Image description

বাংলাদেশে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি শ্রমবাজারে পুরুষ শ্রমিকের হার বৃদ্ধির তুলনায় বেশি। পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী বিগত বছরগুলোতে শ্রমবাজারে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনগুলোর একটি হচ্ছে শ্রমবাজারে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীর অংশগ্রহণ।

ইতিবাচক বিষয় হচ্ছে, গ্রামীণ নারীদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের হার শহরের নারীর তুলনায় বেশি। আবার পোশাক খাত ছাড়াও এখন হোটেল, রেস্টুরেন্ট, যোগাযোগ খাত, রিয়েল এস্টেট সেবা, টেলিকমিউনিকেশন, ব্যাংকিং, ইন্স্যুরেন্স খাতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের মোট পোশাক শ্রমিকের মধ্যে নারীর সংখ্যা বেশি। পোশাক খাতের পরই প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশি নারী শ্রমিকরা দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বিদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে গত দুই বছর নতুন রেকর্ড হয়েছে। তবে এর মধ্যেও কমেছে নারীর কর্মসংস্থান। প্রতি মাসে গড়ে লাখের বেশি কর্মী গেছেন বিভিন্ন দেশে।

গত বছর ২০২৩ সালে বিদেশে মোট কর্মী গেছেন ১৩ লাখের বেশি। এর মধ্যে নারী কর্মী গেছেন ৭৭ হাজার ২৬৩ জন। এ ছাড়া গত বছর প্রতারিত হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন তিন হাজার নারী কর্মী। অভিবাসন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সৌদিতে নারী কর্মী পাঠানোর আগে প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক থাকলেও তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানা হয় না। আবার প্রশিক্ষণের মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। প্রতিবছর অনেক নারী দেশে ফিরে নির্যাতন-নিপীড়নসহ নানা অভিযোগ করছেন। এ কারণে নারী কর্মী পাঠানো কমে গেছে বলে মনে করছেন তারা। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, দুই বছরের চুক্তিতে সৌদি গেলেও তা শেষ হওয়ার আগেই ফিরে আসছেন কেউ কেউ। অধিকাংশই পালিয়ে এসে সেফ হোমে আশ্রয় নেন। দূতাবাসের সেফ হোম থেকে তাদের সৌদি সরকারের সেফ হোমে পাঠানো হয়।

বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, এক বছরে সর্বোচ্চ ১ লাখ ২১ হাজার ৯২৫ জন নারী কর্মী বিদেশে যান ২০১৭ সালে। এর আগের বছর এটি ছিল ১ লাখ ১৮ হাজার ৮৮ জন। এর আগের বছরেও এক লাখের বেশি ছিল বিদেশে নারীর কর্মসংস্থান। বছরে এক লাখের বেশি কর্মী পাঠানোর এ ধারা অব্যাহত ছিল ২০১৯ সাল পর্যন্ত। ২০২০ সালে করোনা ভাইরাস মহামারি শুরুর পর এটি কমতে থাকে। পরের দুই বছর আবার ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। ২০২২ সালে এটি এক লাখ ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু গত বছর কমে গেছে। ১৯৯১ সাল থেকে বিভিন্ন দেশে নারী কর্মী পাঠানো শুরু হয়। নানারকম নির্যাতনের শিকার হয়েও প্রতিবছর এই নারীরা সৌদি আরব, জর্ডান, কাতার ও ওমানসহ বিভিন্ন দেশে কাজ করতে যাচ্ছেন। আবার কৃষি খাতেও নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখ করার মতো। কৃষি তথ্য সার্ভিস থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, দেশে মোট কর্মক্ষম নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় কৃষিকাজে নিয়োজিত। আশার কথা হচ্ছে প্রবাসী আয় প্রাপ্তির দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে অষ্টম। আর এ অবস্থান নিয়ে যেতে দেশের নারী শ্রমিকরাও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছেন। অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তারাও। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) সূত্রে, বর্তমানে দেশে ৩ লাখ মানুষ অনলাইনে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। আর এদের অর্ধেকই নারী ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তা। এই উদোক্তারা নিজের পণ্য বিক্রির মাধ্যমে মাসে সর্বনিম্ন ১০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করছেন। ফেসবুকে নারী উদ্যোক্তাদের বড় পেজ উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই) ২০১৭ সালে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে এই পেজের সদস্য সংখ্যা ১১ লাখের বেশি। দেশে গত এক দশকে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ বাড়তি শ্রমশক্তির মধ্যে ৫০ লাখই নারী।

