
উন্নত চিকিৎসার জন্য মঙ্গলবার বিদেশে যাচ্ছেন বিএনপি চেয়ারম্যান খালেদা জিয়া। কিন্তু দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে কবে দেশে ফিরবেন কবে এ নিয়ে এখনো রয়ে গেছে ধোঁয়াশা। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের সময় নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাথে বিএনপির বেশ ভালোরকম টানাপোড়েনই চলছে। এসময় তারেক রহমানকে মানসিক চাপে রাখার অস্ত্রও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে আছে। সেই অস্ত্র হচ্ছে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা বিভিন্ন সময়ের মামলা।
বিএনপি চেয়ারম্যানের এই সময়ে বিদেশ যাত্রা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে উঠছে নানা প্রশ্ন। অনেকই প্রশ্ন রাখছেন, স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতনের পরও তিনি চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতে চার মাস কেন সময় নিলেন? তবে গত ২ জানুয়ারি রাতে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সস্ত্রীক খালেদা জিয়াকে তার গুলশানের বাসভবনে দেখতে গেলে তখনই বলা হয় যে, খালেদা জিয়া দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য যাবেন। সে কারণেই সেনাপ্রধান খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে যান। সেনাপ্রধান ৪০ মিনিটের মতো সেখানে ছিলেন। তবে চিকিৎসার খোঁজ খবর নেওয়া ছাড়া আর কিছুই তখন জানানো হয়নি বিএনপির পক্ষ থেকে।
এ বিষয়ে বিএনপি আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, খালেদা জিয়া সব মামলায় হয় খালাস পেয়েছেন, নয় জামিনে আছেন। চিকিৎসা শেষে তার দেশে ফিরতে আইনগত কোনো বাধা নাই। তিনি চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে আসবেন। তারেক রহমান সাহেবের মামলাগুলো আমরা আইনগতভাবেই মোকাবিলা করছি। তিনি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। দেশে আসার বিষয়ে তিনি যথা সময়ে পদক্ষেপ নেবেন।
সিনিয়র সাংবাদিক আশরাফ কায়সার মনে করেন, খালেদা জিয়া দেশে আবার ফিরতে পারবেন এই নিশ্চয়তাই হয়তো পেয়েছেন সেনাপ্রধানের কাছ থেকে। যার ফলে তিনি এখন চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাচ্ছেন।
কিন্তু আরেকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, আসলে দেশের সার্বিক পরিস্থিতিই এখন অনিশ্চিত। ফলে চিকিৎসা শেষে তিনি দেশে ফিরতে পারবেন কী না তা এখনই মনে হয় বলা যাচ্ছে না। তবে চিকিৎসা শেষে খালেদা জিয়ার দেশে ফিরতে আইনগত কোনো বাধা নেই।
অন্যদিকে খালেদা জিয়া ফিরলে তারেক রহমানকে সঙ্গে নিয়ে ফিরবেন কি না তা নিয়ে আছে আলোচনা। কিন্তু তাতে অনেকটা পানি ঢেলে দিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ। তিনি সোমবার লন্ডন থেকে ফিরে সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অবশ্যই দেশে ফিরবেন। তবে তারেক রহমানের দেশে ফেরার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ আমরা এখনো সৃষ্টি করতে পারিনি। সে জন্য অল্প কিছু সময় লাগবে। তবে সেই পরিবেশের কোনো ব্যাখ্যা দেননি তিনি।
আর যুক্তরাজ্য বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কয়ছর এম আহমেদ জার্মান গণমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে বলেন, আমরা এখন ম্যাডাম খালেদা জিয়ার চিকিৎসাকেই প্রাধান্য দিচ্ছি। আমাদের সব মনোযোগ সেদিকে৷ তিনি সুস্থ হওয়ার পর কবে দেশে ফিরবেন। তারেক রহমান সাহেব তার সঙ্গে ফিরবেন কিনা এসব নিয়ে এখন আমরা ভাবছি না৷ তাকে এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি হাসপাতালে নেওয়া হবে। তারেক রহমান তাকে রিসিভ করবেন।
বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, খালেদা জিয়া সব মামলায় হয় খালাস পেয়েছেন, নয় জামিনে আছেন। চিকিৎসা শেষে তার দেশে ফিরতে আইনগত কোনো বাধা নাই। তিনি চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে আসবেন। আর তারেক রহমান সাহেবের মামলাগুলো আমরা আইনগতভাবেই মোকাবিলা করছি। তিনি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। দেশে আসার ব্যাপারে তিনি যথা সময়ে পদক্ষেপ নেবেন।
অন্যদিকে খালেদা জিয়া কবে দেশে ফিরবেন এই প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সেটা চিকিৎসকরাই বলতে পারবেন।
