Image description

শিক্ষক ছাত্রদের জীবনে বড় বন্ধু, পথ প্রদর্শক, আধ্যাত্মিক বিকাশের গুরু। শিক্ষককে যেমন দিতে হবে পুঁথিগত শিক্ষা, সঙ্গে সঙ্গে চলে অন্তর্মুখীন জাগরণের জন্য আধ্যাত্মিক শিক্ষা, দেখিয়ে দিতে হয় সত্যিকারের পথ চলার উপায়। কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশ শিক্ষকের মধ্যে এ গুণগুলো বিকশিত হতে দেখা যায় না। 

আমাদের শিক্ষা বিভাগ শিক্ষক নিযুক্তি দেয় তাদের পরীক্ষার নম্বর দেখে। কে ক’টা লেটার পেয়েছিলেন, কে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিলেন ইত্যাদি দেখে নিযুক্তি চলে। এরা ভালো নম্বরের ভিত্তিতে চাকরি পেয়ে গেলেও শিক্ষার ত্রুটি বিচ্যুতি সম্বন্ধে তেমন বিচারবুদ্ধি এদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না। তবে অভিভাবকরা এদের উপর খুশি থাকেন এ কারণে যে তারা পরীক্ষার ফল কিভাবে ভালো করা যায় তারা তা খুব ভালো করেই জানেন। তাই আজকাল দেখা যায় গাদা গাদা এ প্লাস, এ মাইনাস এর ছড়াছড়ি। কিন্তু ছাত্র সমাজের ভেতর অন্তঃসার শূন্য।

আজকাল যারা প্রাইভেট টিউটোরিয়াল ক্লাসে পড়ছে তারা ভালো ফল করছে। সেখানে শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে একটি ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাতে শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে যে অন্তরের টান সৃষ্টি হওয়ার কথা তা ততটা হয়ে ওঠে না। এরা পড়াশোনায় ভালো ছিলেন বলে এবং ভালো ফল করার কৌশল জানেন বলে সে রকম নোট দিয়ে থাকেন। ছাত্ররা তা গিলে প্রয়োজনে ব্রেন ডোপিং খেয়ে ক্লান্তিহীন রাত জেগে পড়ে পরীক্ষার খাতায় তা বমি করে দিয়ে নানা দায় থেকে মুক্তি পায়। আর ভালো ফল করায় তাদের রোজগারের একটা পথও হয়ে যায়। 

কিন্তু যে নীতিবোধ বা মূল্যবোধ শিক্ষার সময়ে ছাত্রজীবন তা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। তাই আজ অবক্ষয়িত সমাজের সৃষ্টি হয়েছে। অল্প বয়সে বন্ধুকে ছাত্রাবস্থায় খুন করতে দ্বিধাবোধ করছে না। রাত জেগে বাড়ি ফিরলে বাবা প্রশ্ন করলে পুত্রের বন্ধুর কাছে শুনতে হয় আমার বন্ধুকে আপনি বকাঝকা করেন কেন? আর শিক্ষকরা কি করছেন পড়া বলতে পারেনি বলে ফাটাফাটা রোদে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন ফলে মেয়েটি সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়েছে। কী এমন অন্যায়- না, পড়া ভুলে যাওয়া। এই কি শিক্ষক? এটা কি শিক্ষা? তাই দেশে মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষকের অভাবে শিক্ষাব্যবস্থা দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে মানুষ গড়ার কারখানায়। সত্যিকার অর্থে  মানুষ হচ্ছে না। তবে শুধু শিক্ষকদের দোষারোপ করলে চলবে না।

শিক্ষক, সরকার, শিক্ষাবিভাগ, অভিভাবক, স্কুল পরিদর্শক সকলে সমান দোষী। আমি নিম্নে একটু উদাহরণ তুলে ধরার চেষ্টা করছি। আপনারা হয় তো লক্ষ্য করে থাকেন যে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত সর্বত্র শিক্ষাক্ষেত্রে কিছু কিছু অসঙ্গতি রয়েছে। যেমন কোনো বিদ্যালয়ে শিক্ষক নেই, কোথাও প্রশিক্ষণহীন শিক্ষক আবার কোথাও শোনা যায় বিদ্যালয়ই নেই। অথচ অস্তিত্ববিহীন বিদ্যালয়ের নামে সরকারি অর্থ আসছে। নির্দিষ্ট সময়ে বই পাওয়া যাচ্ছে না, কারিকুলামও নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছচ্ছে না। উপযুক্ত শিক্ষক ও সরকারি ঢিলেমির জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক গলদ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আবার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সরকার ভিন্ন ভিন্ন নামে যে শিক্ষা চালু করেছে- তা অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ। 

