
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে টানা ১৬ বছর রাষ্ট্রক্ষমতা আঁকড়ে থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সবার চোখে ধরা দেয় একটি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মানের স্বপ্ন। ছাত্র, শিক্ষক, পেশাজীবীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের এই স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব দেয় অন্তর্বর্তী সরকারকে। স্বপ্নদ্রস্টা হয়ে সরকারের প্রধান হয়ে আসেন নোবলেজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ ইউনূস। এরপরই শুরু হয় রাষ্ট্রযন্ত্র সংস্কারের নানা কার্যক্রম। সবার দাবির প্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা আসে, ‘জুলাই সনদ’ তৈরী ও বাস্তবায়নের। এজন্য সময়সীমাও জানিয়ে দেয়া হয়।
গত ১০ মে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের পর অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল দুই ছাত্র উপদেষ্টাকে সঙ্গে নিয়ে জাতির উদ্দেশে ঘোষণা দেন ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করা হবে। যে সময়সীমা শেষ হয় ২৫ জুন। কথা রাখতে পারেনি সরকার। ফের বাড়ানো হয় সময়।
প্রধান উপদেষ্টাসহ সরকারের দায়িত্বশীলরা জানান, জুলাই সনদ ঘোসণা করা হবে জুলাই মাসের মধ্যেই। এজন্য জুলাই আন্দোলনের প্রথম শহীদ আবু সাইদের মৃত্যুবার্ষিকীর দিনটি বেঁছে নেয়া হয়। কিন্তু দফায় দফায় সংলাপ করেও এখন পর্যন্ত সংবিধানের মূলনীতিসহ মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়নি। অথচ আগামীকাল মঙ্গলবার থেকেই শুরু হচ্ছে ‘রক্তাক্ত জুলাই’ মাস। যে কারণে অনেকটা হতাশই হয়ে পড়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ গতকাল রবিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফার সপ্তম দিনের আলোচনার শুরুতে বলেন, ‘আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম, আবু সাঈদের শাহাদাত্বার্ষিকীতে সবাই মিলে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করব। কিন্তু বাস্তবে সেটা কতটা সম্ভব হবে, তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। আমরা খানিকটা শঙ্কিত যে, সে জায়গায় আমরা যাব না।’ এর আগে গত সপ্তাহের বৈঠকে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে ছাড় দেয়ার অনুরোধ করে বিষয়গুলোতে ঐকমত্যে পৌঁছানোর আহ্বান জানান।
প্রসঙ্গত, ফ্যাসিস্ট শাসকের তকমা পাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বৈর শাসনের বিরুদ্ধে গত বছরের জুলাই মাস ছিল উত্তাল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও নেমে এসেছিলেন রাস্তায়। পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও আপামর জনতা। যার ফলশ্রুতিতে গদি ছেড়ে পালাতে হয় টানা ১৬ বছর ক্ষমতা আকড়ে ধরে থাকা শেখ হাসিনাকে।
কতটুকু এগুলো সনদ: ঐকমত্য কমিশন সূত্রে জানা গেছে, কয়েক দফা সংলাপ, পর্যালোচনা ও মতবিনিময়ের পরও সংস্কার সংক্রান্ত কমিশনের ১৬৬টি প্রস্তাবের অন্তত অর্ধেক বিষয়েই এখনো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরি হয়নি, বিশেষ করে মৌলিক ও কাঠামোগত সংস্কারের প্রশ্নে বিরোধ স্পষ্ট।
কমিশনের চলমান সংলাপে দেখা যায়, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন, সংসদের উচ্চকক্ষে আসন বণ্টনের পদ্ধতি, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমা, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়া, সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচন প্রক্রিয়া, এমনকি সংবিধানের মূলনীতির প্রায় প্রতিটি মৌলিক ইস্যুতেই রাজনৈতিক দলগুলো ভিন্ন অবস্থানে। কেউ বলছে নির্বাচনব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ছাড়া কোনো সংস্কারই টেকসই নয়, কেউ আবার ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের আগেই কোনো আলোচনাকে অর্থহীন বলছে। এমন বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠেছে- রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্য না হলে কীভাবে বাস্তবায়ন হবে ‘জুলাই সনদ’? নাকি মতবিরোধ, সংশয় আর রাজনৈতিক টানাপোড়েনের ভেতরেই হারিয়ে যাবে প্রতিশ্রুত পরিবর্তনের স্বপ্ন?
