Image description

খুব ভোরে আজকে ঘুম ভাঙলো আমার। কংক্রিটের শহরে বারান্দার গ্রিল দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তখনো পুরোপুরি ভোরের আলো ফোটেনি। আকাশের এমন ক্ষীণ আলো আঁধারিতে মন আবেগী হয়ে ওঠে। মনের ভেতর প্রেম খেলা করে। পৃথিবীর সবকিছুই তখন সুন্দর মনে হয়। আমাদের সুন্দর ভাবনা চিন্তার ওপর নির্ভর করে প্রেম, ভালোবাসা এবং সৌন্দর্য। যখন মনের মধ্যে ফুর্তি আসে তখন আপনা-আপনি গুনগুনিয়ে গানের সুর ভাসে নিজের বেসুরো গলায়।

প্রেম প্রেম ভাব নিয়ে চেয়েছিলাম আকাশের দিকে। হঠাৎ মোবাইল ফোনের রিংটোন কানে বেজে উঠলো। নিমেষে প্রেম ভাব উড়ে গেল চড়ুই পাখির মতো করে। রুমে এসে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম অর্ণব কল করেছে। অবাক হলাম এত ভোরবেলা অর্ণব ঘুম থেকে উঠে আমাকে কল করলো। অর্ণব আমার প্রথম প্রেম। খুব ভালো বন্ধুও। অর্ণব যে আমাকে পছন্দ করে এবং ভালোবাসে সেটা নানাভাবে সে বুঝিয়ে আসছে। আট বছরের সম্পর্ক আমাদের। কৃষ্ণচূড়ার মতো জানান দেয় তার ভালোবাসা। 

ক্যাম্পাসের সবাই জানে অর্ণব আমাকে খুব ভালোবাসে। ভালোবাসি ভালোবাসি করে পাগল করে ফেলে। হুটহাট পাগলামি করে। ওর পাগলামিতে সায় না দিয়ে উপায় কি আমার। মানুষ তো সঠিক মানুষ পেলেই পাগলামি করবে এটাই তো স্বাভাবিক। আমিও অর্ণবকে অনেক ভালোবাসি কিন্তু ভালোবাসি ভালোবাসি বলে কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করি না। অর্ণব বুঝতে পারে আমার আচরণের মাধ্যমে আমিও তাকে পাগলের মতো ভালোবাসি। ভালোবাসি ভালোবাসি বলে চিৎকার করলেই ভালোবাসা হয় না ভালোবাসা বুঝাতে হয় দায়িত্ব, যত্ন আর আচরণের মাধ্যমে। 

ফোনটা রিসিভ করতেই অর্ণব ফোনের ওপাশ থেকে বলে উঠলো অনু চট করে রেডি হয়ে নাও। আমি তোমার বাসার নিচে আসছি আমরা দুজন একসাথে সকাল দেখব বলে ফোনটা কেটে দিলো। আমি বেশ খুশি মনে জলদি রেডি হয়ে বাসার নিচে নামতেই দেখি অর্ণব বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভোরবেলা ঢাকা শহরের রাস্তা ফাঁকা থাকে। এ সময় বাইকে ঘুরতে খুব ভালো লাগে। ভালোবাসার মানুষের সাথে সকাল দেখাটা ভাগ্যের ব্যাপার। একসাথে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হাতে হাত রেখে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখাটা অন্যরকম এক ভালোবাসার অনুভূতি। 

আমরা দুজন মুক্ত বিহঙ্গের মতো বাইকে করে ফাঁকা রাস্তায় উড়তে শুরু করলাম। রাস্তার দু’ধারে কৃষ্ণচূড়া গাছ। যতদূর চোখ যায় নজর কাড়ে মনোমুগ্ধকর কৃষ্ণচূড়া। আমরা স্বচ্ছ শান্ত জলের কাছে গিয়ে দুজন বসলাম। অনেকক্ষণ দুজন চুপচাপ বসে আছি। নীরবতা ভেঙে অর্ণব আমার হাতটা ওর বুকের কাছে নিয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল অনু কথা দাও কখনো ছেড়ে যাবে না। আমি অবাক হয়ে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বেশ কয়েকবার কথাটা বলল অর্ণব। আমি বললাম তুমি আমার কাছে স্বচ্ছ জলের মতো হয়ে থেকো। যেখানে থাকবে না কোন মিথ্যা, লুকোচুরি। স্বচ্ছ জলের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট দেখা যাবে তোমার হৃদয়ের অলি-গলি। তবে সাধ্য কি আর তোমার থেকে দূরে থাকার। এমন স্বচ্ছ জল পেলে আমি আজীবন জলের পাশে বসে থাকবো। 

