Image description

ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল প্রায় ৭২ বছর আগে, ১৯৪৮ সালে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ১১ মার্চ তারিখটি রাষ্ট্রভাষা দিবসরূপে পালিত হয়ে আসছিল। ওই সময়কালের মধ্যে আন্দোলনকারীরা পরিষদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন এবং সচিবালয় ঘেরাও করে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়েছিল। ওই আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ এবং পাইকারি গ্রেপ্তার আন্দোলনকে দমাতে পারেনি। প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন বাধ্য হয়েছিলেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে একটি চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করতে। কিন্তু জিন্নাহ সাহেব ঢাকা সফরে এসে সাফ জানিয়ে দেন যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু এবং এর বিরোধিতাকারীরা রাষ্ট্রের দুশমন। ছাত্রসমাজ জিন্নাহ সাহেবের ওই বক্তব্যের সামনাসামনি প্রতিবাদ জানালেও কোনো কাজ হয়নি। প্রতিবাদ দিবসে ঢাকার নবাবপুর রোডে ১৯৪৮-৪৯ সালে বাংলা ভাষা আন্দোলনের সূচনাপর্বে পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দীন।

ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিনগুলোতে। যখন আবার খাজা নাজিমুদ্দীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। ইতোমধ্যে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ইন্তেকাল করেছেন। প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসের শেষদিকে ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান মুসলিম লীগ কাউন্সিলের অধিবেশনে পুনরায় ঘোষণা দেন যে উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। মরা গাঙে বান ডেকে উঠল। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে উত্তপ্ত হয়ে উঠলো রাজপথ। এই উত্তপ্ততা কতদূর যাবে তা বোধকরি বুঝতে পারেনি কেউ। কারণ ভাষা সংগ্রামের গভীরে প্রোথিত ছিল একটি জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক চেতনার উšে§ষ, যা পরে একটি জাতিসত্তা তথা জাতীয়তাবাদী চেতনায় রূপ নেয়। যে চেতনাকে আবর্তিত করে সংগঠিত হয় একটি অধিকারবঞ্চিত জাতির আবেগ এবং আবেদন, যার মাধ্যমে পূর্ণতা পায় হাজার বছরের পরিশীলিত সংস্কৃতির বিকাশ। সেই প্রেরণায়, সেই গতিময়তায় উদ্বুদ্ধ হয়েই চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত তৎকালীন ‘সীমান্ত’ পত্রিকার সম্পাদক মাহবুব উল আলম চৌধুরী রচনা করেন একুশের সেই অমর কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্ররা যখন মিছিল নিয়ে বের হয়, তখন পুলিশ সেই মিছিলে গুলি চালালে সালাম, বরকত, রফিকসহ অনেকেই আত্মত্যাগ করেন। পুলিশের গুলিতে ছাত্রদের প্রাণ ত্যাগের খবর চট্টগ্রাম পৌঁছলে এক বিষাদময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি গুলি করে ছাত্র হত্যার পরে প্রথম একটি দীর্ঘ কবিতা লিখে মনের ক্ষোভ প্রকাশ করেন চট্টগ্রামের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী। এটিই ছিল একুশ নিয়ে লেখা প্রথম কবিতা। যতদূর জানা যায় ২১ ফেব্রুয়ারির কয়েকদিন আগে জলবসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী। ২১ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে গুলিবর্ষণের খবর জানতে পারেন তিনি। একুশের কর্মসূচি পালনকালে ভাষা আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে তিনি এতটাই ক্রোধান্বিত ও আবেগ উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিলেন যে, নিজের শারীরিক অসামর্থ্যরে কথা ভুলে গিয়ে কাগজ-কলমের খোঁজ করছিলেন কিছু লেখার জন্য। কিন্তু জ্বরের তীব্রতায় হাতের প্রবল কম্পনে যখন নিজহাতে লেখা সম্ভব হচ্ছিল না তখন অনর্গল উচ্চারণ করে যান রাশি-রাশি শব্দবুলেট। আর তা সাথে সাথেই লিপিবদ্ধ করে নেন তাদের একজন কর্মচারী মার্কসবাদী রাজনীতির নিবেদিতকর্মী ননী ধর। এভাবেই একুশে ফেব্রুয়ারি রাতেই চট্টগ্রামে রচিত হয় অযুত বুলেটের চেয়েও অধিক শক্তিময় অমিতস্পর্ধিত একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। দুঃসহ মানসিক অবস্থায় বিকেল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে এ ঐতিহাসিক কবিতাটি রচিত হয়। তখন এ কবিতার কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী ছিলেন প্রচণ্ড জ্বরাক্রান্ত। কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসে ওই রাতেই কবিতাটি ছাপা হয়। গোপন সূত্রে এ খবর পেয়ে গভীর রাতেই পুলিশ প্রেসে হামলা করে। পুলিশের আগমন টের পেয়ে প্রেস কর্মচারীরা তড়িঘড়ি করে কম্পোজ করা ম্যাটার ভেঙে ফেলে ঠিকই, কিন্তু ততক্ষণে প্রায় ১৫ হাজার কপি মুদ্রণ সম্পন্ন হয়েছিল।

পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি লালদীঘির ময়দানে আয়োজিত বিশাল প্রতিবাদ সভায় ওই কাব্য পুস্তিকা বিলি করা হয়। ঐতিহাসিক ওই জনসভায় কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনান প্রয়াত ন্যাপ নেতা চৌধুরী হারুনুর রশীদ। পরবর্তী সময়ে তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকার এক আদেশ বলে কাব্য পুস্তিকাটিকে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে। এরপর বহু চেষ্টা সত্ত্বেও কবিতাটির ওপর সরকারের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা যায়নি। ১৯৫৪ সালে জনধিক্কৃত ৯২-ক ধারা জারি করে বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে রাখা কপিগুলোও পুলিশ নিয়ে যায়। এমনকি স্বয়ং মাহবুব উল আলম চৌধুরীর বাড়ি সার্চ করে অত্যন্ত গোপনে লুকিয়ে রাখা কয়েকটি কপিও পুলিশ নিয়ে যায়। সেই ঐতিহাসিক দলিলের কিছু অংশ পত্রস্থ করা হলো-

কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি
মাহবুব উল আলম চৌধুরী
ওরা চল্লিশজন কিংবা আরো বেশি
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে রমনার রৌদ্রদগ্ধ কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায়
ভাষার জন্য, মাতৃভাষার জন্য বাংলার জন্য।
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে
একটি দেশের মহান সংস্কৃতির মর্যাদার জন্য
আলাওলের ঐতিহ্য
কায়কোবাদ, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের
সাহিত্য ও কবিতার জন্য
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে
পলাশপুরের মকবুল আহমদের
পুঁথির জন্য-
রমেশ শীলের গাঁথার জন্য,
জসীমউদ্দীনের ‘সোজন বাদিয়ার ঘাটের’ জন্য। (সংক্ষেপিত)

মানবকণ্ঠ/এসআরএস