আর যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এম এ মালেক বলেন, তারেক রহমান সাহেবের মামলাগুলো তো দ্রুত নিস্পত্তি হচ্ছেনা। তার মামলাগুলোর বিরুদ্ধে সরকার বার বার আপিল করে স্লো করে দিচ্ছে। ফলে উনি চাইলেই তো এখনি ফিরতে পারছেন না। তিনি আইনি লড়াই শেষ করেই দেশে ফিরবেন৷ আর ম্যাডাম খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় কত সময় লাগে সেটা তো আমরা বলতে পারবনা। চিকিৎসা শেষ হলেই তার দেশে ফেরার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে।
অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদ বলেন, আমরা কোনো টু-মাইনাস বা থ্রি-মাইনাস থিওরিতে বিশ্বাসী নই। খালেদা জিয়ার অস্তিত্ব বাংলাদেশের মাটির সঙ্গে মিশে আছে। আমরা আশা করি তিনি চিকিৎসা নিয়ে দ্রুত সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে আসবেন৷ আর তারেক রহমান চাইলে যে কোনো সময় বাংলাদেশে আসতে পারেন৷ তার মামলাগুলো আইনি প্রক্রিয়ায় দেখা হচ্ছে। আমরা বাংলাদেশে একটি সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ চাই।
সিনিয়র সাংবাদিক আশরাফ কায়সার বলেন, তার চিকিৎসার ব্যাপারটা তো আমরা জানি৷ কিন্তু পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার এই বিদেশ যাত্রায় শঙ্কা এবং গুরুত্ব দুইটিই আছে। তবে আমার মনে হয় ভরসার জয়াগা তৈরি করেছেন সেনাপ্রধান তার সঙ্গে দেখা করে৷ রাষ্ট্রীয় অবস্থান এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তার ব্যাপারে ভিন্ন কোনো অবস্থান নেবেনা, আমার মনে হয় এ ব্যাপারে তার সঙ্গে আলোচনা হয়েছে৷ তবে মেঘ কেটে গেছে তাও আমার মনে হয়না। আসলে রাজনীতিতে তো অনেক কিছু হয়। দেখি বাতাস কোন দিকে যায়৷ আমার মনে হয় বিএনপির আশঙ্কা পুরোপুরি কেটে গেছে তা নয়।
আর অধ্যাপক হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, পুরো দেশেই তো এক ধরনের অনিশ্চয়তা চলছে। দুই মাইনাসের পর থ্রি মাইনাস, ফোর মাইনাসও শোনা যাচ্ছে৷ ফলে পরিস্থিতি কোন দিকে যায় তা এখনই বলা যাচ্ছেনা।
তিনি বলছেন, প্রধান উপদেষ্টা তো নির্বাচনের দুইটি সময়ের কথা বলেছেন। কিন্তু আমার বিবেচনায় এখনো তা সুনির্দিষ্ট নয়। ফলে দেশের পরিস্থিতি কোন দিকে যায় তার ওপর নির্ভর করছে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের দেশে ফেরা। খালেদা জিয়াকে মামলা থেকে রিলিজ দেওয়া হলেও তারেক রহমানের মামলার ব্যাপারে তো সরকার আপিল করছে।
এদিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আজ মঙ্গলবার যুক্তরাজ্যে যাচ্ছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। রাত ১০টায় ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে রওয়ানা দেবেন তিনি। কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির দেওয়া বিশেষ সুবিধা সংবলিত কাতার এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ছয় চিকিৎসক, নার্স, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ১৫ জন এই সফরে খালেদা জিয়ার সঙ্গে থাকছেন।
যুক্তরাজ্যের হিথ্রো বিমানবন্দরে খালেদা জিয়াকে অভ্যর্থনা জানাবেন বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও পুত্রবধূ ডা. জুবাইদা রহমান। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ৭ বছর পর মা ও ছেলের দেখা হচ্ছে। হিথ্রো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর সরাসরি খালেদা জিয়াকে লন্ডন ক্লিনিকে ভর্তি করা হবে।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতির মামলায় দণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয় খালেদা জিয়াকে। ২০২০ সালের মার্চে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে তৎকালীন সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে সাময়িক মুক্তি পান তিনি৷ সাময়িক কারামুক্তির পর তার পরিবার বার বার চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর আবেদন করলেও ফিরিয়ে দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। তবে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছাড়লে ৬ আগস্ট খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে দেন রাষ্ট্রপতি।
গত ৬ আগস্ট খালেদা জিয়া মুক্তি পাওয়ার দিন রাতেই খালেদা জিয়াকে নবায়নকৃত মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) দেওয়া হয়। তখন থেকেই তার বিদেশ যাওয়ায় আর কোনো বাধা ছিলেনা। ২ জুলাই তিনি হাসপাতাল ছেড়েছেন। এরপর বেশ কয়েকবার তার বিদেশ যাওয়ায়ার কথা উঠলেও তিনি যাননি। ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মেডিকেল টিম অনুমতি না দেওয়ায় তাকে দেশের বাইরে এতদিন চিকিৎসার জন্য পাঠানো সম্ভব হয়নি।
Comments