
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এম এ মালেক। দীর্ঘ তিন যুগের বেশি সময় ধরে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, স্বপরিবার নিয়ে থাকেন যুক্তরাজ্যে। বর্তমান সময়ে বিএনপিতে বেশ আলোচিত নেতা। গত ৬ মে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সফর সঙ্গেী হিসেবে লন্ডন থেকে দেশে আসেন। উঠেছেন রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশেফরাসহ নানা প্রসঙ্গে কথা বলেন দৈনিক মানবকণ্ঠের সঙ্গে। রোববার সকালে রাজধানীর গুলশান ওয়েস্টিন হোটেলে তার সাক্ষাতার গ্রহণ করেছেন মানবকণ্ঠের সিনিয়র রির্পোটার ছলিম উল্লাহ মেজবাহ।
মানবকণ্ঠ: তারেক রহমান কবে দেশে ফিরবেন।
এম এ মালেক: তারেক রহমান বাংলাদেশে আসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দেশে আসবেন, উনার তো বাড়ি নেই, বাড়ি ভাড়া করতে হবে, যেদিন বাসা পাবেন বা ঠিক হবে তারপর দেশে আসবেন। যদি বাসা না পাই তাহলে আমার বোনের (ডা. জোবাইদার) বাড়িতে থাকতে হবে। বর্তমানে ঢাকা শহরে তারেক রহমানের কোন ঠিকানা নেই। বাড়ি ভাড়া সম্পন্ন হলে তিনি আসবেন। এছাড়া আইনের বিষয় আছে, উনার নিরাপত্তার বিষয় আছে, সব কিছু বিবেচনা করে শিগগিরই তিনি দেশে ফিরবেন। এ ব্যাপারে সব প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছে।
মানবকণ্ঠ: আওয়ামী লীগের রাজনীতি কার্যক্রম বন্ধে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
এম এ মালেক: গত ৫ আগষ্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল, শ্রমিকদলসহ সারাদেশে ৫শ’ নেতাকর্মী শহীদ হয়েছেন। তাদের হত্যা করেছে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট পুলিশ ও ছাত্রলীগ, যুবলীগ আওয়ামীলীগের সন্ত্রাসীরা।একই সাথে আন্দোলনে যত লোক মারা গেছে প্রত্যেককে ক্ষতিপূরন দেয়ার দাবি জানাই। বর্তমান অন্তবর্তী সরকার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে। এটি একটি উত্তম কাজ করেছে। আমি সাধুবাদ জানাই।
মানবকণ্ঠ: প্রায় ন’মাস আড়ালে থেকে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ দেশ ছাড়লেন। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
এম এ মালেক: সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদকে যারা বিদেশে পালানোর সুযোগ করে দিয়েছে, তাদের বিচার ও শাস্তি চাই, এখানে টাকার খেলা হয়েছে। এবিষয়ে ছাড় দেয়া যাবে না।
মানবকণ্ঠ: নির্বাচন এবং সংষ্কার নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে, নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়েও সময় ক্ষেপনের কথা তুলছে আপনার দল। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
এম এ মালেক: নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে। সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া। আমার দল বারবার বলে আসছে দীর্ঘকাল সংস্কার চলতে পারে না। আমরা প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দেয়ার কথা বলে আসছি।
মানবকণ্ঠ: যুক্তরাজ্যে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবীতে আপনার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক আন্দোলনে বৈরি পরিস্থিতির মোকাবেলা করলেন কী ভাবে?
