Image description

আজ আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস। প্রতি বছরের ন্যায় এবারো দিবসটি যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে। তবে আমাদের দেশের ঐতিহ্য ছিল একান্নবর্তী পরিবার। একান্নবর্তী পরিবারের শান্তি-স্থিতিও ছিল আলাদা। ৪/৫ ভাইয়ের ছেলে-মেয়েরা একসঙ্গে থাকছে, খাচ্ছে, স্কুল-কলেজে যাচ্ছে। কেউ কান্না করছে, কেউ তাকে থামাতে চেষ্টা করছে-কেউবা বড় মা’ বা ছোট মা’ কে ধরে খেতে চাচ্ছে।

ঘুমানোর সময় ভাই-বোনেরা মিলে ঘুমাচ্ছে। তার মধ্যে কে কোথায় কি করছে তা নিয়ে ঠাট্টা মশকরার মধ্যে কি আনন্দের জীবন কিন্তু এই জীবন চোখের সামনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতিতে যৌথ পরিবার নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকলেও এখন আর তেমনটা চোখে পড়ে না।

পুজির অসম বিকাশ ভেঙে দিয়েছে একত্রে থাকার সংস্কৃতি। আমরা অধিকাংশ লোকই যৌথ জীবন থেকে আসা। যৌথ পরিবার টিকে থাকার প্রথম ও শেষ কারণ একটাই তাহলো ত্যাগ বা মেনে নেয়া। দেখা গেল মাসিক খরচের হিসাবে সবাই সমান দিতে পারছে না, যারা পারছে তারা পুষিয়ে নিচ্ছে। তখন পরিবারে সংকট থাকে না। কিন্তু অর্থের হিসাবে যখন দেখা যায় একজন সংসারে বেশি দিচ্ছে তা স্ত্রী পছন্দ করছে না, বা দুজনেই পছন্দ করছে না; তখনই আলাদা থাকার বিষয়গুলো চলে আসে। বড় পরিবারগুলো যে এক-দুজনের জন্য টিকে থাকতো সে মানসিকতা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে ফ্ল্যাট কালচার।

ফ্ল্যাট বাড়িতে যেমন পাশের ঘরের কারও খবর যেমন কেউ রাখে না, ঘরের ভিতরেও এখন তেমন এক অমানবিক পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। সেখানে গড়ে উঠছে স্বার্থপর ও হতাশাগ্রস্ত এক সমাজ। যৌথ জীবনে বাড়ির মধ্যে সুখের ডানা মেলে ওড়াউড়ি আর নেই। চাচাতো, ফুফাতো ভাই-বোনেদের সমাগমে কত সংকট কিশোর-কিশোরীরা মিটিয়ে ফেলতো অভিভাবকরা সেসব টেরও পেত না। অথচ আজ সে পরিবার হারিয়ে খণ্ড খণ্ড হয়ে গেছে। মানুষের কষ্ট-দুঃখ ভাগাভাগি করার কেউ নেই। ফলে বাড়ছে হত্যা, আত্মহত্যা, কলহ-বিবাদ। শহর এখন গ্রামে ঢুকে গেছে। এক সময়ের দুরন্ত শৈশবকাল আটকে আছে ছোট ইটের ঘরের বারান্দার গ্রিলে। সেখানে পাখি নেই, বিড়াল নেই, কুকুর নেই।

মানুষ প্রাণীর সমন্বয়ে যে মানবিক সমাজ গড়ে ওঠে সে বীক্ষাও হারিয়ে যাচ্ছে সমাজ থেকে। সমাজ গবেষকরা বলছেন, দেশের গ্রামাঞ্চলগুলোতে মাত্র ১০ ভাগের কম যৌথ পরিবার টিকে আছে কোনো মতে। আর কসমোপলিটন শহুরে জীবনে একান্নবর্তী পরিবার এখন আর চোখেই পড়ে না। ফলে যান্ত্রিক হয়ে গেছে পরিবার ও আত্মীয়তার বন্ধন। উৎসব কিংবা শোক ছাড়া কারও সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতও হয় না। আবার দেখা হলেও সেখানে ‘কেমন আছো’- জাতীয় কথাবার্তায়ই শেষ হয়ে যাচ্ছে কুশল বিনিময়।