সারাদিনই অর্ণব আমাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। একটু পরপরই কল করবে। কোথায় কখন যাচ্ছি, ঠিকমতো খেয়েছি কিনা সবকিছু তার জানা চায়। একদিন আমাকে না দেখতে পেলে পাগলের মতো ছটফট করে। ঝগড়া করে কখনো যদি কথা বন্ধ থাকে তাহলে কাঁটা কবুতরের মতো ছটফট করতে থাকে অর্ণব। ঠিক আমার বাসার সামনে চলে আসবে। 

দেখতে দেখতে পড়াশোনা শেষ করে অর্ণবের ভালো একটা চাকরি হয়। ব্যস্ততা বাড়লেও কখনো আমাকে ব্যস্ততা দেখিয়ে অবহেলা করেনি। অফিস শেষ করে প্রতিদিন আমার সাথে সন্ধ্যার পরে দেখা করে। ছুটির দিনের আগের রাতে সারারাত কথা বলে রাতকে ভোর করে। ছুটির দিনগুলোতে আমরা দুজনে অনেক ঘোরাঘুরি করি। কয়েকদিনের জন্য আমি গ্রামের বাড়িতে যাই। বাড়িতে যাওয়ার পরে হঠাৎ করে অর্ণব আমার কল রিসিভ করে না। এমনটা কখনো হয়নি এত বছরে। অনেকগুলো টেক্সট করেছি। টেক্সট দেখে কিন্তু রিপ্লাই দেয় না। 

এমন পরিবর্তনে আমার খুব অস্থির লাগে। যে মানুষটা আমার সাথে একদিন কথা না বলে থাকতে পারে না সে মানুষটা আমার ফোন রিসিভ করছে না। এভাবে তিন-চার দিন চলে গেল। তারপর একদিন কল করলো এমন ভাব যেন সবকিছু স্বাভাবিক কিছুই ঘটে নাই। স্বাভাবিকভাবেই আগের মতো কথা বলল। আমি অনেকবার জিজ্ঞেস করলাম এমন আচরণের কারণ কি তেমন কোনো উত্তর দিল না। বলল তুমি বাড়িতে আছো, এত দূরে আছো তাই আমার কিছু ভালো লাগছে না। চলে আসো তাড়াতাড়ি কতদিন হয়ে গেল তোমাকে দেখি না। আমি তো স্বস্তি খুঁজে পেলাম। 

অর্ণবের জন্য তাড়াতাড়ি আবার ঢাকা ফিরে আসলাম। ঢাকা আসার পরে সম্পর্ক আগের মতোই প্রাণ ফিরে পেল। অর্ণবের খালাতো বোন অর্পার সাথে হঠাৎ শপিংমলে দেখা। অর্ণব অনেক বছর আগে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল অর্পার সাথে। তারপর থেকে প্রায়ই দেখা, মুঠোফোনে কথা হতো অর্পার সাথে। খুব ভালো একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে আমাদের মধ্যে। 

অনেকদিন ধরে অর্পার সাথে আমার যোগাযোগ ছিল না। এতদিন পরে অর্পাকে দেখে খুব ভালো লাগলো। অর্পাকে জড়িয়ে ধরলাম। খেয়াল করলাম বেশ মনমরা হয়ে আছে, চেহারা মলিন, চোখের নিচে কালি পড়েছে। জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে তোমার? অর্পা বলল চলো কোথাও বসি। এতদিন পর দেখা চলো একসাথে বসে কফি খাই। দুজনেও একটা কফি শপে বসলাম। 