এখন একটি নিম্নে বিদ্যালয়ে ৩০০/৩৫০ ছাত্র-ছাত্রী থাকে। সেখানে শিক্ষক মাত্র ৪/৫ জন। তিনজন শিক্ষককে সব বিষয় পড়াতে হবে এবং প্রশাসন চালাতে হবে। একটি বিদ্যালয় চালাতে তার প্রশাসনিক কাজকর্ম করা এক কঠিন কাজ। এহেন অবস্থায় এ তিনজন শিক্ষক বা শিক্ষয়িত্রী দ্বারা আর যাই হোক, সত্যিকারের মানুষ গড়া সম্ভব হবে না। যেখানে কেতাবি বিদ্যাশিক্ষা দেয়ার সময় থাকে না, সময় চলে অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজে। তাই সব ঠিকঠাক করে যে ওরা শেখাবে তার সময় কোথায়? কাজেই শুধু শিক্ষকদের দোষারোপ করলে চলবে না। বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা প্রয়োজন।

অন্যদিকে শিক্ষক ছাত্রীর সাথে অশালীন আচরণ, যৌন নির্যাতন, অর্থ আত্মসাৎ, ছাত্রের হয়ে শিক্ষকের মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসা- এমনকি নকল সরবরাহে কোন কোন শিক্ষকের নাম উঠে আসছে। এরপর শিক্ষক সমাজের লজ্জার বাকি রইল কি? আজকাল সমাজে শিক্ষকতার বৃত্তিকে লোকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে না। আগে লোকে এ বৃত্তিকে সৎ ও সম্মানের বৃত্তি বলে গণ্য করতো। ছেলে-মেয়েরা ডিগ্রি লাভের পর এ চাকরিকে বেশি পছন্দ করতেন। কিন্তু বর্তমান শিক্ষকদের অধঃপতন দেখে এ বৃত্তির ওপর শ্রদ্ধা হারাচ্ছে মানুষ। 

শিক্ষায় দুর্নীতিতে যে শুধু শিক্ষক তা নয়। শিক্ষা অফিস থেকে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত সর্বত্রই চলছে লাগামহীন দুর্নীতি যা বিভিন্ন সময়ে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে থাকে। বিদেশের লোক যদি বাংলাদেশের শিক্ষা বিভাগের এ দৃশ্য দেখেন তাহলে লজ্জায় মুখ লুকানো ছাড়া আর কোনো গতি নেই, থাকবে না। দেশে এত জনসংখ্যা থাকা সত্ত্বেও দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিককে সত্যি অর্থে প্রকৃত মানবসম্পদ রূপে গড়ে তোলা যাচ্ছে না। মূল্যবোধ শিক্ষার সময় শৈশবকাল। তখন পড়–য়ারা কাদামাটির মতো নরম থাকে, ওদের তখন যে রূপ দেয়া হয়, তাই হয়। কাজেই পাঠশালা থেকে এদের নিয়মানুবর্তিতা, সময়ানুবর্তিতা, শৃঙ্খলাবোধ ইত্যাদি যদি ওদের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া যায়, ওরা চলবে সুষ্ঠুভাবে। দুঃখের বিষয় আজকের শিক্ষদের বেশিরভাগই সে ব্যাপারে উদাসীন। তাদের কেউ কেউ স্কুলে আসবেন, কিছু পাঠ পড়াবেন। তড়িঘড়ি বাড়ি চলে যাওয়ার ঘণ্টা পড়ার জন্য ছটফট করবেন।

যেখানে রুজি-রুটির প্রশ্ন সেখানে মন দিয়ে আন্তরিকভাবে একটা কিছু দিতে হবে। এগুলো আবার সরকারি অর্থাৎ প্রাইভেট স্কুলগুলোতে কিন্তু নিয়ম সুন্দরভাবে পালন করা হয়। শিক্ষক-শিক্ষিকারা জানেন তারা নিয়মনীতি ঠিকঠাক পালন না করলে তাদের চাকরি যে কোনো মুহূর্তে চলে যেতে পারে। তাদের ভয় আছে, যা সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলোতে নেই। আবার স্কুল পরিদর্শকরা নাকি সময় পান না স্কুল পরিদর্শনের। কাজের চাপ বেশি। প্রশ্ন জাগে, স্কুল পরিদর্শন কি তার কাজের অঙ্গ নয়? সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলোর শিক্ষকরা ভয় পান না। 