গত দুই সপ্তাহের সংলাপ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সংসদের প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমিয়ে একটি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে বিএনপি। দলটির সঙ্গে এই অবস্থানে একমত রয়েছে সমমনা এলডিপি, এনডিএম, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, ১২ দলীয় জোট এবং ১১ দলীয় জোট। তারা এ দুটি প্রস্তাবের বিরুদ্ধেই নিজেদের অনড় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছে।
দলগুলোর মতে, এই প্রস্তাবগুলো ভবিষ্যতে রাজনৈতিক ভারসাম্য ও ক্ষমতার কাঠামো নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। এনসিসি গঠনের মাধ্যমে নির্বাহী শাখার কর্তৃত্ব হ্রাস পাবে এবং ক্ষমতার ভারসাম্য বিঘ্নিত হতে পারে বলে মনে করছে বিএনপি। অন্যদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি মনে করছে, যারা এনসিসি গঠনের বিরোধিতা করছেন, তারা মূলত ফ্যাসিবাদী কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসতে চান না।
এ ছাড়া সংলাপে অংশ নেয়া ৩০টি দল ও জোট কেবল ৭০ অনুচ্ছেদ শিথিলের বিষয়ে শর্তসাপেক্ষে একমত হয়েছে। তবে এখানেও দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য স্পষ্ট। জামায়াতের পক্ষ থেকে জানানো হয়, অর্থবিল ও আস্থা প্রস্তাবের বাইরে সংবিধান সংশোধনের সময়েও সংসদ সদস্যরা দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ভোট দিতে পারবেন না। বিপরীতে বিএনপি বলেছে, যুদ্ধাবস্থাতেও সংসদ সদস্যদের দলীয় অবস্থানের বাইরে গিয়ে মতপ্রকাশের সুযোগ থাকা উচিত নয়।
সংবিধান সংশোধনে সংসদের উভয় কক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থনের প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়েছে কয়েকটি রাজনৈতিক দল। তাদের মতে, এটি গ্রহণযোগ্য ও সময়োপযোগী একটি প্রক্রিয়া। তবে এই সুপারিশ বাস্তবায়নে উচ্চকক্ষের অস্তিত্ব জরুরি কি না, এ নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতভেদ রয়েছে। বিএনপি মনে করে, দেশের বাস্তবতা বিবেচনায় উচ্চকক্ষ গঠনের প্রয়োজন নেই। জামায়াতে ইসলামী পুরো সংসদে আনুপাতিক নির্বাচন চাইলেও, ঐকমত্যের স্বার্থে আপাতত শুধু উচ্চকক্ষকে ভোটের ভিত্তিতে গঠনের প্রস্তাবে সম্মতি দিতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছে।
দলটির মতে, এতে সব দলের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্তির সুযোগ তৈরি হবে, যা সংসদীয় সংস্কারে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। একই রকমভাবে দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত আছে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন- এমন সাংবিধানিক বিধান যুক্ত করার বিষয়ে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি ও আরও কয়েকটি দল এই সীমাবদ্ধতার পক্ষে মত দিয়েছে। তাদের মতে, নির্বাহী ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় সময়সীমা নির্ধারণ গুরুত্বপূর্ণ। তবে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে বিএনপি, এলডিপি ও এনডিএম। দলগুলো মনে করে, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদের সীমা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন এবং সংসদের উচ্চকক্ষে আসন বণ্টনের মতো মৌলিক ও কাঠামোগত সংস্কার নিয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বর্তমান পদ্ধতি বদলের বিষয়ে দলগুলো একমত হলেও কী প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবে বা এই নির্বাচনে কারা ভোটার হবেন, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। একই বিষয় পরিলক্ষিত হচ্ছে নারী আসনের ক্ষেত্রেও। নারী আসন ৫০ থেকে ১০০-তে উন্নীত করার ব্যাপারে সব দলই মত দিয়েছে, তবে কী প্রক্রিয়ায় এই আসন নির্বাচিত হবে, তা নিয়ে রয়ে গেছে অনৈক্য। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী সরাসরি ভোটের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে। দল দুটি বলছে, সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা বাড়ানো নিয়ে তাদের আপত্তি নেই, তবে বর্তমানে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন কঠিন। তাদের মতে, এ বিষয়ে আরও সময় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়াই বাস্তবসম্মত। বিপরীতে, এনসিপি বলছে, সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি ভোট হওয়া উচিত।
দ্বিমত দেখা দিয়েছে সংবিধানের মূলনীতি নিয়েও। বিএনপি বলছে, তারা পঞ্চদশ সংশোধনীকে মানে না এবং সংবিধানকে সংশোধন করে সেই আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে চায়, যেখানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ এবং ‘আল্লাহর ওপর বিশ্বাস’ অন্তর্ভুক্ত ছিল। দলটির দাবি, ভবিষ্যতে জনগণের ম্যান্ডেট পেলে তারা সংবিধানে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের মূল্যবোধ সংযুক্ত করবে। অন্যদিকে বামপন্থী দলগুলো ১৯৭২ সালের সংবিধানে বর্ণিত মূল চার নীতির পক্ষে অনড়। তাদের মতে, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ- এই মূলনীতিগুলোই রাষ্ট্রের ভিত্তি। এগুলো থেকে সরে এসে কোনো জাতীয় ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব নয় বলেই তারা মনে করে।
জামায়াতে ইসলামী সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচারের বিষয়গুলোতে একমত হলেও, তারা বিএনপির মতো পঞ্চদশ সংশোধনীর আগের অবস্থায় ফেরার পক্ষে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) জানিয়েছে, তারা ১৯৭২ সালের ‘মুজিববাদী’ মূলনীতির বিরোধী। দলটির মতে, যদি ওই মূলনীতি বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের কাঠামো নিয়ে নতুন কোনো প্রস্তাব আসে, তবে তারা তা আলোচনা করবে।
অনিশ্চয়তার পথে সনদ তৈরি: কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে এরইমধ্যে ‘ঐকমত্য’ শব্দটির সংজ্ঞা নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিয়েছে। বৈঠকে উঠে এসেছে ক্ষোভ, আসন বিন্যাস নিয়ে আপত্তি, কোনো কোনো দলের অতিরিক্ত সময় পাওয়া এবং একাধিক নেতাকে কথা বলার সুযোগ দেয়াকে কেন্দ্র করে অসন্তোষ। নিবন্ধনহীন দলের অংশগ্রহণ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে কয়েকটি পক্ষ। সংলাপের দ্বিতীয় ধাপের শুরুর দিনই উত্তেজনার রেশ ছড়ায়।
লন্ডনে ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে বৈঠকের পর নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি নিয়ে দেয়া যৌথ বিবৃতির প্রতিবাদে জামায়াতে ইসলামী এই সংলাপ বয়কট করে। যদিও পরদিন দলটি সংলাপে ফিরে আসে। কিন্তু জামায়াতের ফিরে আসার দিনই দলটির প্রতি কমিশনের পক্ষপাতের অভিযোগ তুলে সিপিবি, বাসদ, গণফোরাম এবং এলডিপির একাংশ সংলাপ বয়কট করে। পরে তারা আবার আলোচনায় যোগ দেয়। এই টানাপোড়েন, পরস্পরবিরোধী অবস্থান ও আস্থার সংকট রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ‘জুলাই