এটা সত্য স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা ব্যবস্থা ও পদ্ধতির আধুনিকীকরণ হয়নি বরং জনসংখ্যার নিরিখে যে ব্যবস্থাটুকু আছে তা যেমন অপ্রতুল, তেমন শোচনীয়।
“অসাধারণ” মানুষের কথা বলছি না, তারা ভাগ্যবান-অর্থ ও পদের জোরে স্বদেশ, বিদেশ এবং আধুনিক চিকিৎসার সবটুকুই গ্রহণ করতে পারেন তারা, অমরত্ব তাদের হাতের মুঠোয়। সাধারণত বাংলাদেশি বলতে যাদের বুঝায়, কি গ্রামে কি শহরে তাদের জন্য আয়োজিত চিকিৎসা ব্যবস্থা সারা দেশ জুড়ে বিভিন্ন রকম। এ সম্বন্ধে কোনো যোগ্যতা ও পারদর্শিতার মাপকাঠি নেই-ধর্ম, অর্থ থেকে শুরু করে রাজনীতি পর্যন্ত কোন বিচার বিধান থাকলেও গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যে স্বাস্থ্য সম্বন্ধে আমাদের ভাবনা চিন্তা খুবই সীমাবদ্ধ।
সুস্বাস্থ্য বলতে শিক্ষিত থেকে অশিক্ষিত, ধনী থেকে দরিদ্র এবং সচেতন থেকে নির্লিপ্ত মানুষ-প্রায় সকলেই রোগ বা অসুখ হলে উপযুক্ত বা সাধ্যমতো চিকিৎসার কথা ভাবেন। রোগ প্রতিষেধক বা রোগ প্রতিরোধ কর্মসূচি সরকারি ঢাক-ঢোল পিটিয়ে প্রচার অভিযান বা আলোচনা সভাতেই অধিকাংশ সময়ে সীমাবদ্ধ থাকে। সরকারি অর্থ ও বলে বলিয়ান কিছু পন্ডিতের জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য দেশ থেকে ম্যালেরিয়া, বসন্ত, এইডস বা শিশু মৃত্যুর হার কতটা কমিয়েছে তার হদিস বা হিসাব মিলা কঠিন। মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তের জটিল ব্যাধির সমস্যা একমাত্র ‘কপাল’নির্ভর!
অশিক্ষিত সাধারণ নিম্নবিত্ত, অর্ধশিক্ষিত বা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এমনকি উচ্চবিত্ত সম্প্রদায়ের মানুষও রোগ ভোগ বা রোগ-যন্ত্রণা থেকে মুক্ত থাকার স্বাভাবিক পরিস্থিতি বলে মনে করেন না। অসুখ দেহের বা মনের হতেই পারে, যাতে না হয় তার জন্য শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বিধি পালন করা দরকার। অসুখ হলে চিকিৎসার প্রয়োজন। আর তার জন্যও কমবেশি খরচ আছে একথা আমরা কি মনে রাখি। আমরা ধনী, দরিদ্র সকলেই সংসার নির্বাহের জন্য ‘বাজেট’ করি, কিন্তু তার মধ্যে সরকারি বাজেটের মতো চিকিৎসা সংক্রান্ত খরচ প্রায় থাকেই না। তাই টিভি থেকে শুরু করে ছেলেমেয়ের লেখাপড়া বা খাওয়া-পরা, ফুর্তি আহ্লাদের জন্য ব্যয় বরাদ্দ থাকলেও হঠাৎ অসুখ-বিসুখের খরচ সামলানো কষ্টকর হয়ে ওঠে। আবার দেখা যায় নিজের পাশে অবস্থিত সরকারি হাসপাতালে ৪০/৫০ টাকা দিয়ে টিকেট করতে হলে বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা অথবা ওষুধ কিনতে হলে আমরা রেগে যাই, সরকারের সমালোচনায় মুখর হই। কিন্তু অন্য দেশে চিকিৎসা করাতে অকৃপণ হাতে খরচ করি। প্রতিবেশী দেশে চিকিৎসা করাতে গিয়ে অনেককেই অসুবিধায় পড়তে হয়েছে, ওখানে চিকিৎসা ও কর্মীদের ব্যবহার সব সময় যে রসে বসে মাখা নয় সে অভিজ্ঞতা কিন্তু অনেকেরই আছে- তবে সে নিয়ে বিতর্কে গিয়ে লাভ নেই।