আগে প্রায়ই বিভিন্ন প্রবন্ধ-নিবন্ধে উঠে আসত স্কুলের পরিবেশ সুষ্ঠু নয়, অর্থাৎ কোথাও স্কুল ঘরে বেড়া আছে তো টয়লেট নেই, দরজা আছে কিন্তু জানালা নেই, অস্বাস্থ্যকর টয়লেট ইত্যাদি নানা কথা। যার জন্য সুষ্ঠুভাবে শিক্ষা দেয়া যাচ্ছে না। কিন্তু এখন যদি সরকার প্রশ্ন করে কিসের অভাবে সুষ্ঠুভাবে পড়াশোনা হচ্ছে না? কেন ছাত্র-ছাত্রীরা এত নকল করে? মানছি যে মাস-মাইনা আদায় করতে শিক্ষকদের ধরনায় বসতে হয়, আন্দোলন করতে হয় তা হলে তারা পড়াবে কখন?

প্রশ্ন ওঠে- মাসে কত দিন? সরকার এখন লাখ লাখ টাকা দিচ্ছে- কাজেই এ অজুহাত এখন আর কাজে লাগবে না। আসলে সততার অভাব। শিক্ষকের কথা যেমন সরকারকে ভাবতে হবে, শিক্ষকদের হতে হবে সৎ, বিনয়ী, সত্যিকারের মানুষ গড়ে তুলতে প্রয়াসী। তবে না তারা শ্রদ্ধার পাত্র হবেন, তবেই তো হবেন সত্যিকারের মানবসম্পদ গঠনকারী ব্যক্তিত্ব। সরকারি ভ্রান্তি পদে পদে। যেমন আমরা প্রত্যেকটি বিদ্যালয়ে দেখি শিক্ষকরা যথাসময়ে অবসর নিচ্ছেন। কিন্তু সরকার সে জায়গায় নতুন শিক্ষকের নিযুক্তি দিচ্ছে না। আবার দেখা যাচ্ছে প্রধান শিক্ষক বা প্রিন্সিপালের যদি অবসর হয়, তবে সেখানে ইনচার্জ প্রিন্সিপাল বা ইনচার্জ হেড মাস্টার সিনিয়র লিস্ট থেকে দিয়ে দেয়া হচ্ছে এবং এটা চলছে প্রায় দু’যুগ ধরে। স্কুলের পুরো দায়িত্ব এই ইনচার্জদের, অথচ তারা বেতন পাচ্ছেন একজন সহকারী শিক্ষকের মতই।

তাতে কাজে অনুপ্রেরণা পাওয়া যায় না, নিতান্ত কাজ চালাতে বাধ্য বলে চলা। অবশ্য মনে একটা আশা নিয়ে, তাতে তার অন্তরে অন্তরে একটা দ্বন্দ্ব চলে। সেখানে যদি তার কোনো ত্রুটি থাকে তবে তাকে দোষারোপ করা যায় না। কারণ, এটি বুনো রাম নাথের যুগ নয়। তাই কাজ অনুপাতে মাসিক মাহিনা যথার্থ হওয়া অবশ্য জরুরি। 

আবার দেখুন সহকারী শিক্ষক যখন অবসর নেন, তখন একই অবস্থা। কিন্তু প্রিন্সিপাল বা হেডমাস্টারদের প্রক্সি রুটিন (অর্থাৎ ক্লাস ম্যানেজ করা) পিরিয়ড কেটে নিয়ে তাকে ক্লাসে পাঠাতে হয়। এটা অত্যন্ত কষ্টকর। ভুক্তভোগী ছাড়া সরকার এটি বুঝবে না। প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রীরা প্রথম জীবনে প্রিন্সিপাল বা হেডমাস্টার থাকলে বিষয়টি অনুভব করতে পারতেন। 

আমার মনে হয় আমাদের দেশে জাতিটাকে প্রকৃত মানুষ করতে হলে আগে সরকারি নিয়ম-কানুন কিছুটা হলেও পাল্টাতে হবে। কাজেই অবিলম্বে সরকারি গলদের বিলোপ সাধন করে শিক্ষার বাতাবরণ সুষ্ঠু করে তুলতে হবে। কার্যত সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে শিক্ষার মনোন্নয়নের প্রশ্নটি। পাশাপাশি চাই শিক্ষক সমাজের মূল্যবোধ ও চেতনাবোধ। পড়ুয়াকূলকে নৈতিক শিক্ষার পাঠ নিতে হবে। 

সুষ্ঠু শিক্ষার পরিমণ্ডল গড়তে হলে চাই সরকারের সদর্থক মনোভাব, শিক্ষক-শিক্ষিকার দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠা, সততা, ছাত্র সমাজের যথার্থ শিক্ষা অর্জনের আগ্রহ, সর্বোপরি অভিভাবকদের দায়িত্ববোধ ও উৎসাহ দান। 

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।


মানবকণ্ঠ/এফআই