সনদ’ তৈরির প্রক্রিয়াকে অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দিচ্ছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারার বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক, লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, সাংবিধানিক বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হচ্ছে না, এটাই আমাদের দেশের পাওয়ার পলিটিক্সের বৈশিষ্ট্য। ক্ষমতার প্রতি যে আকর্ষণ, এক্ষেত্রে একদলের সঙ্গে অন্যদলের তেমন একটা পার্থক্য নেই।
অভ্যুত্থানের পর পরই জুলাই সনদ তৈরি করা উচিত ছিল মন্তব্য করে তিনি বলেন, জুলাই আন্দোলনের পর পরই সমন্বয়করা সনদ তৈরির কাজটি করে ফেলতে পারতেন। ওই সময় যতটা সমন্বয়কদের প্রতি মানুষের আস্থা, ভালোবাসা বা আবেগ কাজ করছিল, সেটা এখন আর নেই। ফলে এখন সবগুলো রাজনৈতিক দল একমত হয়ে একটা সনদ করবে- এটা আমার কাছে অসম্ভব মনে হয়।
উদ্বেগ জুলাই যোদ্ধাদের: জুলাই সনদ ঘোষণার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি না থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জুলাই যোদ্ধা সংসদ। তারা সরকারের প্রতি প্রতিশ্রুতি পালনের আহ্বান জানিয়েছে। সংগঠনটি জানিয়েছে, সরকার প্রতিশ্রুতি পালন না করলে সাধারণ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কঠোর কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য হবেন তারা।
জুলাই যোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক আরমান হোসেন শাফিন সম্প্রতি এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, বারবার সময়ক্ষেপণ ও অজানা অনিশ্চয়তা তাদের শঙ্কিত করে তুলছে। এদিকে রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের ভিত্তিতে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার ‘জুলাই সনদ’ প্রকাশের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে বলে অভিযোগ তুলেছে জুলাই গণ-ঐক্য।
এক বিবৃতিতে সংগঠনটি বলেছে, ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে গঠিত এই অন্তর্বর্তী সরকার যদি ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা না করে, তবে সেটা হবে স্পষ্ট বিশ্বাসঘাতকতা। এই সরকার ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগকে অসম্মান করছে। তারা আরও অভিযোগ করে, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েই বিভিন্ন স্থানে জুলাই আন্দোলনের কর্মীদের বাড়িঘরে হামলা ও অগ্নিসংযোগ চালিয়েছে ‘ফ্যাসিবাদী শক্তি’। এসব ঘটনার কোনো বিচার না হওয়াকেও আন্দোলনকারীরা সরকারের নীরব সহযোগিতা হিসেবে দেখছে। সংগঠনটির পক্ষ থেকে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলা হয়েছে, জুলাই কোনো ক্যালেন্ডারের তারিখ নয়, এটা অন্যায়-ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার সর্বোচ্চ প্রতিরোধের গৌরবময় অধ্যায়। এই অধ্যায়ের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ দিতে হবে। না দিলে কঠোর কর্মসূচি আসবে, তার দায়ভার সরকারকে নিতে হবে।
যা বলছে রাজনৈতিক দলগুলো: মৌলিক বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর এমন অনৈক্যতে এখন প্রশ্ন উঠেছে- জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদের যে প্রস্তুতি চলছে, তা আদৌ কতটা সফল হতে যাচ্ছে? অথবা অধিকাংশ বিষয়েই ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারলে ‘জুলাই সনদ’ কতটা গ্রহণযোগ্য বা বাস্তবসম্মত হবে?
