Image description

দুই হাজার বছরেরও পুরনো ইতিহাস সমৃদ্ধ একটি দেশ নেপাল। উত্তরে চীন ও পূর্ব, পশ্চিম, দক্ষিণ তিন দিকে ভারতবেষ্টিত উপমহাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশ নেপাল। নেপালে একনাগাড়ে দুইশো চল্লিশ বছর রাজতন্ত্র টিকে ছিল। নেপালের সর্বশেষ রাজা জ্ঞানেন্দ্র বীর বিক্রম শাহদেবের দূরদর্শী চিন্তা ও কুক্ষিগত ক্ষমতাবিরোধী মনোভাব নেপালের রাজতন্ত্র বিলোপে প্রধান সহায়ক হিসেবে ভূমিকা রেখেছিল। 

দীর্ঘস্থায়ী নেপালি রাজতন্ত্রের অবসান হয় ২০০৮ সালের ১০ এপ্রিল। রাজতন্ত্র বিলোপের পর থেকে নেপালে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। নতুন সংবিধান কার্যকর করার পর থেকে নেপালে অধিকাংশ সময় ক্ষমতায় ছিল চীনপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো। এনসি-মাওবাদী সরকার ও চীনের মধ্যে ভারসাম্য ছিল। নেপালের রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাও অনবরত চলমান। নেপালের রাষ্ট্র ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে চীন ও ভারতের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা গত বিশ বছর ধরেই অব্যাহত রয়েছে। ২০২১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী নেপালের আয়তন এক লক্ষ সাতচল্লিশ হাজার পাঁচশত ষোলো বর্গকিলোমিটার এবং মোট জনসংখ্যা দুই কোটি একানব্বই লক্ষ বিরানব্বই হাজার চারশো আশি জন। প্রায় তিন কোটি জনসংখ্যার নেপাল তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্রতম একটি দেশ। 

পর্যটক ও পর্বতারোহীদের নিয়মিত নেপাল ভ্রমণ দেশটির অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বিশেষ সহযোগিতা করে। নেপালের অভিবাসী কর্মীরা নানা কারণে বিশ্বের বিবিধ জায়গায় বেকার হয়ে পড়েছে। এই চাপ মোকাবিলায় চীন নেপালিদের জন্য ইউনান প্রদেশে কাজ করার বিশেষ অনুমতি দিয়েছে যা ভালোভাবে নেয়নি ভারত। নেপাল-চীন সুসম্পর্ক ভারতের দৃষ্টিতে নেতিবাচক। ফলে ভারত-নেপাল সম্পর্কে ভাটা পড়া অস্বাভাবিক কিছু না। অবশ্য  ভারতের সাথে নেপালের সম্পর্কের টানাপড়েনের ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে চীন। ২০১৫ সালে নেপালে নতুন সংবিধান রচনা নিয়ে ভারত ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। কারণ ওই সংবিধান ভারতের মনঃপূত ছিল না। এরপর ভারত নেপালের ওপর নজিরবিহীন অবরোধ আরোপ করে বসে। ধীরে ধীরে নেপালের জনমত ভারতবিরোধী হয়ে ওঠে। সেই সুযোগে নেপালিদের পাশে দাঁড়ায় চীন। এরপর থেকেই নেপালের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে আর ভারতের ঘনিষ্ঠতা কমেছে।