অতীতের একান্নবর্তী পরিবারের পুরো চিত্রটাই ছিল আলাদা। একান্নবর্তী পরিবারের প্রাণ ছিল একজন কর্তা। সে বাবা, বড় ভাই, মেজ ভাই বা অন্য কেউ। তার কথায় চলতো পরিবার। সেই পরিবারে হাসি ছিল, গান ছিল, জোছনা দেখার সময় ছিল, বর্ষায় নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর অবকাশ ছিল। রাতে নানি, দাদা বা দাদিকে কেন্দ্র করে বসতো গল্পের আসর। সে এক ভিন্ন আমেজ ছিল। বাড়ির কর্তা যিনি তিনি ঠিক রাখতেন কবে কি খাওয়া হবে, কি বাজার হবে ইত্যাদি। পরিবারের এই কর্তা বটবৃক্ষের মতো পুরো পরিবারকে ছায়া দিয়ে রাখতেন। আগলে রাখতেন ঝড়-ঝাপটা থেকে। প্রতিটি পরিবার ছিল ভালোবাসার সুতোয় গাঁথা। তবে এগুলো সবই এখন রূপকথা। ধীরে ধীরে সেই বটবৃক্ষের ছায়া থেকে অনেক দূরে সরে গেছে পারিবারিক জীবন। কবি পূর্ণেন্দু পত্রীর ভাষায়: ‘একান্নবর্তীর দীর্ঘ দালান-বারান্দা ছেঁড়া কাগজের কুচি হয়ে গেল..’।

মানুষ গ্রাম ছেড়ে চাকরির জন্য শহরে আসার মধ্য দিয়ে কম মানুষের স্বাদ পেয়ে তার শহর কেন্দ্রিক পরিবার গড়ে উঠল। বাড়িতে টাকা পাঠানোর রেওয়াজ বন্ধ হলো। এভাবে এক ঘরের তিন ভাই হয়তো শহরে বাসা নিয়ে কম মানুষে ভালো থাকার চর্চা শুরু করল। ছোট পরিবার হলে কত সুখ- সংকটের কথা কেউ ভাবলো না।

 পরিবার ছোট হলে বেশি খাওয়া যায়, যেমন ইচ্ছা ঘোরা যায়। অনেক লোকের মধ্যে দম ফেলাও কষ্ট- এ ভাবনা থেকেই ভাঙতে শুরু করে একান্নবর্তী পরিবার। আমরা নব্বই দশকের শুরুতে টিভি বিজ্ঞাপন দেখতামÑ মজা করে খেতে চাও, দরোজা বন্ধ করে খাও।’ এর মধ্য দিয়ে আমরা যে অশনি সংকেত পেলাম তাহলো পুঁজির বৈষম্য আর জাগতিক আরাম আয়েশের জন্য দুর্বল আয়ের সদস্যদের রেখে আরেক ধরনের পরিবার তৈরি হচ্ছে। যেখানে দরোজা বন্ধ করে মজা করে খাওয়া যায়। এভাবে মানুষ একাকীত্বে সুখ খুঁজতে লাগল। কিন্তু একা থাকার মধ্য দিয়ে যে কত বিপত্তি শুরু হলো তা কে বলবে?

মানুষ একা হওয়ার মধ্য দিয়ে সমাজ ক্রমশ ক্রুর-অমানবিক হয়ে গেছে। আমরা ছোট বেলায় একটা লেখা পড়েছিলাম-একতাই বল। একজন বাবা তার সন্তানদের সবাইকে একটি লাঠি ভাঙতে বলল। সবাই সহজেই ভেঙে ফেলল। কিন্তু অনেকগুলো লাঠি দিয়ে বলল এবার ভাঙো। কেউ পারল না। বাবা সবাইকে বোঝালেন একা থাকলে যে কেউ তোমার ক্ষতি করতে পারবে। একতাবদ্ধ থাকলে পারবে না। আজকে সমাজের যত অসঙ্গতি সব একতার অভাবে। তারপরও একান্নবর্তী পরিবার আর সমাজে ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ জাপানের মতো উন্নত দেশেও একান্নবর্তী বা যৌথ পরিবারের সংখ্যা বেশি। সেখানে তো বিশ্বায়নের প্রভাব আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। তারপরও তারা এটা ধরে রেখেছে এবং এর সুফলও ভোগ করছে। সেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে যৌথ পরিবার ধরে রাখার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে। আমরাও তাদের অনুসরণ করতে পারি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফাতেমা রেজিনা বলেন, একান্নবর্তী পরিবার ছিন্ন জীবন সংসার এখন পাখির বাসার মতো। একটি-দুটি ছোট ঘর, ছোট সংসার, ছোট পরিবার; যেখানে বসবাস করে কেবলমাত্র মা-বাবা আর তাদের এক বা দুটি ছেলে-মেয়ে। যেখানে নেই তেমন আনন্দ; সবই যন্ত্রের মতো, নিরানন্দ, নিঃসঙ্গ। পূর্বের সেই একান্নবর্তী পরিবারে যারা কর্তা-কর্তীর ভ‚মিকা পালন করতেন, বর্তমান একক পরিবারে তাদের উপস্থিতি মেহমান হিসেবেই গণ্য করা হয়; ঠিক যেন বাইরের লোক। ফলে তারা যে পরিবারের সদস্য সেটা শিশুরা জানছেই না, ওদের মধ্যে দাদা-দাদি, চাচা-ফুফিদের প্রতি কোনো ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ বা সহনশীলতা গড়ে উঠছে না।