এম এ মালেক: যুক্তরাজ্যে শেখ হাসিনার গুম খুন হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে বহুবার হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছি। আমাকে রাশিয়ান হিটম্যান দিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিল। যুক্তরাজ্যের পুলিশ দিয়েও চেষ্টা করা হয়েছে আমাকে হত্যা করার জন্য।
মানবকণ্ঠ: বিএনপি চেয়ারপার্সন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের ঘনিষ্ঠ থেকে রাজনীতি করছেন, খুব কাছ থেকে দেখেছেন দীর্ঘদিন। দলনেতা হিসেবে তাদের কীভাবে মূল্যায়ন করবেন।
এম এ মালেক: বেগম খালেদা জিয়া আমার মা, উনি কথায় কাজে মিল রেখেছেন, তিনি বলছেন বাংলাদেশের বাইরে আমার কোন ঠিকানা নেই, এদেশের মাটি ও মানুষ হচ্ছে আমার আসল ঠিকানা। তাই তিনি দেশের বাইরে থাকেননি। দেশেই ফিরে এসেছেন। বারবার তিনি তার কাজে প্রমাণ করেছেন তিনি আপোসহীন। ম্যাডাম খালেদা জিয়াকে সঙ্গে নিয়ে একই বিমানে আমি ও আমার পরিবারসহ দেশে এসেছি তার সফরসঙ্গী হিসেবে। জীবন স্বার্থক মনে হয়। এর থেকে আর বড় পাওয়া কি হতে পারে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের দুর্নীতি খোঁজ নিতে সারাবিশ্বে চিরুনি অভিযান করেছে বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক পলাতক অবৈধ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার বিরুদ্ধে কিছুই পায়নি। এছাড়া তারেক রহমানের বিরুদ্ধে হাওয়া ভবন নিয়ে মিথ্যাচার করছে শেখ হাসিনাসহ তার সাঙ্গপাঙ্গরা। একটা প্রমাণও করতে পারেনি। যারা অপপ্রচার করছে তাদের ট্রাইব্যুনাল করে অবশ্য বিচার করতে হবে।
মানবকণ্ঠ: আওয়ামী লীগ নেতারা দুর্নীতি করেছে, বিদেশে টাকা পাচার করেছে....
এম এ মালেক : হ্যাঁ, বিদেশে ১শ ৬২ বিলিয়ন ডলার মাফিয়া হাসিনাসহ তার নেতারা পাচার করেছে। দেশকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে ফেলেছে। এ টাকাগুলো উদ্ধারে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।
মানবকণ্ঠ: আগামীতে আপনার দল সরকার গঠন করলে ১/১১ এর মুল নায়ক মঈন ইউ আহমেদ ও ফখরুদ্দিনের কি বিচার করবে?
এম এ মালেক : ১/১১ এর সময় মঈন ও ফখররুদ্দিনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘসহ আমেরিকার তৎকালীন আন্ডার সেক্রেটারির সঙ্গে সাক্ষাত করে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছি। জেনেভা কনভেনশনে অংশ গ্রহণ করছি। ইউকেতে হাসিনা বিরোধী আন্দোলন জোরদার করেছি। আমি মনে করি বিএনপি ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিচার যেইভাবে হবে ঠিক সেইভাবে মঈন উদ্দিন ও ফখরুদ্দিনের বিচার করতে হবে।
মানবকণ্ঠ: লন্ডনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, আপনি সেখানে যাননি।
এম এ মালেক : শেখ হাসিনা ক্ষমতা থাকাকালীন লন্ডনে যখন গেলেন তখন আমাকে দাওয়াত দিয়েছেন। সেই দাওয়াতে আমি অংশ নিতে যাইনি। আমি শেখ হাসিনাকে বলেছিলাম আগে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে রিলিজ দিতে হবে চিকিৎসার জন্য। খালেদা জিয়াকে হত্যার জন্য পরিকল্পনা করেছেন শেখ হাসিনা। সেøা পয়জন দিয়ে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। এই জন্য হাসিনা যখন যুক্তরাজ্য যায়, তখন লন্ডনে হাসিনাকে অবরোধ করছি। গত ১৬ বছর ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে আমি আন্দোলন করেছি। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও করেছি হাসিনাকে রিজাইন করার জন্য। বৃটিশ পার্লামেন্ট, ইউরোপীয় ইউনিয়নকে বলেছি বাংলাদেশ থেকে ফ্যাসিস্ট হটাও। বিগত দিনে লন্ডনে লক্ষ লক্ষ মানুষকে জড়ো করে সেই দেশে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। এখন আবার শেখ হাসিনা ভারতে বসে দেশে বিশৃঙ্খলা করার চেস্টা করছে। এ ব্যাপারে দেশের সকল রাজনীতি দলগুলোকে সর্তক থাকতে হবে। সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচার করতে হবে।
মানবকণ্ঠ: আপনি কি জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিবেন?
এম এ মালেক : হ্যাঁ, আমি সিলেট-৩ (দক্ষিণ সুরমা, ফেঞ্চুগঞ্জ এবং বালাগঞ্জ উপজেলা) আসনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন চাইবো। সেজন্য কাজ করছি। আপনারা দোয়া করবেন। সোমবার (গতকাল) এলাকায় যাচ্ছি। সেখানে প্রায় এক সপ্তাহ থাকবো। তারপর ঢাকায় ফিরবো।
মানবকণ্ঠ: তারেক রহমানের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কীভাবে ?
