
মহান ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত ২১ ফেব্রুয়ারির পর ২২ ফেব্রুয়ারি রক্তমাখা কাপড়ের নিশান উড়িয়ে চলা বিশাল এক শান্তিপূর্ণ মিছিলেও গুলি চালায় পুলিশ। ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়, তার অন্যতম প্রধান ব্যক্তি ছিলেন মুনীর চৌধুরী। পুলিশের বেষ্টনী ভেদ করে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন এবং গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা জানান। ভাষা আন্দোলনের সময় বিপুলসংখ্যক ছাত্র-শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়।
মুনীর চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয় ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। পাঠানো হয় দিনাজপুর জেলে। দিনাজপুর জেল থেকে একসময় তাকে পাঠানো হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ভাষা আন্দোলনের সময় কমিউনিস্ট বন্দিদের অধিকাংশই ছিলেন কারাগারের ২ নম্বর কক্ষে। তারা মুনীর চৌধুরীকে অনুরোধ করেছিলেন একটি নাটক লিখে দিতে। এ ব্যাপারে রণেশ দাশগুপ্ত তার এক লেখায় লিখেছিলেনÑ ‘যেহেতু আমার সঙ্গে বরাবরই মুনীর চৌধুরীর একটা বিশেষ প্রীতির সম্পর্ক ছিল, সেজন্য সবার হয়ে আমি পুরনো হাজত থেকে গোপনে চিঠি পাঠিয়েছিলাম মুনীর চৌধুরীকে নাটক লিখে দেয়ার জন্য।’
মুনীর চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘রণেশদা জানিয়ে দিয়েছিলেন, রাত ১০টার পর জেলখানার সব আলো নিভে যাওয়ার পর তাদের কক্ষে নাটকটি মঞ্চস্থ করবেন তারা। জেলখানায় যারা রাতে হারিকেন দিয়ে লেখাপড়া করতেন, তাদের কাছ থেকে ৮-১০টি হারিকেন দিয়ে নাটকটির মঞ্চ সাজাতে হবে। সে কারণে অনেকটা বাধ্য হয়েই কবর নাটকটিতে আলো-আঁধারির রহস্যময় পরিবেশ সৃষ্টি করতে হয়েছে। বাংলাদেশের নাটকের ইতিহাসে মুনীর চৌধুরীর লেখা ‘কবর’ নাটকটি স্মরণীয় নাম। কারাগারের ভেতরে বসে প্রতিক‚ল পরিস্থিতিতে এই নাটকটি যেভাবে লেখা এবং মঞ্চস্থ করা হয়েছিল। এটাই একুশের ফেব্রুয়ারির ঘটনা নিয়ে লেখা প্রথম নাটক।
‘কবর’ নাটকটি লেখা হয়েছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে, কারারক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে। রাতে কারাগারের বাতি নিভিয়ে দেয়া হলে লণ্ঠনের আলোয় সেই নাটকের প্রথম মঞ্চায়নও হয়েছিল ঢাকা কারাগারে।
যেভাবে লেখা হয়েছিল কবর নাটক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি প্রতিবাদ সভায় একুশে ফেব্রæয়ারির হত্যাকাণ্ডের সমালোচনা করে একটি প্রস্তাব পাস হয়। সেই কারণে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে ছিলেন নাট্যকার মুনীর চৌধুরী। সেসময় একই কারাগারে অপর একটি কক্ষে বন্দি ছিলেন কমিউনিস্ট নেতা রণেশ দাশগুপ্ত। একদিন রণেশ দাশগুপ্তের পক্ষ থেকে একটি গোপন চিঠি আসে মুনীর চৌধুরীর কাছে।