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে সুষ্ঠু নির্বাচনে যে দলই ক্ষমতায় এসেছে, ৫০ শতাংশ ভোটও পায়নি। উচ্চকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ৬৫-৬৬ শতাংশ ভোট প্রয়োজন, যা বাস্তবসম্মত নয়। ফলে ভবিষ্যতে সরকারি ও বিরোধী দলের ঐকমত্য ছাড়া সংবিধান সংশোধন সম্ভব হবে না। কিন্তু বাংলাদেশে এমন ঐকমত্য আরও অসম্ভব। আমাদের কাছে যেটা গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে তাতে মত দিয়েছি।
তিনি বলেন, যদি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সকল প্রস্তাবে আমাদেরকে শতভাগ একমত হতে বলা হয়, তাহলে তো আলোচনার দরকার ছিলো না। তিনি বলেন, জাতীয় ঐকমত্য পোষণ হলে যে সমস্ত বিষয়গুলোতে দলসমূহ একমত হবে, সেই বিষয়গুলো একত্রিত করে জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদ স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা। তো এখন এখানে যদি আমাদেরকে বাধ্য করা হয়, এই সমস্ত বিষয়ে একমত হতেই হবে, সেটা তো সঠিক হলো না।
সংস্কার নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় দরকষাকষি চলছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)’র সদস্য সচিব আখতার হোসেন। তিনি বলেন, আমরা এখনো মৌলিক সংস্কারের বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে আছি। বিএনপিসহ কয়েকটি দলের দ্বিমতের কারণে মৌলিক সংস্কারের জায়গায় ঐকমত্যে আসা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, এখনো পর্যন্ত জুলাই ঘোষণাপত্র তৈরিতে সরকারের কোন উদ্যোগ নেই। সরকার জুলাই মাসের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র না করে তবে ৩ আগস্ট এনসিপি সম-মনাদের নিয়ে জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করবে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, অনেক বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি। অনেক বিষয়ে আবার হচ্ছে। কিছু কিছু জায়গায় আটকে যাচ্ছে। সেগুলো আমরা সমাধান করার চেষ্টা করছি। এটা তো একটা নেগোসিয়েশনের প্রশ্ন। বিতর্ক হবেই, এর মধ্যে দিয়ে কোনো একটা জায়গায় পৌঁছানো যাবে। কমিশনের অধিকাংশ বিষয়েই তো আমরা একমত। মূল সমস্যা ৮-১০টি বিষয় নিয়ে, যেখানে মতভিন্নতা আছে। রাষ্ট্রের মূলনীতি নিয়েও মতপার্থক্য আছে। এটা সমাধান হওয়া কঠিন।
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, জুলাই মাসের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র অবশ্যই দিতে হবে। অন্যথায় সেটি জনগণ মেনে নেবে না। জুলাইয়ের কোনো আইনি স্বীকৃতি এবং মৌলিক সংস্কার ছাড়া আমরা নির্বাচনের পক্ষে নই।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মুখপাত্র গাজী আতাউর রহমান বলেন, আমরা তো শুরু থেকেই জুলাই সনদের বিষয়ে বলে আসছি। কারণ জুলাই অভ্যুত্থান ঘিরে একটা প্রত্যাশা ছিল। জুলাই সনদ এজন্য হওয়া দরকার যে, সামনে যারাই ক্ষমতায় আসুক যাতে বিগত দিনের মতো একদলীয় শাসন কায়েম না করে। বিগত দিনের মতো স্বৈরাচারী ভূমিকা পালন না করে। সঠিকভাবে যাতে দেশ চলে।
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, জুলাই সনদ হলো জুলাই অভ্যুত্থানের একটা অঙ্গীকার। যা না করাটা হবে বিশাল আত্মত্যাগের সঙ্গে প্রতারণা। সব রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বিএনপি যদি সহযোগিতা করে, তাহলে এই সনদ তৈরি সহজ হবে বলে আমি মনে করি।
বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া বলেন, জুলাই সনদ করতে না পারার কোনো কারণ দেখি না। অভ্যুত্থানকে আমলে নিয়ে এটা তৈরি করতেই হবে। সামনে এগিয়ে যেতে হলে ‘জুলাই সনদ’ হওয়া উচিত।
Comments