এম এ মালেক : আমি আর মহিদুর রহমান সাহেব নামের এক ভদ্রলোক একসঙ্গে কারওয়ান বাজারে তারেক রহমানের কাছে যেতাম, তখন উনি কারওয়ান বাজারে বসতেন, তখন আমার সঙ্গে সম্পর্ক হয়। লন্ডনে যাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত এই সম্পর্ক রয়েছে। লন্ডনে বর্তমানে বিএনপির প্রেসিডেন্ট পদে রয়েছি। এর আগে সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। সেইসাথে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে রয়েছি।
মানবকণ্ঠ: রাজনীতিতে যাত্রা শুরুর সময়টা কখন?
এম এ মালেক : আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও ইয়াং মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। চাচার হাত ধরে রাজনীতিতে এসেছি। চাচা আবু মিয়া চেয়ারম্যান, তিনি আওয়ামী লীগ করতেন। উনারা লন্ডনে থাকতেন, আমাকে দেখাশোনা করেছেন। রাজনীতিতে আসতে উৎসাহ দিতেন। ছোটবেলা থেকে এলাকা আমাদের দাপট ছিল। সে জায়গায় থেকে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের পর জাসদ সমর্থক ছিলাম। তারপর ১৯৭৬ সালে জাতীয় তরুণ সংঘের মাধ্যমে সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতাম। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং বি. চৌধুরী দল গঠন করলেন। ১৯৭৭ সালে ধানমন্ডিতে তখন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাত করি। জিয়াউর রহমান একটি সম্মেলনে ভাষন দেন। সেই অনুষ্ঠানে আমিও বক্তব্য রাখি, এক মিনিট। কিন্তু বক্তব্য দেয়ার কথা ছিল তিন মিনিট। আমি নার্ভাস হয়ে বক্তব্য শেষ করি। পরে তৎকালীন যুব রাজনীতির নেতা মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বর রায় ও হারিছ আহমদ এর মাধ্যমে বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হই।
মানবকণ্ঠ: প্রায় চারদশক কাটিয়ে দিলেন প্রবাসে, লন্ডনে। কৈশোর, তারুণ্যর সময় কতটা উপভোগ্য ছিল?
এম এ মালেক : ১৯৮১ সালে লন্ডনে বাবা-চাচাদের সঙ্গে পার্টটাইম ব্যবসা করেছি। সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলের মার্শাল ল’ এর সময় সিলেটে তখন দায়িত্বশীল সেনা কর্মকর্তা আমিন আহমেদ চৌধুরী, কর্নেল দেওয়ান লন্ডনে যাওয়ার জন্য সহযোগিতা করেন। আমার বাবা লন্ডনে একজন ফ্যাক্টারির ওয়ার্কার ছিল। আমার বড় ভাই ব্যবসা করত। আমি রেস্টেুরেন্টে কাজ করেছি। এরপর লন্ডনে এলাকার দূর সর্ম্পকের চাচাতো বোনের সঙ্গে বিয়ে হয়। স্ত্রী ছিলেন তরুণ শিক্ষক। তখন এরশাদের বির’দ্ধে লন্ডনে সভা সেমিনার করেন টনবি হলে। ৭ দলের নেতৃত্বে এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার করা হয়। ধানমন্ডি বিএনপির অফিস থাকাকালীন তৎকালীন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত করেন। এরশাদ বিরোধী আন্দোলন জোরদার করার জন্য তখন ম্যাডাম দিক নির্দেশনা দেন। লন্ডনে সেটেল্ডে হওয়ার পর একাধিক মামলা হয়েছে আমার বিরুদ্ধে। রাজনীতির পাশাপাশি সংস্কৃতি মনা ছিলাম। ছবি প্রডিউস করেছি। ছবির নাম যেই প্রেম কথা কয়, ছবির নায়ক ছিলেন প্রবীর মিত্র ও নায়িকা ছিলেন শাবানা। এছাড়া নাটকেও অভিনয় করেছি মাঝেমধ্যে। একটা নাটকের নাম মনে করতে পারছি, বিলাতে বিলাস। আমার দুই ছেলে এক মেয়ে।
মানবকণ্ঠ: আপনাকে ধন্যবাদ
এম এ মালেক: আপনাকেও ধন্যবাদ।
Comments