এই না জানার মূলে রয়েছে ওদের বাবা-মা। এই সময়ের পরিবারের সন্তানগুলো বৈবাহিক সম্পর্কে জড়ানোর অল্পকিছু দিনের মধ্যেই তার শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বামী-স্ত্রী দুজনের একক পরিবার গড়ে তুলছে; বাদ যাচ্ছে না পরিবারের একমাত্র ছেলেটিও। বৃদ্ধ বাবা-মাকে ছেড়ে নিজেরা আলাদা থাকতেই আজ তারা বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। যার ফলশ্রæতিতেই বাড়ছে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা। এছাড়াও বর্তমান সমাজে যে অসহযোগিতার চর্চা দেখা যাচ্ছে তার জন্যও খানিকটা এই একক পরিবারব্যবস্থা দায়ী। পরিবার, সম্পর্ক, হƒদ্যতা ক্রমশ চলে যাচ্ছে হাতের মুঠোয়। মোবাইল ফোন, ট্যাবের মনিটরে পড়ে থাকছে শৈশব তারুণ্য। পরিবারকেন্দ্রিক যে সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের শীতল পরশে সিক্ত হতো সবাই, সেখানে এখন জমেছে বিচ্ছিন্নতায়ভরা কালো ধূসর আস্তর।

স্নেহ-ভালোবাসা-আবেগের পলেস্তরাগুলো যেন কেমন অচেনা ছত্রাকে ঢেকে যাচ্ছে। চুনকামহীন একান্নবর্তী পরিবারের সেই কোমল ছোঁয়া আজ বিমর্ষ অনুভ‚তির ছাঁটে পূর্ণ। নাগরিক জীবন এখন একচিলতে বারান্দা, ছোট একটা জানালা আর মুক্ত আকাশবিহীন আচ্ছাদনের ঘেরাটোপে আবৃত হয়ে আছে। পারিবারিক সম্পর্কের স্বপ্ন এখানে ধুলো জমা পিয়ানো, গিটার, ভায়োলিন, হারমোনিয়ামের অবয়বের মতো অবরুদ্ধ। এখন ‘সেলফ ফ্যামিলি ম্যানারিজম’ সবাইকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। সবমিলিয়ে পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থায় সংকটে পড়ছে ছোট পরিবারগুলো! ছোট হয়ে যাওয়া পরিবার সংকটে পাচ্ছে না কাউকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, আধুনিক শিক্ষার প্রভাব, নগরায়ণ ও শিল্পায়ন, কর্মসংস্থানের সুযোগ, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের ফলে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে একক পরিবার হচ্ছে। এটি স্বাভাবিক ক্রিয়া। তবে এই সামাজিক পরিবর্তনকে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি প্রয়োজন। নতুবা মানুষের আন্তরিকতা এবং সম্প্রীতি দিন দিন কমতেই থাকবে। যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে যাওয়ার কারণ অনেক।

আধুনিক শিক্ষার প্রভাব, নগরায়ণ ও শিল্পায়ন, কর্মসংস্থানের সুযোগ, পুঁজির অসম বিকাশ ছাড়াও একা থাকার প্রবণতা ও আত্মকেন্দ্রিকতাও এর জন্য দায়ী। তারপরও যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে যাওয়ার পর সমাজ ক্রমশ অমানবিক ও ক্রুর হয়ে উঠছে। পারিবারিক অশান্তি, কলহ, বিবাদ ও অবিশ্বাসের ঘটনা বাড়ছে। সুস্থ সমাজের জন্য চাই সুস্থ পরিবার। এ কারণেই যৌথ পরিবার আবারও ফিরবে-মানুষের প্রয়োজনে।

মানবকণ্ঠ/এআই