নিম্নবিত্ত দরিদ্র মানুষের এখনও অধিকাংশ চিকিৎসককেই তাদের ভরসা বলেই মনে করেন। তাদের চাহিদা বিনে পয়সায় বা কম খরচে চিকিৎসা। আপনারা গরিবকে না দেখলে কে দেখবে-এ ধরনের নির্ভেজাল মনোভাব নিয়েই তারা চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন। কিন্তু এরাই অন্য কোন অসুবিধা বা বিপদের সময় উকিল সাহেব থেকে শুরু করে পলিটিশিয়ানদের এ সহজ সরল সত্যটুকু বোঝতে পারেন না। এ কথা ঠিক বেশ ক’বছর আগেও অনেক প্রথিতযশা চিকিৎসক বিনা পারিশ্রমিক বা অল্প টাকার বিনিময়ে দুঃস্থ মানুষের চিকিৎসা করতেন। সত্যি বলতে কি “ভোগবাদ” বা ‘পণ্য মানসিকতা’ তখন সমাজকে তেমন একটা গ্রাস করেনি। আজকের দিনে চাহিদার শেষ নেই। চিকিৎসকরা অন্য কোনো ‘স্বর্গীয়’ গ্রহের মহাপুরুষ নন, তারাও রক্ত মাংসের জীব আমাদের সমাজেরই অংশ বিশেষ। তাই তাদেরও চাহিদা, আশা আকাক্সক্ষা বেড়েছে। আর এখান থেকেই শুরু হয়েছে দ্বন্দ্ব।
আগেকার দিনে অনেক চিকিৎসক যারা ‘সাধারণ চিকিৎসক’ বা ‘পারিবারিক চিকিৎসক’ হিসাবে পসার লাভ করেছেন, তাদের বাবা মায়েরা বলেছেন, ‘বাবা গরিব-দুঃখীর বন্ধু হয়ে থেকে তাদের সেবা করবে’। তারা অনেকেই প্রাণপাত পরিশ্রম করে, নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ভুলে হাটে বাজারের চিকিৎসক হিসাবে নিজের গ্রাম বা শহরতলির স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ‘প্রাণ’ ছিলেন। কিন্তু আজকের দিনে চিকিৎসা ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ ও নতুনত্বের যুগে চিকিৎসা-পরিকাঠামো সম্পূর্ণভাবে বদলে গেছে।
আজকাল ‘সাধারণ চিকিৎসক’, ‘গৃহ বা পারিবারিক চিকিৎসক’দের ওপর ভরসা উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত মানুষেরা করেন না। ‘ডিগ্রি ডিপ্লোমা’ বা ‘স্পেশালইজেশন’ নির্ভর মানসিকতা ‘সাধারণ চিকিৎসকদের’ হীনবল বা অনেক সময় ‘দায়সারা’ বিশেষ” নির্ভর করে থাকে। একজন চিকিৎসককে অনেকেই ‘পারিবারিক বন্ধু বা ‘শুভানুধ্যায়ী’ হিসেবে পেতে চান। কিন্তু আজকাল এ ধরনের পারিবারিক চিকিৎসকদের বড়ই অভাব। প্রশংসা, প্রতিপত্তি ও আর্থিক সচ্ছলতা অনেকের মাথা ঘুরিয়ে দেয়, বিশেষ করে নি¤œবিত্ত বা মধ্যবিত্তদের হঠাৎ করে অর্থবান হওয়া বিপজ্জনক অবস্থার সৃষ্টি করে। ধরাকে সরা জ্ঞান করে তারা বিপদের সৃষ্টি করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে যেমন শরীরবিদ্যা, ভেষজবিদ্যা প্রভৃতি শিখতে হয় তেমনি রোগী ও রোগীর আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে আচার ব্যবহারও শিখে নেয়া অপরিহার্য।