কফিতে চুমুক দিতে দিতে অর্পাকে বললাম কি হয়েছে তোমার? খেয়াল করলাম ওর চোখ ছল ছল করছে। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর বলল অনু তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি। আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কি কথা বল। বলল তোমার সাথে আমার জীবনের অনেক কিছু শেয়ার করলেও গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় শেয়ার করতে পারিনি কখনো। অর্ণবের বারণ ছিল তোমাকে বলা। তখন বেশ অবাক হলাম। বললাম অর্ণব কেন বারণ করবে তোমার বিষয়ে কথা বলতে। আর অর্ণবের সব বিষয় তো আমি জানি। অর্পা তখন তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল সবকিছু জানা এত সহজ নয়। সবকিছু জানার পরেও অনেক কিছু জানার বাকি থাকে। 

অর্পা ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো অনু বিয়েতে এলেনা কেন? আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে খুশিতে বললাম অভিনন্দন। তুমি বিয়ে করছ বল নাই তো। দাওয়াত না দিলে যাব কিভাবে। দেখেছো অর্ণব আমাকে দাওয়াত দেয় নাই, আমাকে বলেও না। দাঁড়াও ওকে আমি মজা দেখাবো। অর্পা আমার দিকে তাকিয়ে বলল তুমি কি সত্যি কিছু জানো না? তুমি অর্ণবের এত ভালো বন্ধু তবুও তোমাকে বলেনি কিছু? তখন আমি একটু ঘাবড়ে যেয়ে বললাম না তেমন কিছু আমাকে বলেনি। তাছাড়া তোমার বিয়ের ব্যাপারে কোন কথাই তো হয়নি। 

অনু তুমি ভুল ভাবছো বিয়েটা আমার হয়নি। তাহলে বিয়েতে যাওয়ার কথা কেন বললে? কি হয়েছে স্পষ্ট করে বলতো? অনু অর্ণব বিয়ে করেছে। এই কথা শোনার পরে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। চোখের কোণে জল চলে আসলো। অর্পা কি বললে তুমি আরেকবার বলো। অর্পা বলল সত্যি বলছি অনু তিন মাস হলো অর্ণব বিয়ে করেছে। আমার পুরা মাথা ঘুরছিল। আমার হাত-পা ভারি হয়ে আসছিল। আমি আমার কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। 

এরপর অর্পা কাঁদতে কাঁদতে বলা শুরু করল অনু ভেবেছিলাম নিজেকে শেষ করে দিব। পরিবারের কথা চিন্তা করে পারিনি। অর্ণবের সাথে আমার এক যুগের সম্পর্ক। আমরা দুজন দুজনকে প্রচণ্ড ভালোবাসতাম। আমাদের মধ্যে কখনো ঝগড়া হয় নাই। অর্ণব আমাকে একদিন না দেখে থাকতে থাকতে পারত না। আমার সাথে কথা না বলে কখনো সে ঘুমাতো না। আমাকে নিয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকতো। আর সেই মানুষ আজ অন্য কারো। 

আমার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো। খুব কষ্ট করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলাম। আমি অর্পার দিকে তাকিয়ে বললাম কি বলছে এসব তুমি। তোমাকে এসব কথা বলতে নিষেধ করেছিল অর্ণব। অর্ণব কখনোই চাইত না আমাদের ভালোবাসার সম্পর্কের কথা কেউ জানুক। এজন্য কখনো কারো সাথে শেয়ার করিনি। যে মানুষটা আমাকে নিয়েই সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে তার অন্যদিকে মন কখন যাবে তাই আমি তাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছি। কিন্তু যখন অর্ণব বিয়ের পিঁড়িতে বসলো তখন জানতে পারলাম যে মেয়ের সাথে বিয়ে হচ্ছে সেই মেয়ের সাথে ১০ বছরের প্রেমের সম্পর্ক এই বলে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো অর্পা। 

সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা আমার নেই কারণ আমি নিজেই ভেঙে-চুরে গেছি। অর্পা তো কাঁদতে কাঁদতে প্রকাশ করে হালকা হতে পারছে কিন্তু আমি তাকে বলবো? কার কাছে কাঁদবো? আমি পাথরের মতো বসে থাকলাম। বাসায় ফিরে দরজা বন্ধ করে চিৎকার করে কাঁদতে থাকলাম। অর্ণব অনেকগুলো কল করেছে, টেক্সট করেছে কিন্তু কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। সারারাত বসে কাটিয়েছি, এক ফোঁটা ঘুমাতে পারিনি। 

