
সরকার পতনের পর প্রশাসনের অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার বড় বড় সংস্কারের দিকেও এগোচ্ছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে অগ্নিমূল্যের বাজারে এখনো কোনো সংস্কার কার্যক্রম চোখে পড়ছে না। অথচ এখানেই সংস্কারের প্রয়োজনটা অন্য সবকিছুর চেয়ে বেশি। বিগত সরকারের বিদায়ের পর কিছুদিন সিন্ডিকেটের প্রভাব না থাকার কারণে নিত্যপণ্যের দাম কিছুটা কমেছিল। কিন্তু বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার খবরে দেখা যাচ্ছে আগের সিন্ডিকেটের হাত বদল হয়ে গেছে।
বাজারে চাল, ডিম, আলু, মাছ, মাংস, ব্রয়লার মুরগি, শাক-সবজিসহ প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম আগের মতোই সিন্ডিকেটের কারণে বেড়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি চালের দাম দুই টাকা থেকে ছয় টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধিকে স্বাভাবিক বলা যায় না। চালের দাম বাড়লে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েন গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষ। তাদের আয়ের সিংহভাগই ব্যয় হয় চাল কিনতে।
খবরে বলা হচ্ছে- বিগত সরকারের আমলে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির পেছনে যে বাজার সিন্ডিকেটের কথা বলা হতো, ক্ষমতার পালাবদলের পরেও সিন্ডিকেটের সেই প্রভাব আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে বলে বিভিন্ন খবরে বলা হচ্ছে। আগের মতোই পণ্যবাহী ট্রাককে চাঁদা দিতে হচ্ছে। এতে পণ্যের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়া বাজারে পণ্য এলে কারসাজি করে মোবাইলে খুদে বার্তার মাধ্যমে সারাদেশের ব্যবসায়ীদের কাছে ইচ্ছেমতো বাড়তি দাম জানিয়ে দেয়া হয়। এসবই সিন্ডিকেটের অপতৎপরতার এক একটি অংশ।
আমদানি শুল্ক কমানোর ঘোষণাতেও বাজারে এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। বিগত সরকারের আমলে সিন্ডিকেট ভাঙার কথা বারবার পত্র-পত্রিকায় বলা হলেও সেসব খবরে কর্ণপাত করা হয়নি। সিন্ডিকেট এমন একটি জোট, যা বড় কোনো ব্যবসায়িক মুনাফা লাভ বা আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য একসঙ্গে কাজ করে। প্রশ্ন হলো- নতুন সরকার আসার পরেও সাধারণ অল্প আয়ের মানুষের সীমিত ক্রয়ক্ষমতাকে জিম্মি করে অসাধু ব্যবসায়ীরা এ ধরনের মুনাফালোভী জোট বা সিন্ডিকেট করার সুযোগ পাচ্ছে কী করে? এখন তো ব্যবসায়ীদের মদদপুষ্ট দলীয় সরকার ক্ষমতায় নেই। তাহলে এই বাজার সিন্ডিকেটের ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা কোথায়?
বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের জন্যই তো রয়েছে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৫৬। এ আইনের আওতায় যেসব পণ্য রয়েছে সেগুলোর মূল্য বৃদ্ধিতে কোনো ব্যবসায়ী যদি অতিরিক্ত মুনাফার জন্য সিন্ডিকেট করে সংকট তৈরি করে তবে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা রয়েছে সরকারের। মনে রাখতে হবে সিন্ডিকেট বহু পুরনো একটি বাজার রোগ, যার চিকিৎসা শুধু মূল্য তালিকা টাঙানো বা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের তদারকিতে হওয়া সম্ভব নয়। বিশেষ করে রমজান, কোরবানি ও পালা-পার্বণকে সামনে রেখে এদেশের অসাধু ব্যবসায়ীরা প্রতিবছর অতিরিক্ত মুনাফার লোভে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। সেই বর্ধিত দাম পরবর্তীতে বাজারে সরবরাহ বাড়লেও আর কমে না।
সদ্য বিলুপ্ত সংসদের গরিষ্ঠসংখ্যক সাংসদ ছিলেন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। এখন তাদের জায়গায় অন্য দলের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করছে বলে খবর রয়েছে। একটি নির্দলীয় সরকারের আমলে তো এটি কাম্য হতে পারে না। যদি মনে করা হয়- টিসিবির নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কার্ডধারীদের কাছে স্বল্প মূল্যে বিক্রি করতে পারলেই সিন্ডিকেটের দাপট থাকবে না, সেটি কি ঠিক?
