
গুলশান লেক, ধানমণ্ডি লেকসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো ক্যাম্পাসজুড়ে একসময় টিয়া পাখিতে পরিপূর্ণ ছিল। বর্তমানে অপরিকল্পিত নগরায়ণে পুরো ঢাকা থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে টিয়ারা। খাদ্যাভাব, আবাসস্থলের সংকট, দূষিত পরিবেশ, চোরা শিকার টিয়া জাতীয় পাখিদের সংখ্যা আজ অনেকটা কমিয়ে দিয়েছে এ শহর থেকে।
বাংলাদেশে বর্তমানে ৭০০ এর অধিক প্রজাতির পাখি রয়েছে। প্রায় সবার কাছে অতি প্রিয় সুন্দরতম পাখিরা হলো টিয়া জাতীয় পাখি। পৃথিবীতে প্রাপ্ত টিয়া পাখির সংখ্যা প্রায় ৪০০ এর মতো। যারা তাদের অপূর্ব বর্ণ শরীরের আকারে সর্বমহলে সমাদৃত। আর এই সাত প্রজাতির পাখির মধ্যে ঢাকা শহরে দেখা মেলে চার প্রজাতির।
বাংলাদেশে সবথেকে বড় আকারের টিয়ার নাম চন্দনা টিয়া। চন্দনা টিয়া নামটি সম্রাট আলেক্সান্ডারের নাম থেকে নেয়া। তার সময়ে এই পাখিটি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম সিটাকুলা ইউপ্যাটরিয়া। পাখিটির দৈর্ঘ্য ৫৩ সে.মি.। বিশাল লাল চঞ্চুর শেষ প্রান্ত কমলা। কাঁধে লালচে পট্টি। লম্বা সবুজ লেজের কিছু অংশ নীল ও হলুদ। পুরুষের থুতনিতে কালো রেখা, আর গলায় ঘাড়ে গোলাপি বলয়। দিবাচর এই পাখি, একাকী অথবা ছোট দল সহকারে ঘোরে।
সাধারণত ফল, শস্য, বীজ, ফুল ও মধু খেয়ে থাকে। ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল মাস প্রজনন ঋতু। গাছের গর্ত বা বিল্ডিং এর ফাঁকে বাসা তৈরি করে। বাংলাদেশে এটি বিরল আবাসিক পাখি হিসেবে গণ্য। ২০০০ সালের আইইউসিএন বাংলাদেশ এর তথ্যমতে ‘মহাবিপন্ন’ পাখিদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হলেও বর্তমানে ২০১৫ সালের তথ্য মতে পাখিটি ‘ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত’-এর আওতায়। ঢাকা শহরে একটি সময় ভালো সংখ্যায় এই পাখিটি থাকলেও বর্তমানে এদের সংখ্যা অনেকটা কমে গিয়েছে।
ঢাকা শহরের বড় বড় সবুজ আচ্ছাদন সমৃদ্ধ স্থান, বড় বিল্ডিং এর ফোঁকরে দেখা মেলে এদের। কিন্তু সংখ্যায় কম। ঢাকার বাইরে বৃহত্তর রাজশাহী, বগুড়া, ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর অঞ্চলেও দেখা মেলে এই পাখির। পাখিটি বাংলাদেশে ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও বিস্তৃত। সারা বিশ্বে পাখিটি আইইউসিএন-এর তথ্য মতে ‘প্রায় বিপন্ন’ অবস্থায় রয়েছে। পাখিটি ৩০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।
বাংলাদেশে সচরাচর সব স্থানে দেখতে পাওয়া টিয়ার নামটি শুধুই টিয়া বলি, যার ইংরেজি নাম রোজ-রিংড প্যারাকিট ও বৈজ্ঞানিক নাম সিটাকুলা ক্রামেরিয়া। আকারে বড় প্রায় ৪২ সে.মি.। সবুজ দেহ। দীর্ঘ সবুজ সরু লেজে নীল আভা। পুরুষের থুতনিতে কালো রেখা, আর গলায় ঘাড়ে গোলাপি বলয়, হলদে সাদা চোখ। লাল চঞ্চু। জানুয়ারি থেকে জুলাই এর মধ্যে এরা প্রজনন করে।
ঢাকা শহরে গাছের ফোকর, বিল্ডিং এর বিভিন্ন গর্তে এরা বাসা তৈরি করে। ফলভুক পাখিটি আমাদের দেশের আবাসিক পাখি। মদনা টিয়া যার বৈজ্ঞানিক নাম সিটাকুলা আলেকজান্দ্রি। পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটকে স্মরণ করে দেওয়া, যার সেনাবাহিনী গ্রিক অঞ্চলে এই প্রজাতির পাখি নিয়ে এসেছিল। ঢাকায় এখন প্রায় এই পাখির দেখা মেলে বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, রমনা পার্ক, শেরেবাংলা নগর, মিরপুর এলাকায়। তবে এদের ঢাকা শহরের কোথাও প্রজননের কোন হদিস এখনও মেলেনি।
লালমাথা-টিয়া- যার বৈজ্ঞানিক নাম সিটাকুলা সায়ানোসেফালা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের বিজ্ঞান কারখানার সামনের বট গাছে সাধারণত সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাসে বটফল পাকলে একঝাঁক লালমাথা টিয়া বা হিরামন টিয়ার দেখা মেলে প্রতিবছর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও মিরপুর, উত্তরায় এই পাখিটির দেখা মেলে। রূপকথার সেই হিরামন নামে পরিচিত পাখিটি লাল মাথা টিয়া। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এদের প্রজনন মৌসুম। ঢাকা শহরের নগরায়ণ বর্তমানে আশপাশে অনেক বেশি বর্ধিত হচ্ছে, যার ফলে দেশি বুনো গাছ, শষ্যক্ষেত ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে, ফলে খাদ্যাভাবে টিয়া গুলো হারিয়ে যাচ্ছে ঢাকা শহর থেকে। এছাড়া শিকারির ফাঁদ, চোরা শিকার সহ বিভিন্ন কারণে কমছে টিয়াদের সংখ্যা। আমরা সচেতন না হলে হয়ত অচিরেই হারিয়ে ফেলবো আমাদের এই টিয়াদের।
মানবকণ্ঠ/আরএইচটি
Comments