Image description

শবে বরাত বা লাইলাতুল বরাত হচ্ছে হিজরি শাবান মাসের ১৪ ও ১৫ তারিখের মধ্যবর্তী রাতে পালিত মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ রাত। হাদিসের ভাষায় এই রাতকে লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান বা মধ্য শাবানের রজনী বলা হয়েছে। এ রাত মহিমান্বিত এক রাত। এ রাতে অসংখ্য বান্দা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও কল্যাণ লাভ করেন। প্রতিবছর হিজরি ক্যালেন্ডারের শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে শবে বরাত পালন করা হয়।

এ রাতের ফজিলত সম্পর্কে কোরআন মাজিদে সরাসরি নির্দেশনা না থাকলেও হাদিস শরিফে নির্ভরযোগ্য সনদ বা বর্ণনাসূত্রে একাধিক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। 

বিখ্যাত সাহাবি মুয়াজ বিন জাবাল রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা অর্ধ শাবানের রাতে অর্থাৎ শাবানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে তার সৃষ্টির দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন। ’ (ইবনে হিব্বান, হাদিস,  ৫৬৬৫)

শবে বরাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দীর্ঘ সময় নিয়ে নফল নামাজ পড়তেন। এ বিষয়ে এক হাদিসে আম্মাজান হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বর্ণনা করেন—

‘একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে নামাজে দাঁড়ান এবং এতো দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমার ধারণা হলো- তিনি হয়ত মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করলেন, তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা তোমার কি এই আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসুল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না- হে আল্লাহর রাসুল। আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার এই আশঙ্কা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না। 

তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তার রাসুলই ভালো জানেন। 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন ইরশাদ করলেন, ‘এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত (শবে বরাত)। আল্লাহ তায়ালা অর্ধ-শাবানের রাতে তার বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।’ (শুআবুল ঈমান, বায়হাকি: ৩/৩৮২-৩৮৩; তাবারানি: ১৯৪)

শবে বরাতে নামাজের নিয়ম

শবে বরাতে নফল নামাজ পড়া উত্তম। তবে এই রাতে নফল নামাজ পড়ার আলাদা কোনো নিয়ম বা নিয়ত নেই। অন্যান্য নফল নামাজ যেভাবে পড়া হয়, এ দিন রাতেও যেভাবে স্বাভাবিক নিয়মে নফল নামাজ পড়তে হবে। আলাদা করে কোনো নিয়ত করতে হবে না। 

কেউ এ রাতে নফল নামাজ পড়ার আলাদা কোনো নিয়ম বা নিয়ত সাব্যস্ত করলে তা বিদয়াত বলে গণ্য হবে। কারণ, শবে বরাতে নামাজ পড়ার কোনো নিয়ম বর্ণনা করেননি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। 

আর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াাসল্লাম বর্ণনা করেননি, সাহাবিরা পালন করেননি- এমন কোনো বিষয়ে ইবাদত বা নির্দিষ্ট করে আমল তৈরি করলে তা বিদয়াতের অন্তর্ভুক্ত। বিদয়াত আবিষ্কারকদের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন আল্লাহর রাসূল।

বর্ণিত হয়েছে,  ‘নিশ্চয়ই সর্বোত্তম বাণী আল্লাহর কিতাব। আর সর্বোত্তম আদর্শ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াাসল্লামের আদর্শ। সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হলো, (দীনের মধ্যে) নব-উদ্ভাবিত বিষয়। (দীনের মধ্যে) নব-উদ্ভাবিত সবকিছুই বিদআত। প্রত্যেক বিদআত ভ্রষ্টতা, আর প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম।’ (মুসলিম, হাদিস, ১৫৩৫; নাসায়ি, হাদিস, ১৫৬০)

শবে বরাতের নামাজের নিয়ত
এই শবে বরাতের রাত্রিতে নফল নামাজ হিসেবে দুই রাকাত দুই রাকাত করে ইচ্ছেমত আপনি নামাজ আদায় করতে পারেন। এক্ষেত্রে প্রত্যেক নামাজের পূর্বে নিয়ত করতে হয়। নিয়ত ছাড়া কখনোই নামাজ  আল্লাহ তাআলার কাছে কবুল হবে না। এক্ষেত্রে নামাজ আদায় করা পূর্বে নিয়ত আরবিতে অথবা বাংলাতে পড়লেই চলে।