নেপালের নির্বাচন কমিশন গঠিত হয় ১৯৫১ সালে। নির্বাচন কমিশন অনেক পুরনো হলেও কমিশনের নির্বাচনি অভিজ্ঞতা খুবই সামান্য। নেপাল নির্বাচন কমিশন ২০০৮ সালেই প্রথম সংসদীয় গণতান্ত্রিক নির্বাচন পরিচালনা করে। ওই নির্বাচনে মাওবাদী গেরিলা নেতা পুষ্পকমল দাহাল প্রচন্দ জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিলেন। নির্বাচনটি ছিল সংঘাত-উত্তর সময়ের নির্বাচন। প্রথম গণপরিষদে প্রায় ২৬টি দলের উপস্থিতি ছিল। মিশ্র নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার জন্যই সংসদে ২৬টি দল আসন পেয়েছিল। নেপালের ২০০৮ পরবর্তী নির্বাচনগুলো ছিল সর্বদলীয়। ২০১৭ সালে গণতান্ত্রিক সংবিধানের আওতায় প্রথম জাতীয় এবং প্রাদেশিক সংসদীয় নির্বাচন যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ হয়েছিল। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে সরকার গঠন করেছিলেন পুষ্পকমল দাহাল। তৃতীয়বারের মতো গ্রহণ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে দাহাল একটি ঢিলেঢালা জোটের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। সরকারে তার দলের অবস্থান তৃতীয়। এমন দুর্বল অবস্থানে থেকেও তিনি জোট গঠন করেন। জোটের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেন এবং হয়ে যান প্রধানমন্ত্রী।

ক্ষমতায় টিকে থাকতে তিনবার জোট পরিবর্তন করেন পুষ্পকমল দাহাল এবং পাঁচবার পার্লামেন্টে আস্থা ভোটের মুখোমুখি হয়। ১২ জুলাই, ২০২৪ পঞ্চমবারের আস্থা ভোটে হেরে যান তিনি। নেপালি কংগ্রেস দেশটির পার্লামেন্টে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। আর দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ইউএমএল। এই দুটি দল একত্রে নতুন করে জোট সরকার গঠন করলো। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায় জোট সরকার মানেই ঝামেলা। জোট গঠন ও ভাগ-বাটোয়ারার রাজনীতিতে স্থিতিশীলতার অভাব দেখা যায়। ২০০৬ সালে দাহালের মাওবাদী সংগঠন সশস্ত্র বিদ্রোহের অবসান ঘটিয়ে মূলধারার রাজনীতিতে যোগ দেয়। দাহালের দল ২০০৮ সালে সর্বাধিক সংসদীয় আসন পায়। এরপরই নেপালে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। কিন্তু এক বছর পরই প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মতবিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি।

নেপালের ইংরেজি দৈনিক দ্য কাঠমান্ডু পোস্ট-এর সংবাদ থেকে জানা যায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী তথা নেপালি কংগ্রেসের প্রধান শের বাহাদুর দেউবার সঙ্গে জোট সরকার গড়ার বিষয়ে সমঝোতা চূড়ান্ত করে নিয়েছে কেপি শর্মা ওলির দল। নেপাল পার্লামেন্টের নি¤œকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভসের আসন সংখ্যা ২৭৫। এর মধ্যে দেউবা নেতৃত্বাধীন নেপালি কংগ্রেসের ৮৮ এবং কেপি শর্মা ওলির ইউএমএল-এর ৭৯ জন সদস্য রয়েছেন। এই দুই দল এক হলে সহজেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা চলে আসে। আবার পুষ্পকমল দাহালের দল মাওবাদী সিপিএন এর সদস্য সংখ্য ৩২। মাওবাদীদের দুই সহযোগী দল, রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্র পার্টির ২১ এবং সিপিএম এর ১০ জন হাউস সদস্য। গত ১২ জুলাই, ২০২৪ অনুষ্ঠিত আস্থাভোটে উপস্থিত ২৫৮ আইনপ্রণেতার মধ্য থেকে মাত্র ৬৩টি ভোট পেয়েছেন পুষ্পকমল দাহাল। তার বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন ১৯৪ জন আইনপ্রণেতা। আর একজন ভোটদানে বিরত ছিলেন। 

২০২২ সালের নভেম্বরে নেপালের সাধারণ নির্বাচনে নেপালি কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে লড়েছিল দাহালের মাওয়িস্ট সেন্টার। কিন্তু জোটে জেতার পরই দেউবাকে ছেড়ে ওলির সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন দাহাল। ২০২৩-এর মধ্যপর্বে ওলির সঙ্গে মতবিরোধের সময় দেউবার সমর্থন নিয়ে কাঠমান্ডুর কুর্সি বাঁচিয়েছিলেন একসময়ের এই গেরিলা যোদ্ধা। কিন্তু এবার চীন সমর্থিত কেপি শর্মা ওলি জাতীয়তাবাদী নেতা দেউবার সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ায় নেপালের রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ দেখা দিয়েছে। সকল জল্পনা-কল্পনা শেষে ১৫ জুলাই, ২০২৪ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন কেপি শর্মা ওলি। ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন কেপি শর্মা ওলি। তিনি ২০১৮ সালে পুনরায় নির্বাচিত হন। ২০২১ সালে স্বল্প সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন কেপি শর্মা ওলি।  

