
মাদকাসক্তির প্রচলিত নাম নেশা। মানব রক্তে মাদকের সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয় নেশা। মাদকের ব্যবহারে একজন ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক উভয়দিক থেকেই ক্ষতি হয়। মাদক শিশু, কিশোর কিংবা যুবকসহ যেকোনো বয়সের মানুষকেই নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে চালিত করে। সামাজিক পরিবেশে ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তারপরও শত সহস্র প্রাণীর মধ্যে জেনে-বুঝে মাদক সেবনকারী একমাত্র প্রাণী হচ্ছে মানুষ।
একসময় মাদক হিসেবে কেবল মদ, ভাং, চরস, বিড়ি, সিগারেট, খৈনি, গুটকা, আফিম, গাঁজা ইত্যাদির ব্যবহার হতো। পরবর্তীতে সেই জায়গা দখল করে নেয় ‘ড্রাগ’। কোকেন, হেরোইন, এন ১০, ব্রাউন সুগার, কোরেক্স, মারিজুয়ানা, বারবিচুয়েট, ম্যানডেক্স, গুল, মরফিন, প্যাথেফিন, এলএসডি, ইয়াবা, তুশকা, ফেনসিডিল, সিডিলসহ নানাবিধ ওষুধ মাদক হিসেবে বর্তমানে সর্বাধিক প্রচলিত। এই ড্রাগগুলো আন্তর্জাতিক পাচারকারীদের মাধ্যমে সমগ্র পৃথিবীর আনাচে-কানাচে সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। বিশ্ববিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিনের গবেষণা ও শ্রম দিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিপ্লব ঘটিয়েছে।
বিজ্ঞানীরা মানবজাতির কল্যাণে আবিষ্কার করেছে বিভিন্ন ধরনের জীবনদায়ী বেদনানাশক ওষুধ বা ড্রাগ। সেই ড্রাগগুলোই ধীরে ধীরে নেশার সামগ্রী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। প্রথম প্রথম পাশ্চাত্যের ধনী দেশসমূহে বেদনানাশক ড্রাগ নেশার সামগ্রীতে পরিণত হয়। তারপর ধীরে ধীরে তা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশেও সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ে। প্রাচীনযুগের শেষার্ধে শারীরিক শক্তি ও মানসিক আনন্দের জন্য মাদকদ্রব্য সেবন শুরু হয়। অত্যাধুনিকযুগে মাদকসেবন সর্বনাশা নেশা হিসেবে পরিবার, সমাজ তথা এক-একটি জাতি ধ্বংসের অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের একটি বড় অংশ নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। ফরাসি বিপ্লব, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চলাকালীন আহত সৈন্যরা হতাশা ও যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ব্যাপকভাবে মাদকে আসক্ত হন। মাদক চোরাচালানের স্বর্গভূমি হিসেবে পরিচিতি ভিয়েতনাম, থাইল্যাণ্ড ও মিয়ানমার। ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে এই দেশ তিনটি থেকেই মূলত মাদক পাচার হয়। বর্তমানে আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ইরানও হয়ে উঠেছে মাদক চোরাকারবারির অন্যতম ঘাঁটি।
এছাড়া কলম্বিয়া, বলিভিয়া, ইকুয়েডর, সুদান, নাইজেরিয়া, রাশিয়া, আমেরিকাতেও মাদকের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। ভারত ও বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। গণমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে মাদিকসেবীর সংখ্যা বর্তমানে প্রায় এক কোটি ত্রিশ লাখের ওপর। মাদকসেবীদের ২২.৭৬ শতাংশ মহিলা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে স্কুল-কলেজের টিনেজার শিক্ষার্থীদের মধ্যেও বিষ-বাষ্পের মতো ছড়িয়ে পড়ছে মাদক। তরুণ প্রজন্ম ভয়াবহ ধ্বংস ও বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত এক বন্ধু নেশাগ্রস্ত হলে তার দেখাদেখি আরও বেশ কয়েকজন বন্ধুও নেশা করতে আগ্রহ অনুভব করে। বাংলাদেশে অন্যতম মারাত্মক একটি নেশা হিসেবে পরিচিত সুঁই-সিরিঞ্জের মাধ্যমে শরীরে ঘুমের ওষুধ প্রবেশ করানো। এটি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর নেশা। এ নেশার পরিণতিও ভয়ঙ্কর। আসক্তদের ধুঁকে ধুঁকে মরতে হয়। বাঁচার কোনো পথ নেই। এই পদ্ধতিতে মাদক গ্রহণকারীদের কেউ কেউ এইচআইভি জীবাণুও বহন করে। কেউ কেউ জটিল রোগে ভুগে দীর্ঘদিন ধরে। সেই সঙ্গে গণমাধ্যমকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
নেশামুক্ত তরুণ প্রজন্ম তৈরি করতে রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র, ইন্টারনেটে মাদকবিরোধী অনুষ্ঠান প্রচার করতে হবে। সন্তানের সারাদিনের কার্যকলাপ ও সঙ্গীদের ব্যাপারে ভালোভাবে খবরাখবর রাখতে হবে। ধৈর্য ধরে তাদের কথা শুনতে হবে। নিজের সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দ অনুভূতি সবার সাথে ভাগ করে নিতে হবে। গতানুগতিক একঘেয়ে জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আনন্দভ্রমণ ও সুস্থ বিনোদনের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। যদি পরিবারের কোনো সদস্য মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে তাকে সেই অবস্থা থেকে বের করে আনতে সকল সদস্যকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। মাদকাসক্তির কুফল সম্পর্কে ধারাবাহিকভাবে আলোচনাচক্র, বিতর্কসভা, পথনাটিকা প্রদর্শনের মাধ্যমে জনসচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডের আয়োজন করতে হবে। সরকারকে মাদক চোরাচালান প্রতিরোধে কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে। আন্তর্জাতিক মাদকচক্রের নেটওয়ার্ক পুরোপুরি ধ্বংস করার জন্য বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদানে আরও গুরুত্বারোপ করতে হবে। সর্বনাশা ড্রাগের সহজলভ্যতা বন্ধ করতে হবে। মাদকাসক্তি একটি ‘সামাজিক ব্যাধি’। সুতরাং এর মূলোৎপাটন করতে হলে প্রয়োজন ব্যাপক পরিসরে সামাজিক আন্দোলন। মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার বিরোধী আন্তর্জাতিক দিবসে আমাদের একমাত্র প্রত্যাশা সুস্থ ও সুন্দর মানব সম্পদ গড়ে তোলা। তাই দেশের প্রতিটি পরিবারের উচিত হবে মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করা।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট
মানবকণ্ঠ/এসআরএস
Comments