
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক এনায়েত করিম চৌধুরী বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার উৎখাত করে নতুন জাতীয় সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের লক্ষ্যে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট হিসেবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়, তিনি সরকারি উচ্চ ও নীতিনির্ধারক পর্যায়ের ব্যক্তিদের এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেছেন। এই অভিযোগের ভিত্তিতে সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এনায়েত করিমকে ৪৮ ঘণ্টার রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছে।
গ্রেফতার ও রিমান্ডের বিবরণ
রমনা মডেল থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় এনায়েত করিম চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আতিকুর রহমান ৪৮ ঘণ্টার রিমান্ড মঞ্জুর করেন, যদিও ডিবি পুলিশের রমনা জোনাল টিমের ইন্সপেক্টর আক্তার মোর্শেদ ১০ দিনের রিমান্ড চেয়েছিলেন।
শনিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মিন্টো রোডের মন্ত্রীপাড়া এলাকায় প্রাডো গাড়ি নিয়ে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায় এনায়েত করিমকে। পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সদুত্তর দিতে না পারায় হেফাজতে নেওয়া হয়। তার কাছ থেকে জব্দ করা দুটি আইফোন বিশ্লেষণ করে পুলিশ বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে বলে দাবি করেছে।
পুলিশের অভিযোগ
রিমান্ড শুনানিতে ইন্সপেক্টর আক্তার মোর্শেদ জানান, এনায়েত করিম ৬ সেপ্টেম্বর কাতার এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। তিনি একটি বিশেষ দেশের গোয়েন্দা সংস্থার চুক্তিভিত্তিক এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন। তিনি জানান, অন্তর্বর্তী সরকার বর্তমানে নাজুক অবস্থায় রয়েছে এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাদের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তিনি বর্তমান সরকার উৎখাত করে নতুন জাতীয় সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্য বাংলাদেশে এসেছেন।
পুলিশের দাবি, এনায়েত করিম গুলশানে অবস্থান করছিলেন এবং সরকারি ও বেসরকারি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের তথ্য সংগ্রহ করে নিয়ন্ত্রিত গোয়েন্দা সংস্থার কাছে হস্তান্তর করছিলেন। তিনি আরও জানান, আগামী ২১ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায় পুনর্বহাল করবে। এরপর সেনাবাহিনী সমর্থিত নতুন জাতীয় সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে, যার নেতৃত্ব ও সদস্যদের একটি প্রভাবশালী দেশ নির্ধারণ করবে।
রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর মুহাম্মদ শামছুদ্দোহা সুমন শুনানিতে বলেন, এনায়েত করিম নিজেকে সিআইএ’র এজেন্ট দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর এজেন্ট। তিনি দাবি করেন, ভারত বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে এবং দেশকে তাদের অঙ্গরাজ্যে পরিণত করতে চায়। তিনি আরও বলেন, “দেশ যখন নির্বাচনমুখী, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের পথে এগোচ্ছিল, তখন এই এজেন্ট পরিবেশ নষ্ট করতে এবং ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে।” তিনি এনায়েত করিমের ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন।
আসামিপক্ষের যুক্তি
এনায়েত করিমের পক্ষে অ্যাডভোকেট ফারহান মো. আরাফ রিমান্ড বাতিল ও জামিনের আবেদন করেন। তিনি বলেন, প্রথমে এনায়েত করিমকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখানো হয়, কিন্তু কোনো অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় মামলা দায়ের করে রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। তিনি জানান, এনায়েত করিম ৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে আসেন এবং ১৪ সেপ্টেম্বর ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। তাকে শুধুমাত্র গাড়ি নিয়ে ঘোরাফেরার কারণে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, “সরকার পতনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকলে তিনি সরকারি ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করবেন? এটা কীভাবে সম্ভব?” তিনি আরও বলেন, এনায়েত করিম কোনো নির্দিষ্ট দেশের এজেন্ট কিনা তা এজাহারে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ নেই। তিনি দাবি করেন, এনায়েত করিম রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জড়িত নন এবং তাকে গ্রেফতারের পর মামলা সাজানো হয়েছে। তিনি রিমান্ড বাতিল করে জামিন বা জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করেন।
আদালতের সিদ্ধান্ত
শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আতিকুর রহমান ৪৮ ঘণ্টার রিমান্ড মঞ্জুর করেন। পুলিশ এখন এনায়েত করিমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সত্যতা যাচাই করবে।
তাৎপর্য ও প্রেক্ষাপট
এনায়েত করিমের গ্রেফতার ও তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। দেশ নির্বাচনমুখী পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এবং এই সময়ে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ গুরুতর। পুলিশের দাবি, এনায়েত করিমের কার্যক্রম দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছিল। তবে, আসামিপক্ষের দাবি, এই অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন এবং তাকে ফাঁসানোর জন্য মামলা দায়ের করা হয়েছে।
Comments