নেপালি রাজতন্ত্র অবসানের পর থেকেই রাজনৈতিক অস্থিরতার শিকার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটি। ২০১৭ সালের নির্বাচনে কেপি শর্মা ওলি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতের কঠোর নজরদারিতে ছিলেন। এজন্য তিনি ভারতের সাথে ভারসাম্য বজায় রাখার পরিবর্তে চীনের সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেন। এতে আরো বেশি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। লিপুলেখ কালাপানিকে নেপালের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে নতুন মানচিত্র প্রকাশ করায় ভারত আরও ক্ষিপ্ত হয়। ভারতের অযোধ্যায় বিজেপি সরকারের রাম মন্দির স্থাপন পুরোপুরি অবৈধ বলে ঘোষণা করেছিলেন কেপি শর্মা ওলি। নেপালের দাবি ছিল রাম জন্মভূমি নেপালে অবস্থিত। ফলে মোদি সরকারের দৃষ্টিতে আরও বেশি পরিচিতি পায় কেপি শর্মা ওলি। কেপি শর্মা ওলিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে নেপালের সামাজনীতি  রাজনীতি ও অর্থনীতিতে প্রভাব বিস্তারে সক্রিয় হয়ে উঠে ভারত। এই কার্যক্রমে সরকারের পাশাপাশি ভারতের সেনাবাহিনীর একটি অংশও যুক্ত হয়ে পড়ে। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে নেপালি গোর্খা রেজিমেন্ট নিয়ে বিতর্ক উঠার পর এ পরিস্থিতি তৈরি হয়। 

নেপালের নতুন সংবিধানে দেশটিকে ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে ভারত বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে। ভারতের প্রভাবশালী মহল কয়েক দফায় নেপাল সফর করে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে অন্তর্ভুক্তি ঘটাতে ব্যর্থ হয়। নেপালের ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা সংবিধান থেকে বাদ দেয়ারও প্রয়াস চালায় ভারত। নেপালের রাজনীতিতে সর্বদাই  ভারত ও চীনের সক্রিয় প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। একসময় নেপালে একতরফা প্রভাব বিস্তার করেছিল ভারত। এখন অবশ্য নেপালি রাজনীতিতে চীনা প্রভাবই প্রবল হয়ে উঠেছে। এই প্রভাবের একটি কারণ, নেপাল একটি ল্যান্ডলকড কান্ট্রি। এটি হিমালয় পাদদেশে অবস্থিত। এর উত্তরে চীনের তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল এবং দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে ভারতের সীমানা। এটি শিলিগুড়ি করিডর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে এবং ভারতের সিকিম রাজ্য দিয়ে ভুটান থেকে বিচ্ছিন্ন। নেপাল কখনোই উপনিবেশ ছিল না কিন্তু ইম্পেরিয়াল চীন ও ব্রিটিশ ভারতের মধ্যে একটি বাফার স্টেট হিসেবে কাজ করে। কেপি শর্মা ওলি বাস্তবতা বিবেচনা বোধসম্পন্ন একজন রাজনীতিবিদ। তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ও বিচক্ষণতা নিঃসন্দেহে অনুসরণীয়। দেশের সর্বোচ্চ নির্বাহী ক্ষমতা এখন ওলির হাতে। চীন-ভারত উভয় দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে দেশের সার্বিক উন্নয়নে মনোনিবেশ করাই উচিত কেপি শর্মা ওলির নৈতিক দায়িত্ব।

লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট

মানবকণ্ঠ/আরএইচটি