ভোরবেলা অর্ণব আমার বাসার নিচে হাজির। আমি নিজেকে সামলে বাসার নিচে গেলাম। অর্ণব পাগলামি শুরু করলো। আমি কোনো কথার উত্তর না দিয়ে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমাকে বলল বাইকে ওঠো। কিছু না বলে উঠলাম। হয়তো এটাই অর্ণবের সাথে শেষ সকাল দেখা। রাস্তার দু’ধারের কৃষ্ণচূড়া আজ আর মুগ্ধ করছে না আমায়। মনে হচ্ছে গাছে থোকায় থোকায় রক্তাক্ত হূিপণ্ড। আমাকে নিয়ে সেই শান্ত জলের কাছে বসলো। কিন্তু আমার বসতে ইচ্ছা করছিল না। আমি উঠে দাঁড়ালাম। অর্ণব আকুতি-কাকুতি ভালোবাসা অস্থিরতা সবকিছুই প্রকাশ করল। কিন্তু মিথ্যা, ছলনা, প্রতারণা, ছলচাতুরী নিজ মুখে প্রকাশ করল না। 

অনেকক্ষণ চুপচাপ পাগলামি দেখছিলাম অর্ণবের। বরাবরের মতো আজও আমার হাতটা তার বুকের কাছে নিয়ে বলল অনু কখনো ছেড়ে যেও না। আমি তোমার সাথে বৃদ্ধ হতে চাই। আমার হৃদয় রক্তাক্ত তবুও মুখে কাষ্ঠ হাসি হেসে বললাম, তোমার প্রেম কৃষ্ণচূড়ার মতো জানান দিয়ে আসে। কিন্তু কৃষ্ণচূড়া তো একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আসে প্রতিবছর মনোমুগ্ধকর রূপ নিয়ে। সে সারা জীবনের জন্য কারো সাথে থাকতে পারে না। কৃষ্ণচূড়া আসলে তার মনোমুগ্ধকর রূপে সবাইকে প্রেমের বার্তা দেয়। অর্ণব তোমার আর কৃষ্ণচূড়ার মধ্যে পার্থক্য কি জানো? অর্ণব আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো। আমি বললাম কৃষ্ণচূড়া যতটুকু দেখায় ততটুকু সত্যি, ততটুকুই সৌন্দর্য। আর তুমি যতটুকু দেখাও তার কোনো কিছুই সত্য নয়। 

ভালো থেকো, খুব ভালো। যতটুকু ভালো থাকলে আমাকে আর কখনো মনে পড়বে না। তোমার সাথে আজকে আমার শেষ কথা এবং দেখা এই বলে আমি আমার গন্তব্যের দিকে পা বাড়ালাম। আমার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো অর্ণব। কোনো কথার জবাব দিতে পারেনি। আমি আর কৃষ্ণচূড়ার মতো প্রেম চাই না। আমি চাই বারোমাসি কোনো ফুল আমাকে প্রতিদিন মুগ্ধ করুক।


শারমিন হক। জন্ম ১১ জুলাই। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা থানার হারদি গ্রামে। বাবা-আমিরুল হক। মা-মিনু হক। স্বনামধন্য ইডেন মহিলা কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন এবং মহানগর ‘ল’ কলেজ থেকে এলএলবি শেষ করেন। ২০১৯ বইমেলায় তার শিশুতোষ শিক্ষামূলক দুটি বই ‘ভালো কাজের পুরস্কার’ এবং ‘অহংকারী গাছ ও উপকারী মৌমাছি’ প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাংলা প্রকাশ’ থেকে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অভিমানী’ জনতা প্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয় ২০২০ বইমেলায়। ভোরের কাগজ পত্রিকা এবং বিভিন্ন ম্যাগাজিনে তার গল্প, কবিতা নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। তার প্রথম গল্প গ্রন্থ ‘কোথাও কেউ ভালো নেই’।


মানবকণ্ঠ/এফআই