অনেক চিকিৎসকের ব্যবহার ও আন্তরিকতা এমনকি উপস্থিতিতেও রোগ-যন্ত্রণার সাময়িক উপশম হয়, চিকিৎসকদের স্পর্শে যন্ত্রণা কমে যায়। একে বলা হয় ‘হিলিং টাচ’। যারা কৃতী ও সুচিকিৎসক তাদের এ গুণ থাকে। আগেকার দিনে স্বনামধন্য চিকিৎসকেরা শিক্ষক হিসাবে ছাত্রদের শুধু রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা পদ্ধতি শিখাতেন না, তারা সত্যিকারের ‘পেশাগত চিকিৎসক’ তৈরি করতেন। চিকিৎসা শাস্ত্রকে বিজ্ঞান বলা হলেও বিজ্ঞানের সব ধর্ম বা গুণাগুণ চিকিৎসা শাস্ত্রে থাকে না। একই ওষুধ যার গুণগত মান পরীক্ষিত তা সকলের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য বা একই কাজ করে না। এর জন্য অতি বড় চিকিৎসককে ভাগ্যনির্ভর বা নিয়তির ওপর ভরসা করে চিকিৎসা করতে হয়।
মানুষের সুচিকিৎসা ও রোগ নিরাময়ের প্রত্যাশা স্বাভাবিক নিয়মে বেড়েছে। অনেক অসুখ আগে আল্লাহর বিধান বলে মেনে নেয়া হতো, কিন্তু আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা ও পদ্ধতির জন্য দৈব বা ভাগ্যের দোহাই দিয়ে রোগ ভোগের অবসান বা শেষকে মৃত্যু বলে মেনে নিতে মন চায় না। এর জন্য অসুখ বা দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর ক্ষেত্রে অনেক সময় চিকিৎসককে দোষারোপ করা হয়। চিকিৎসায় অবহেলা বা ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হলে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে আইনের ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার এখন প্রতিষ্ঠিত। এ সব ক্ষেত্রে মেডিকেল কাউন্সিল চিকিৎসকের চিকিৎসা করার আইনি ছাড়পত্র বাতিল করতে পারেন।
এ বিষয়ে দ্বিধা বা মতবিরোধ থাকলেও কিছু করার নেই। তবে সাধারণ ও প্রভাবশালী সব মানুষকে এ বিষয়ে সুচিন্তিত ভাবনা-চিন্তা করে তবে মতামত প্রদান বা মন্তব্য করতে হবে। যে কোনো চিকিৎসকই তা সে ডিগ্রিধারী অথবা হাতুড়ে চিকিৎসক যেই হোক না কেন রোগীর রোগ মুক্তির চেষ্টা করেন। রোগীকে মেরে ফেলার বা হত্যা করার কোনো অভিপ্রায় কোনো ডাক্তারের থাকে না। কারণ রোগীকে ভালো করতে পারলে প্রসার বাড়বে, অর্থ উপার্জন হবে। তবে অজ্ঞতা বা ভুল চিকিৎসার জন্য রোগীর শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি এমনকি মৃত্যুও ঘটতে পারে। সেক্ষেত্রে চিকিৎসককে হয়রানি প্রমাণ হলে শাস্তি কি এড়ানো যাবে? চিকিৎসকেরা তো আর আইনের ঊর্ধ্বে নন। অবশ্য যে কোনো মৃত্যু হলেই চিকিৎসককে হয়রানি বা ভয় দেখালে সংকট বাড়বে, পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। যারা অর্থবান ও ক্ষমতাবান তারা এদেশের সর্বোত্তম চিকিৎসা, প্রয়োজনে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে নেবেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়? অনেকের আশঙ্কা মেডিকেল কাউন্সিল বা কোর্টের ভয়ে চিকিৎসকেরা ঝুঁকি নিবেন না। কথায় কথায় ডাক্তার বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা বলবেন হয়তো কিন্তু সর্বাধুনিক চিকিৎসা আশা করলে কিছু পরীক্ষা, এক্স-রে, সনোগ্রাফী তো করতেই হবে। রোগী ও তার আত্মীয় স্বজনদেরও বুঝতে হবে প্রথমে রোগ নির্ণয় ও পরে চিকিৎসা নাকি রোগীর রোগ লক্ষণের উপশম, কোনটা জরুরি।