পরিবারের সঙ্গে দেশের অর্থনীতিও সচল রাখতে লাখ লাখ নারী পোশাক শ্রমিক অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। আর নারী পোশাক শ্রমিকদের সেলাই মেশিনের চাকা সচল আছে বলেই বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির চালচিত্র। বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। আর পোশাক খাতের এই অভূতপূর্ব সাফল্য এসেছে নারী শ্রমিকদের কারণেই। বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার পেছনে শ্রমশক্তিতে নারীদের উচ্চতর অংশগ্রহণ একটি বড় ভূমিকা রাখছে। আর ভারত এদিক দিয়ে বাংলাদেশ থেকে যথেষ্ট পিছিয়ে আছে। বাংলাদেশের শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে তৈরি পোশাক খাত। এই পোশাক খাতকে নিয়েই বিশ্ববাজারে একটি ভালো স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশ। হিসাব বলছে, শ্রমশক্তিতে বাংলাদেশের নারীদের অংশগ্রহণের হার ৩২ শতাংশ, আর ভারতে এই হার মাত্র ২০ দশমিক ৩ শতাংশ।  বাংলাদেশ স্বল্প আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পেছনে নারীর এই অগ্রগতি মুখ্য ভূমিকা রাখছে। তাদের মতে, রাজনৈতিকভাবে সরকারের বড় দর্শন কাজ করছে যে, নারীকে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে বিশেষ করে সরকারি চাকরিতে সুযোগ করে দেয়া। সচিব, সিনিয়র সচিবসহ সরকারের অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এখন নারী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেমন-পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনীতেও উচ্চপদে নারীর অংশগ্রহণ দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ এখন পুরুষ সমকক্ষ কর্মক্ষেত্রগুলোতে নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। সরকার যদি রাজনৈতিক এই অবস্থা ধরে রাখে এবং বেসরকারি খাতকে যদি জেন্ডার সমতা বিষয়ক নীতিগত সিদ্ধান্ত পালনে বাধ্য করে তাহলে পুরুষ সমকক্ষ কাজেও সমভাবে দেখা যাবে নারীদের অংশগ্রহণ। বিগত এক দশকে বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নে বৈশ্বিক রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণে বাংলাদেশ ক্রমেই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সূচক বলছে, বাংলাদেশ লিঙ্গ সমতায় দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম স্থান অর্জন করেছে। আর এই সমতা নারীর অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ, শিক্ষার হার, স্বাস্থ্যের উন্নতি এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী। আর বিগত এক দশকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধির কারণে পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে নারীর সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা পাচ্ছে। নারীর শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতির কারণে আগের তুলনায় কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণও বেড়েছে।অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তিতে বাংলাদেশের নারী ও পুরুষের অবস্থা ও অবস্থান ভিন্ন। দেশকে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলে নারী ও পুরুষের অবস্থা ও অবস্থানের ব্যবধান দ্রুতই কমিয়ে আনতে হবে। জাতীয় বাজেট প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নকালে সরকার রাজস্ব আদায় এবং ব্যয় বরাদ্দের ক্ষেত্রে জেন্ডার সংবেদনশীল হলে সমাজে নারী-পুরুষের বৈষম্য নিশ্চিতভাবে কমে আসবে বলে মনে করি। জেন্ডার সমতাভিত্তিক সম্পদ বণ্টন নিশ্চিত হলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্যই সুযোগের সমতা তৈরি হয় এবং অনগ্রসর জনগোষ্ঠী উন্নয়ন ও অগ্রগতির মূলধারায় সম্পৃক্ত হয়। এ বিবেচনায় বাংলাদেশের সচেতন জনগোষ্ঠী জাতীয় বাজেটকে জেন্ডার সংবেদনশীল হিসেবেই দেখতে চায়। নারী-পুরুষের সমতা অর্জনকে বেগবান করতে হলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নারীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপক হারে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। নারী শিক্ষার মান উন্নয়ন, সৃজনশীল কর্মমুখী শিক্ষা এবং গবেষণায় নারীর অংশগ্রহণ ও অবদান প্রয়োজন। নারীবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণে বাজেট বরাদ্দ এবং বাস্তবায়নের সৃজনশীল উদ্যোগ প্রয়োজন। কেন্দ্রে এবং তৃণমূলে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন এখন সময়ের দাবি। সর্বোপরি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হতে চাইলে আমাদের সমাজের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির মূলধারায় সম্পৃক্ত করতেই হবে। নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টির সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করার উদ্যোগ থাকতে হবে বাজেটে, বিশেষ করে বাস্তবায়নে। নারী উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য ও সেবা বিপণন এবং বাজারজাতকরণে পর্যায়ক্রমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নারীবান্ধব অবকাঠামো গড়ে তোলা এবং কালক্রমে তা দেশের বাইরে সম্প্রসারণের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। বর্তমানে আমাদের সমাজে নারীরা গুণগত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, নিরাপত্তায় পিছিয়ে আছে। পারিবারিক জীবনে গৃহে যে নারী রাতদিন অসামান্য অবদান রেখে চলেছে জীবনভর, তার প্রতি উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করছি কি আমরা? নারী সহিংসতা, নির্যাতন, বঞ্চনা, নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন হরদম। আমরা কি নারীর পক্ষে সুবিচার সুনিশ্চিত করতে পারছি? এরকম আরো অনেক প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে কেবলই হতাশ হতে হয়। আমরা সেই হতাশা কাটিয়ে নারীর প্রতি যথার্থ সম্মান এবং তার প্রাপ্য সুনিশ্চিত করতে চাই। আশা করি, এ বিষয়ে সকল দল ও মতের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হবেন এবং নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় সবাই আন্তরিক হবেন। সাম্প্রতিক সময়ে সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনয়ন লাভ ও নির্বাচিত হওয়ার দৌড়ে বিভিন্ন অঙ্গনের নারীদের ব্যাপক তৎপরতা আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশেষ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। অতীতে এত ব্যাপক হারে তেমনটি দেখা যায়নি। এবার সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়ন লাভের প্রত্যাশায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীর বিপুল অংশগ্রহণ এবং তৎপরতা বাংলাদেশে নারী ক্ষমতায়নের একটি উজ্জ্বল দিক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। যে নারী রাঁধে সে চুলও বাঁধে। নারীরা আজকাল আর শুধুমাত্র ঘর সামলানোর কাজে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছেন না। তারা রাজনীতিতে আসছেন, চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন, প্রশাসনেও দক্ষতার প্রমাণ দিচ্ছেন। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিমানের পাইলট, পুলিশ কর্মকর্তা, সেনা কর্মকর্তা হিসেবেও তারা চৌকস। তবে জাতীয় সংসদে একজন সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণের আকাক্সক্ষা তীব্র হয়ে উঠেছে অনেকের মধ্যে। যার প্রমাণ, এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে সদস্য হিসেবে মনোয়ন লাভের জন্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মনোনয়নপত্র ক্রয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নারীর ক্ষমতায়ন নতুন জোয়ার সৃষ্টি করেছেন। সেই জোয়ারে এ দেশের নারীরা নতুন উদ্যমে জেগে উঠেছেন। সংরক্ষিত নারী আসনে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে এত অধিক সংখ্যক নারীর তৎপরতার মাধ্যমে এটা আরেকবার প্রমাণিত হয়েছে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলামিস্ট

মানবকণ্ঠ/এসআরএস