
পানি ছাড়া প্রাণের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। আমাদের জীবনধারণ, ইতিহাস-ঐহিত্য, সংস্কৃতি সবই পানি, নদী কেন্দ্রিক। নদীর ভাঙা গড়ার ভেতর দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে আমাদেও জীবনধারা। পৃথিবীর সূচনা থেকে আদি সভ্যতা ও মনুষ্য বসতি গড়ে ওঠেছে নদী কেন্দ্রিক। নদী তীরেই প্রাচীন শহর-সভ্যতা গড়ে ওঠে।
আবহমানকাল থেকেই এদেশের মানুষের জীবন-জীবিকা নদী নির্ভর। দেশের সভ্যতা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও জীবন জীবিকার ক্ষেত্রে অন্যতম নিয়ামক হলো নদী। নদ নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে যুগ-যুগান্তরের সভ্যতা। দেশে নদী ছড়িয়ে আছে জালের মতো, নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে মানুষের জীবন। নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে রাজধানী ঢাকা, প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁওসহ সকল শহর-নগর।
যাতায়াত মানেই ছিল নদীপথে যাতায়াত। নদীর জলে অবগাহন, নদীর জলে চাষাবাদ, মিঠা পানির মাছ, নদী কেন্দ্রিক যোগাযোগ যুগে যুগে দেশকে করেছে সমৃদ্ধতর। কেবল ভূখণ্ড সৃষ্টি আর দেশকে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলাই করেনি নদী; শুধু নয় বাংলার, বিশ্বের প্রায় সব সভ্যতার বিকাশও ঘটিয়েছে নদী।
একসময় মানুষের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যমই ছিল এ নদীপথ। ধীরে ধীরে প্রধান নদীগুলোর ওপর সেতু তৈরির মাধ্যমে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়ে উঠছে। যোগাযোগের সহজলভ্যতাই মানুষের উন্নয়নের পথ আরো সহজ করে তুললেও নদীমাতৃক এ দেশে বসবাস করে, নদীর গুরুত্বের কথা মনে রাখা বাঞ্চনীয়। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ পানি। সারাবিশ্ব যখন পানি সংকটে ভুগছে তখন আমরা এ সম্পদের উত্স নদ-নদীগুলোর সুরক্ষায় মনযোগ দিচ্ছি না। দেশের জনসংখ্যা ১৬৯.৪ মিলিয়ন। জনসংখ্যা অনুযায়ী দেশে খাদ্য উত্পাদন ব্যাপক হারে বেড়েছে। উত্তরাঞ্চলে কৃষির
ব্যাপক সম্প্রসারণ হয়েছে। ৪০০ কোটি বছরের এ প্রাচীন পৃথিবীতে বাংলাদেশের বয়স সর্বাধিক ৩ থেকে ৪ কোটি বছর। ভূমির উর্বরশক্তি ধরে রাখতেও শতাব্দীর পর শতাব্দী ভূমিকা রেখেছে নদী বিদৌত পলি মাটি। নদীর পানি যত স্বল্পই হোক, তার সঙ্গে আসে পলি। এর ফলে নতুন উর্বর শক্তিতে, বছর বছর নতুন যৌবন ফিরে পায় দেশের কৃষিভূমি।
ঐতিহাসিক সত্য হচ্ছে, বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। শাখা-প্রশাখাসহ প্রায় ৭০০ নদ-নদী বিপুল জলরাশি নিয়ে ২২,১৫৫ কিলোমিটার জায়গা দখল করে দেশের বিভিন্ন স্থান দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদ-নদীগুলোর উপনদী ও শাখানদী রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড এর হিসেব অনুযায়ী ২০১৩ সালে দেশে নদ-নদীর সংখ্যা ছিল ৩১০টি।
নদীর মোট দৈর্ঘ্য হলো প্রায় ২২,১৫৫ কিলোমিটার। সরকারি তথ্যমতে, দেশে নদ-নদীর সংখ্যা প্রায় ৮০০টি। বর্তমানে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪০৫টিতে। এভাবে নদীগুলো মরতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে নদীর অস্তিত্ব ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে।
নদীকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস। ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে’ থেকে আরম্ভ করে ‘আমায় ভাসাইলি রে আমায় ডুবাইলি রে’ চিরচেনা গানের প্রতিটি লাইনে নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদ-নদীর অপুরূপ সৌন্দর্য আমাদের জীবনের সঙ্গে সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে। নদ-নদীর এই নিরন্তর ছুটে চলার সঙ্গে আমরা জড়িয়ে আছি প্রাচীনকাল থেকেই।
নদী ও নদীপারের মানুষের জীবন সংগ্রাম নিয়ে পদ্মা নদীর মাঝির মতো কালজয়ী উপন্যাস। বাংলাদেশের প্রধান নদ-নদীগুলো হলো: পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, কর্ণফুলী, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, পশুর, সাঙ্গু, ইত্যাদি। নদীমাতৃক বাংলাদেশের জন্ম নদীর পানিতে বয়ে আনা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পলিকণা দিয়ে। লাখো বছরের প্রক্রিয়ায় পলি সঞ্চয় করে নদীই গড়ে তুলেছে ‘পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ’ বাংলাদেশ। প্রকৃতির দুটি উৎস থেকে পানি পেয়ে থাকে দেশের মানুষ। প্রথমটি নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় ও পুকুরের পানি। দ্বিতীয়টি ভূগর্ভস্থ পানি। প্রথমটির ওপর দ্বিতীয়টি সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল।
নদীমাতৃক দেশ বলেও বাস্তবে দেশের নদীগুলোকে ভরাট, দখল দূষণের মাধ্যমে বিপন্ন করে তুলছি। এছাড়া প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণেও নদীগুলো বিলীন হওয়ার পথে। হারিয়ে যাচ্ছে সবুজ নিসর্গ প্রকৃতি। রীতিমতো হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে মত্স্য প্রজাতি, প্রাণিকুল ও জীববৈচিত্র্য। নদীর সঙ্গে বিপদে পড়ছে নদীর ওপর নির্ভরশীল মানুষও। কৃষিপ্রধান উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ দেখা দিলে সেখানে সেচ চাহিদা মেটাতে হচ্ছে মাটির নিচের পানি তুলে। এতে করে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামছে, মাটির গুণাগুণ নষ্ট হচ্ছে। মিঠাপানির অভাবে হুমকিতে পড়েছে সুন্দরবন। লবণাক্ততা মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে সুন্দরবনসহ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে।
অন্যদিকে, সাম্প্রতিক সময়ে প্রাকৃতিক কারণে নদীভাঙনের হার আগের তুলনায় কমেছে। কিন্তু মনুষ্য সৃষ্ট কারণে বেড়েছে নদী ভাঙন। এর প্রধান কারণ নির্বিচারে বালু উত্তোলন। মানুষের লোভে, অসচেতনতায় নদীগুলো মরতে বসেছে। একইসঙ্গে কৃষি, প্রকৃতি ও পরিবেশ হচ্ছে বিপন্ন। নদী ভাঙনে প্রতিবছর হাজার হাজার পরিবার ভিটে বাড়ি হারিয়ে বাস্তচূত হচ্ছে। পাশাপাশি নদী দখল হচ্ছে দু’ভাবে, ভূমিদস্যুরা নদী ভরাট করে স্থাপনা তৈরি করছে। এবং শিল্প বর্জ্য নদীতে ফেলে নদীর পানিকে দূষিত করছে। দেশের নদী বিধৌত সব এলাকায় নদী, খাল-বিল অবৈধভাবে দখল হচ্ছে। ফলে পানিপ্রবাহের গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এতে নদ-নদী সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে।
বর্ষাকালে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হওয়ায় প্রতিনিয়ত বন্যা দেখা দেয়। আবার অতি বৃষ্টিতে শহরাঞ্চলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এতে নগরবাসির চলাচল বিঘ্ন ঘটে এবং পানিতে ডেঙ্গু মশার বিস্তার ঘটে। তাছাড়া উন্মুক্ত পুকুর, জলাশয়গুলো ভরাট হয়ে গেছে। অথচ একসময় দেশের মাছের চাহিদার প্রায় পুরোটাই জোগান দিত দেশের নদ-নদী, হাওর, বাঁওড় ও বিলগুলো। শিল্প, প্লাস্টিক বর্জ্য নদীতে ফেলার কারণে নদীর জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে, পানি দূষিত হচ্ছে। দূষিত পানির কারণে মানুষ নারা রকম রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আগে নদী ছিল এখন সেখানে গড়ে ওঠেছে সুরম্য ভবন, ফসলের মাঠ।