তবে নামাজের পূর্বে আরবি নিয়ত অথবা বাংলাতে নিয়ত কোনটাই গুরুত্বপূর্ণ নয়। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তাকবীর ”আল্লাহু আকবার” বলা। 

শবে বরাতের নামাজের নিয়ত আরবি: বছরে একবার শবে বরাত পালন করা হয়। এক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের ব্যবধানে লাইলাতুল বরাতের নিয়ত ভুলে গিয়ে থাকেন। একদম শুদ্ধ এবং সঠিক স্বাগতা নামাজের নিয়ত আরবীতে দেখে নিন। যেখানে বাংলা উচ্চারণ করে দেখানো হয়েছে। শবে বরাতের নামাযের আরবি নিয়ত হচ্ছে-

নাওয়াইতুআন্ উছল্লিয়া লিল্লা-হি তাআ-লা- রাকআতাই ছালা-তি লাইলাতিল বারা-তিন্ -নাফলি, মুতাওয়াজ্জিহান ইলা-জিহাতিল্ কাবাতিশ্ শারীফাতি আল্লা-হু আকবার।

শবে বরাতের নামাজের নিয়ত বাংলায়: যারা আরবিতে নিয়ত করতে জানেন না তারা বাংলাতে খুব সহজে প্রত্যেক দুই রাকাত নফল নামাজের পূর্বে এই বাংলাতে নিয়ত করে নিন। নামাজের আরবীতে এবং বাংলাতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। তবে নামাজের পর অবশ্যই তাকবীর আল্লাহু আকবার বলতে হবে। এক্ষেত্রে যেভাবে আপনি বাংলাতে নিয়ত করবেন তা হচ্ছে-

শবে বরাতের দুই রাকাত নফল নামাজ কিবলামুখী হয়ে আদায় করছি, আল্লাহু আকবর’। আর যারা এ কথাটিও বলতে পারবে না তারা শুধুমাত্র ”আল্লাহু আকবার” বলে নামাজের নিয়তে দাঁড়িয়ে যাবেন ইনশাল্লাহ নামাজ হয়ে যাবে।

শবে বরাতের নামাজের দোয়া

শবে বরাতে একজন মুসলিম যেসব ইবাদত করবেন তার পুরোটাই নফল। এ রাতে কোরআন তিলাওয়াত, জিকির, নামাজ সব নফল। কোনোটাই ফরজ, ওয়াজিব বা অন্ততপক্ষে সুন্নতে মুয়াক্কাদাও নয়। 

এজন্য কেউ এ রাতে নফল নামাজ পড়লে তা অন্যান্য যেকোনো সময়ের নফল নামাজের মতো পড়বে, নফল নামাজে সানা, সূরা ফাতিহা, সূরা মিলানো, বৈঠক, তাশাহুদ, দরুদ, দোয়া মাসুরা, সব স্বাভাবিক নিয়মে পালন করতে হবে। 

নামাজ শেষে চাইলে আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করতে পারেন। তবে এ রাতের নফল নামাজের জন্য নির্দিষ্ট করে আলাদা কোনো দোয়া নেই। তাই শবে বরাতে কারো জন্য নির্দিষ্ট কোনো দোয়া করা উচিত হবে।

তবে রজব ও শাবান মাসে আল্লাহর রাসূল বরকত চেয়ে আল্লাহর কাছে যে দোয়াটি করেছেন চাইলে তা পড়া যেতে পারে। দোয়াটি হলো-

আরবি :

اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي رَجَبٍ، وَشَعْبَانَ، وَبَلِّغْنَا رَمَضَانَ

উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজবা ওয়া শাবান, ওয়া বাল্লিগনা রমাদান

অর্থ : হে আল্লাহ! রজব মাস ও শাবান মাস আমাদের জন্য বরকতময় করুন; রমজান আমাদের নসিব করুন। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২৫৯)

আল্লাহ তায়ালা সবাইকে কোরআন-হাদিসের ওপর সঠিকভাবে আমল করার এবং বিদয়াত থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। (আমিন)।

মানবকণ্ঠ/এআই