অনেক রোগের প্রাথমিক লক্ষণ দেখে রোগ নির্ণয় করা যায়। আবার কিছু অসুখে বেশ কিছুদিন পর প্রকৃত রোগ ধরা পড়ে। সুতরাং চিকিৎসকদের ‘ক্লিনিক্যালি আই’ ও ভাবনা-চিন্তার ওপর নির্ভর করতে গেলে রোগ নির্ণয়ের জন্য কয়েকদিন অপেক্ষা করতেই হবে। আগেই বলা হয়েছে অর্থ ব্যয় হবে না অথচ সর্বাধুনিক চিকিৎসা হবে-তা হয় না। চিকিৎসককেও এ ব্যাপারটা রোগী ও তার সঙ্গের লোককে বুঝিয়ে বলে দিতে হবে। এজন্য কিছুটা সময় দিতে হবে। একথা ঠিক যে সব চিকিৎসক রোগের সব কথা খুলে বলেন, শল্যচিকিৎসার ভাল-মন্দ দিক বুঝিয়ে অনেক সময় রোগী ও তার সঙ্গীরা তাতে অজ্ঞতা ও ভয়ে অন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে চলে যান। তাতে সাময়িক আর্থিক ক্ষতি হয়তো হয়, কিন্তু নিজের কাছে পরিষ্কার থাকা যায়।
অনেক প্রতিভাবান সুচিকিৎসককে এক শ্রেণির মানুষ প্রভাবিত করে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেন। ব্যবসায়িক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ভেবে ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থার কর্মচারী থেকে শুরু করে ল্যাবরেটরি ইত্যাদির কর্মী, এলাকার রাজনৈতিক নেতা বা সরকারী আমলা সকলেই এ সুযোগ নিয়ে থাকেন। অর্থ ও প্রতিপত্তির লোভ দেখিয়ে তারা চিকিৎসকদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে থাকেন। সহজে উঠতি বা প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসকেরা এদের হাতের মুঠোয় চলে যান। এক চিকিৎসকের কাছে অপর চিকিৎসকের পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনের কুৎসা রটনা করা খুবই গর্হিত কাজ। দুর্ভাগ্যবশত নিজের পদ ও প্রমোশন বজায় রাখার জন্য অনেক সরকারি চিকিৎসক, মন্ত্রী আমলাদের হাতের ক্রীড়নক হয়ে যান। এমনকি ‘নন প্র্যাকটিসিং ভাতা’ নিয়ে প্র্যাকটিসও করেন। এসব কিছুকে সহ্য করে পেশাগত ন্যায়-পরায়ণতা ও সততা বজায় রেখে চিকিৎসকদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। অন্যের ভুল বা সমালোচনা থেকে নিজেকে সঠিক রাখার দিকে নজর দিলে উপকার হবে। বর্তমানে চিকিৎসা ও চিকিৎসকদের এ সাময়িক সমালোচনা ও বিরূপ মন্তব্যে বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই। দেশ, সমাজ ও কালের পরিবর্তন হচ্ছে। ভোগবাদী ও পণ্যনির্ভর জীবনযাত্রা এবং মানুষের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা ও উৎকণ্ঠাময় জটিল জীবনধারা অনেক কিছুর সংস্থা ও ব্যাখ্যা পাল্টে দিচ্ছে।
চিকিৎসা ও চিকিৎসকদের কাছে স্বাভাবিক কারণে মানুষের প্রত্যাশা, আশা-আকাক্সক্ষা পরিবর্তিত হয়েছে। চিকিৎসক তার সাময়িক ভুলের জন্য কাঠগড়ায় দাঁড়াবেন, প্রয়োজনে জেল জরিমানা দুই-ই তার প্রাপ্য। এ কথা ভাবতে বা মেনে নিতে মন চায় না, কিন্তু চিকিৎসার এ অসুখে মনকে এ নির্মম সত্য মেনে নিতে হবে। এ পথ ও মত ঠিক না ভুল আগামী দিনই তা বুঝিয়ে দিবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
Comments