‘বাংলাদেশের নাট্যপ্রবাহ স্মরণীয় পদক্ষেপ’ বইতে সেই ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. ফারহানা আখতার। তিনি লিখেছেন, ‘রণেশ দাশগুপ্ত নাট্যকারকে একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে একটি নাটক লিখে দেয়ার জন্য বলেন, যা জেলখানায় অভিনীত হবে।’ রণেশ দাশগুপ্তের অনুরোধে মুনীর চৌধুরী তখন যে নাটকটি রচনা করেছিলেন, সেটি ‘কবর’। সেখানে কবর নাটক লেখার পটভূমি প্রসঙ্গে রণেশ দাশগুপ্ত লিখেছেন, ১৯৫৩ সালের ২১শে ফেব্রæয়ারিতে একটি নাটক অভিনয়ের উদ্যোগ নিয়েছিলেন ঢাকা জেলে দু’নম্বর খাঁচায় আটক কমিউনিস্ট বন্দিরা। তারা অনুরোধ জানিয়েছিলেন মুনীর চৌধুরীকে একটি নাটক লিখে দিতে। ‘যেহেতু আমার সঙ্গে মুনীর চৌধুরীর একটা বিশেষ প্রীতির সম্পর্ক ছিল বরাবরই, সেজন্য সকলের হয়ে আমি পুরান হাজত হতে গোপনে চিঠি পাঠিয়েছিলাম মুনীর চৌধুরীকে নাটক লিখে দেবার জন্য। মুনীর চৌধুরী তখন ঢাকা জেলের দেওয়ানি নামক ছোট ঘরটিতে আটক থাকতেন।’
কারাগারের রক্ষীদের চোখ এড়িয়ে কয়েকদিনের ভেতর নাটকটি লিখে ফেলেন কবীর চৌধুরী। এটি ছিল তার লেখা তৃতীয় নাটক। মঞ্চ নাটক নিয়ে ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘থিয়েটার’ প্রথম সংখ্যাটি মুনীর চৌধুরীকে নিয়ে লেখা হয়েছিল। সেখানেই একটি নিবন্ধে এই তথ্য উল্লেখ করেন রণেশ দাশগুপ্ত।
বাংলাদেশের ‘নাটক ও নাট্য দ্বন্দ্বের ইতিহাস’ বইতে শান্তনু মজুমদার লিখেছেন, রাত দশটার পরে জেলের বাতি নিভিয়ে দেয়ার পর লণ্ঠনের আলোতে মঞ্চস্থ করার এবং নাটকটিতে মেয়ে চরিত্র এমনভাবে থাকে যেন পুরুষদের দ্বারা অভিনয় করা চলের শর্ত মেনেই তিনি তা রচনা করেছিলেন। মঞ্চ নাটকের সঙ্গে আগে থেকেই সংশ্লিষ্ট থাকায় ছোট পরিসরে কীভাবে নাটকটি লিখলে মঞ্চস্থ করা সহজ হবে, সেটা মুনীর চৌধুরীর জানা ছিল। কারাগারের পরিবেশে অল্প কিছু অভিনয় শিল্পীর কথা মাথায় রেখে হ্যারিকেনের আলো-আঁধারির পরিবেশে তিনি নাটকটি লেখেন। কারাগারের ভেতর প্রথম সেই নাটকের নির্দেশনা দিয়েছিলেন ফনী চক্রবর্তী। মুনীর চৌধুরী অন্য কক্ষে ছিলেন বলে কবর নাটকের প্রথম অভিনয় দেখতে পারেননি। রামেন্দু মজুমদার লিখেছেন, ‘মুনীর চৌধুরী ভাবলেন, সেট ও আলোর ব্যবস্থা থাকবে না, তাই সেই সীমাবদ্ধতাকে কাজে লাগাতে হবে। তিনি নাটকের ঘটনাস্থল হিসেবে বেছে নিলেন গোরস্তানকে- যেখানে সেটের প্রয়োজন নেই। সময় শেষ রাত। নাটকের শুরুতেই নাট্যকারের নির্দেশ: মঞ্চে কোনোরূপ উজ্জ্বল আলো ব্যবহৃত হইবে না। হারিকেন, প্রদীপ ও দিয়াশলাইয়ের কারসাজিতে নাটকের প্রয়োজনীয় ভয়াবহ, রহস্যময়, অশরীরী পরিবেশকে সৃষ্টি করিতে হইবে।’
জেলখানার বাইরে কবর নাটক: জেলখানার বাইরে কবর নাটক প্রথম মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে। ফজলুল হক মুসলিম হল ইউনিয়ন এবং সংস্কৃত সংসদের আয়োজনে সেই নাটকের রিহার্সাল দেখতে নিয়মিত আসতেন মুনীর চৌধুরী। নাটকটি মঞ্চায়নের খবর তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের পত্র-পত্রিকায় বেশ গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়। ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ‘কবর’ নাটক মঞ্চায়নের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেছিল আরণ্যক নাট্যদল। আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে মহৎ সাহিত্য রচনা হয় ‘কবর’ নাটকটি তার প্রমাণ।
মানবকণ্ঠ/এআই
Comments