটার দৈর্ঘ্য এ সেতুটির কাজে নিম্নমানের রেডিমিক্স ব্যবহারের কারণে গেল বছরের মে মাসে একটি পিসি গার্ডার ওপরে উঠানোর আগে নির্মাণাধীন অবস্থাতেই ভেঙে যায়। বর্তমান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জান্নাত কনস্ট্রাকশন লিমিটেড ইতিমধ্যেই ৪টি পিসি গার্ডার উত্তোলনের কাজ সম্পন্ন করেছে। যার গুণগত মান নিয়েও গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন অনেকেই। ওই গার্ডার নির্মাণে অজ্ঞাত কারণে সেতুস্থলে মিক্সিং প্লান্ট না করে অন্য জায়গা থেকে রেডিমিক্স এনে কাজ করায় নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠেছে। যেখানে কর্তৃপক্ষের যোগসাজশকেই দায়ী করেছে স্থানীয় বাসিন্দারা।
জানা গেছে, সরকারি অর্থায়ন ও সিংগাইর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের বাস্তবায়নে "পল্লী সড়কের গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মাণ শীর্ষক প্রকল্পের" আওতায় ২০১৮ সালের ৩০ জানুয়ারি চান্দহর নদীর ওপর ব্রীজের কাজ শুরু করে মেসার্স নাভানা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। ৩৪ কোটি ৮৬ লাখ ৩৩ হাজার ৫৩০ টাকা ব্যয়ে ব্রীজটির কাজ দু'বছর মেয়াদে ২০২০ সালের ২৯ জানুয়ারি শেষ হওয়ার কথা ছিল। কর্তৃপক্ষ দু'দফা মেয়াদ বাড়ালেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি ২০২১ সালের ৩০ জুন কাজ বাকি রেখে সটকে পড়ে। পরে ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে দরপত্র আহবান করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। নতুন করে কাজ পায় ফরিদপুর জান্নাত কনস্ট্রাকশন নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এতে নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় প্রায় সাড়ে ৩৪ কোটি টাকা। কার্যাদেশ মোতাবেক ২০২৩ সালের ২০ জানুয়ারি থেকে শুরু করে ২০২৫ সালের ১৯ জানুয়ারি কাজ শেষ করার কথা ছিল।
নির্ধারিত সময়ের পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও কর্তৃপক্ষের গাফলতিতে কাজের কাজ হয়নি কিছুই। নিয়ম বহির্ভূতভাবে মেয়াদ না বাড়িয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চালু রেখেছে নির্মাণ কাজ। ২৮ টি পিসি গার্ডারের মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে মাত্র চারটি। এর মধ্যে অন্য জায়গা থেকে নিম্নমানের রেডিমিক্স ব্যবহার করায় ৫টি পিসি গার্ডারের মধ্যে ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে ৪৫ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২০ টন ওজনের ৪ নং গার্ডারটি উপরে ওঠানোর আগেই নির্মাণাধীন অবস্থাতেই ভেঙে যায়। এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফলাও করে সংবাদ প্রকাশিত হয়। তারপরেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অন্য জায়গা থেকে সরবরাহকৃত রেডিমিক্স দিয়েই কাজ করায় এলাকাবাসী ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে নানা সমালোচনা। উত্তোলনকৃত ৪ টি পিসি গার্ডারের মান নিয়েওঠেছে নানা প্রশ্ন। ব্রীজটি পুরোদমে চালু হলে ওই পিসি গার্ডার ভেঙে সম্পদসহ প্রাণহানির আশংকা করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
এদিকে, বৃহৎ এ প্রকল্পটিতে উপজেলা এলজিইডি অফিসের মো. নজরুল ইসলাম নামের এক উপ-সহকারী প্রকৌশলী তদারকি কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন। একই কর্মস্থলে থেকে তিনি গত ৫ বছর যাবত এ সেতুটির কাজ তদারকি করছেন বলে জানা গেছে। সেতুর নির্মাণ কাজে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আর্থিক সুবিধা নেয়ার বিষয়টি নিয়েও চলছে আলোচনা।
জেলা বিএনপি'র আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও সিংগাইর উপজেলা বিএনপি'র সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ওই এলাকার বাসিন্দা মো. আমজাদ হোসেন বলেন, বাইরে থেকে নিম্নমানের রেডিমিক্স এনে ঢালাইয়ের কাজ করায় গত বছর একটি পিসি গার্ডার ভেঙে যায়। ইদানিং বাকি চারটি গার্ডার উঠানো হলেও বেশী লোডে ব্রীজে যখন গাড়ী চলবে তখন ভেঙ্গে পড়ার একটু ঝুঁকি থাকে।এ ছাড়া আগের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মতো সেতুর আশপাশে মিক্সিং প্লান্ট তৈরী করে পিসি গার্ডারসহ অন্যান্য নির্মাণ কাজ স্বচ্ছভাবে করারও দাবী জানান তিনি।
এ প্রসঙ্গে সেতু নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ফরিদপুর জান্নাত কনস্ট্রাকশন লিমিটেড এবং দি নির্মিতি( জেএন) জেভি'র প্রজেক্ট ম্যানেজার ইঞ্জিনিয়ার মো. সাজিদুল ইসলাম চারটি পিসি গার্ডার তৈরীতে অন্য জায়গা থেকে রেডিমিক্স এনে ব্যবহারের কথা স্বীকার করেন এবং অবশিষ্ট ২৪ টি গার্ডারের কাজ সেতু নির্মাণস্থলেই মিক্সিং প্লান্ট করার পরিকল্পনা রয়েছে। সেই সঙ্গে তিনি কাজের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছেন বলেও জানান এবং উত্তোলনকৃত পিসি গার্ডারের গুনগত মান ভাল বলেও দাবী করেন তিনি।
সেতুটির তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সিংগাইর এলজিইডি'র উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো.নজরুল ইসলাম বলেন, মেয়াদ এক্সটেনশনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। সামনের কাজগুলো স্টেইজিং করে করা হবে। কাজ ভাল করার স্বার্থে রেডিমিক্স বাইরে থেকে আনতেও পারি আবার নাও আনতে পারি।
সিংগাইর উপজেলা প্রকৌশলী মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, সেতুস্থলে রেডিমিক্স প্লান্ট ধরা নাই। যেখান থেকে এনে কাজ করা হচ্ছে ওগুলোর মান ভাল এবং সময়ও কম লাগে। পিসি গার্ডার ভেঙে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওটা আমাদের বিষয় না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জানে। হয়তো কিউরিং ভাল ছিল না যারজন্য এমনটি হয়েছিল।
এ ব্যাপারে প্রজেক্ট কনসালট্যান্ট ও মানিকগঞ্জ এলজিইডি'র ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ার সাইদ উজ্জামান বলেন,পাঁচটি পিসি গার্ডারের মধ্যে ত্রুটিপূর্ণ গার্ডারটি গত বছর টেনশনিংয়ের সময় ভেঙে যায়। বাকিগুলো গেল ঈদুল আজহার পরে উঠানো হয়েছে, ওগুলোর কোনো ঝুঁকি নাই। পরবর্তীতে যে গার্ডারগুলো তৈরি করা হবে সেতু স্থলেই ঢালাইর ব্যবস্থা করা হবে।
Comments