এক তথ্যে দেখা যায়, গত ৫০ বছরে দেশের ৫০০ নদী ও ৮ হাজার খাল হারিয়ে গেছে। অবশিষ্ট জলাশয়ের অস্তিত্বও হুমকির মুখে আছে। নদীর ওপর নির্ভর করা মানুষগুলো বিকল্প আয়ের সন্ধানে ছুটছে ঢাকার পথে, এতে করে ঢাকা হয়ে পড়েছে ওভার-পলিউটেড এবং চাপ পড়ছে নির্দিষ্ট কিছু পেশার ওপর।
অথচ প্রভাবশালী মহলে দেশের নদীগুলো দখল করে বাণিজ্যিক ভবন তৈরি করছে। এতে প্রতিনিয়ত হারাচ্ছে নদী ও খাল। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, ভুল নদী শাসন, অবৈধ দখল দূষণের কারণে এখন অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে দেশের বেশিরভাগ নদী, খাল, বিল। এমনি অবস্থায় অবৈধ দখল, দূষণ বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। সেইসঙ্গে বড় ধরনের জলাধার নির্মাণ করা, হাওড়-বাওড়গুলোর সংস্কার করে পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি ও পানির গুণগত মান বাড়ানোর মতো নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। পাশাপাশি নদী পথ সচল করে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আনা যেতে পারে ও নদী কেন্দ্রিক পর্যটন এবং নৌপথে যাতায়েত সহজ করা যেতে পারে। দেশের অর্থনীতি গতি পাবে। নদী দখলকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের আরো কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। নদীগুলো ক্যাপিটাল ড্রেজিং করতে হবে এবং দখল, দূষণ থেকে মুক্ত করতে হবে। এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বাড়ার পাশাপাশি বিনিয়োগ ও চাষের জমি বাড়বে।
ঢাকার হৃদপিণ্ড বলে পরিচিত বুড়িগঙ্গার পানি দুষণ মারাতক রূপ ধারণ করেছে যে বুড়িগঙ্গার বক্ষে বাতাসেও এখন দুর্গন্ধ। শিরা-উপশিরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে মানবদেহকে যেমন অসুস্থ করে তোলে তেমন অবস্থা হয়েছে ঢাকাবাসীর। অথচ বুড়িগঙ্গাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা ঢাকার মলমূত্র, আবর্জনা, রাসায়নিক বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা। ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে কালের স্বাক্ষী বুড়িগঙ্গা, বালু, তুুরাগ, শীতলক্ষ্যা। দূষণের শীর্ষে আছে বুড়িগঙ্গা, বালু, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী। বহু প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল এসব নদীর সৌন্দর্য্য হারানোর পাশাপাশি প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল বিলুপ্ত হচ্ছে। এবং বিরূপ প্রভাব ফেলছে জীববৈচিত্র্যে। এরই মাঝে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের নদী খনন, নদীর তীর রক্ষায় সরকার নানামুখী কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। পাশাপাশি বুড়িগঙ্গা, তুরাগ নদীর তীর ঘেঁষে ওয়ার্ক ওয়ে নির্মাণ ও বৃত্তাকার নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
আমাদের প্রত্যাশা নদ নদী রক্ষায় সরকারের এসব কর্মপরিকল্পনা সঠিকভাবে দ্রুত বাস্তবায়ন হবে। তাহলে নদী বাঁচবে, রক্ষা পাবে জীববৈচিত্র, বাড়বে নদী কেন্দ্রিক যাতায়েত, পর্যটন, ব্যবসা বাণিজ্য, গতি আসবে দেশের অর্থনীতিতে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
মানবকণ্ঠ/এফআই
Comments