টিসিবির পণ্য সংগ্রহকারীর লাইনও তো দিনের পর দিন দীর্ঘ হচ্ছে। রোদ-বৃষ্টিতে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়েও সবার পণ্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা মিলছে না। এভাবে প্রয়োজনের তুলনায় কম মূল্যের অপর্যাপ্ত পণ্য সরবরাহ করা বা মাঝেমধ্যে টিসিবির চোরাই পণ্য উদ্ধার করা বা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে জরিমানা আদায় করা এসব কর্মকাণ্ড বাজারের আগুন নিয়ন্ত্রণ বা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ কোনোটার জন্যই যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন বাজার বিশেষজ্ঞগণ।
বিশেষত সিন্ডিকেটের মূলোৎপাটনের জন্য দরকার একটি টেকসই ব্যবস্থা। মনে রাখতে হবে বাজার সিন্ডিকেটের শেকড় অনেক গভীরে। সাম্প্রতিক এক খবরে বলা হয়েছে- কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সভাপতি বলেছেন, বাজার মূল্যের সাথে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা একযোগে কাজ না করলে বাজারের বর্তমান অগ্নিমূল্যে কোনো পরিবর্তন আসবে না। তবে একসঙ্গে কাজ করার আগে সিন্ডিকেটের ধরন, তার কলাকৌশল বা কারসাজি সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহে থাকাটা জরুরি।
এক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত বাণিজ্য উপদেষ্টা দেশের বাজারে যেসব অনিয়ম, মজুতদারি, একচেটিয়া কারবারি এবং বাজারকে অস্থিতিশীল করার মতো নেপথ্য শক্তি-অপশক্তি ক্রিয়াশীল রয়েছে সেগুলোকে আগে চিহ্নিত করার কাজটি করতে পারেন। সেটি শুধু কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে বৈঠক করলে হবে না। প্রতিটি নিত্যপণ্যের চাহিদা ও সরবরাহ নিয়ে কে কোথায় কীভাবে কারসাজি করছে, গুদামজাত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে সেসব ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক তথ্যানুসন্ধান দরকার। এজন্য নানা সরকারি-বেসরকারি সংস্থা থাকলেও সেগুলোর জনবল কম থাকায় তাদের দ্বারা কাক্সিক্ষত জরিপ সম্ভব হয় না।
এজন্য তাদেরসহ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুলসংখ্যক শিক্ষক শিক্ষার্থীদের খণ্ডকালীনভাবে ও সমন্বিত উদ্যোগে মাঠ জরিপের কাজে লাগানো হলে এমন অনেক গোপন তথ্যই উঠে আসতে পারে যেগুলোতে হাত না দেয়া পর্যন্ত ওইসব পণ্যের সরবরাহ ও চাহিদার প্রকৃত তথ্য জানা সম্ভব হবে না। শুধু এডহক ভিত্তিতে কোনো ব্যবস্থার দাওয়াই দিয়ে বাজার সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব নয় বলে বিশেষজ্ঞ মহলের অভিমত। পাশাপাশি প্রতিবেশী ভারতে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের অভিজ্ঞতাটিও বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়- ভারতে দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ হচ্ছে- ভারতে গোটা বাজার ব্যবস্থা কয়েক যুগ ধরে বিশেষ একটি কমিশন দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে। প্রত্যেক ব্যবসায়ী কমিশনের আইন নিয়ম-কানুন মেনে ব্যবসা করতে বাধ্য হয়। কোনো পণ্যের দাম ব্যবসায়ী ইচ্ছে করলেই বৃদ্ধি করতে পারে না, মজুতদারিও করতে পারে না। প্রত্যেক পণ্যের দাম কমিশন যেভাবে নির্ধারণ করবে তাতে খুচরা পর্যায় পর্যন্ত সকলেরই লাভের অংশ নির্ধারিত থাকে। কারোরই লোকসান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
আমাদের দেশেও বাজার নিয়ন্ত্রণের সব প্রতিষ্ঠানকে একীভূত করে এ ধরনের শক্তিশালী একটি বাজার কমিশন গঠন করা যেতে পারে, যার মাধ্যমেও সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব বিলীন ও বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে স্থিতিশীল হতে পারে। আর নিত্যপণ্যের সহনীয় মূল্যই পারে মানুষকে স্বস্তি দিতে, অন্য কিছুতে নয়।
লেখক: কবি, কথাশিল্পী ও কলামিস্ট।
মানবকণ্ঠ/এফআই
Comments