
যে কোনো সমাজে তরুণ প্রজন্মই ভবিষ্যতের দিশারি। পরিবার তাদেরকে লালন করে, সমাজ তাদের চেতনা গড়ে তোলে, আর রাষ্ট্র তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের ক্ষেত্র তৈরি করে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে দেখা যায়, বড় কোনো পরিবর্তন, শিল্পবিপ্লব থেকে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ, এসবের কেন্দ্রে ছিলো তরুণদের সৃজনশীলতা ও ঝুঁকি নেবার মানসিকতা। কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রথাগত ধারা যেখানে কেবল চাকরির মধ্যে সীমাবদ্ধ, সেখানে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতা নতুন এক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে। এটি কেবল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়, বরং সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
তরুণরা যখন উদ্যোক্তা হয়, তখন তারা শুধু নিজেদের কর্মসংস্থানের পথ তৈরি করে না, বরং অন্যদের জন্যও কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে। বিশ্বের বহু দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের হাত ধরেই অর্থনীতির ভিত শক্ত হয়েছে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রে সিলিকন ভ্যালি কিংবা চীনের শেনজেন শহর প্রমাণ করেছে, তরুণ উদ্যোক্তাদের স্বপ্নই পারে একটি দেশকে বিশ্ব অর্থনীতির শীর্ষে তুলতে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার সবচেয়ে বড় অংশই তরুণ সমাজ।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশই ১৫-৩৫ বছর বয়সী তরুণ-তরুণী। এ বিশাল জনশক্তি যদি শুধুমাত্র চাকরির আশায় বসে থাকে, তবে দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়ন থমকে যাবে। কিন্তু তারা যদি উদ্যোগী হয়ে উদ্যোক্তা হিসাবে গড়ে ওঠে, তবে তারা নিজেদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করবে, আবার অন্যদেরও কাজের সুযোগ দেবে। এ কারণেই বলা যায়, যুব সমাজের উদ্যোক্তা হওয়া শুধু যৌক্তিক নয়, বরং সময়ের দাবি।
বাংলাদেশ আজ এক বিশাল জনসংখ্যার দেশ, যেখানে প্রায় ৩৫% মানুষ তরুণ। এত বড় যুবসমাজ যদি কেবল চাকরির অপেক্ষায় বসে থাকে, তবে কর্মসংস্থানের সংকট থেকেই যাবে। কিন্তু যদি তারা উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে ওঠে, তবে একদিকে বেকারত্ব কমবে, অন্যদিকে জাতীয় আয়ের বহুমুখীকরণ ঘটবে। কৃষি, প্রযুক্তি, কুটির শিল্প, ই-কমার্স, এমনকি পরিবেশবান্ধব জ্বালানি খাত, সবখানেই তরুণ উদ্যোক্তাদের সম্ভাবনা সীমাহীন। এখানেই আসে পরিবারের গুরুত্ব।
আমাদের সমাজে এখনও চাকরিকে নিরাপত্তার প্রতীক ধরা হয়। ফলে তরুণরা যখন ব্যবসা শুরু করতে চায়, তখন পরিবার অনেক সময় নিরুৎসাহিত করে। অথচ পরিবারের সহযোগিতা একজন উদ্যোক্তার জন্য সবচেয়ে বড় শক্তি। মানসিক সাহস, প্রথম পুঁজি, ধৈর্য আর উদ্দীপনা, সবই পরিবার থেকে আসে। পরিবার যদি পাশে থাকে, তরুণরা ব্যর্থতাকেও শক্তিতে রূপান্তর করতে পারে। তাই রাষ্ট্র যেমন নীতি সহায়তা দেবে, পরিবারও তেমনি হয়ে উঠবে তরুণের প্রথম বিনিয়োগকারী, প্রথম প্রেরণা।
তরুণ উদ্যোক্তাকে সফল হতে প্রথমেই প্রয়োজন পরিবারের সমর্থন। পরিবারের মানসিক ও আর্থিক সহযোগিতা না থাকলে নতুন উদ্যোগ শুরু করা প্রায় অসম্ভব। অনেক সময় দেখা যায়, পরিবার চাকরিকে নিরাপদ ভেবে ব্যবসা শুরুতে নিরুৎসাহিত করে। কিন্তু যদি পরিবার সন্তানকে উৎসাহ দেয়, তার উদ্যোগে পুঁজি ও মনোবল যোগায়, তবে সাফল্যের সম্ভাবনা দ্বিগুণ হয়। সুতরাং পরিবার শুধু সামাজিক নিরাপত্তা নয়, বরং উদ্যোক্তা তৈরির অন্যতম অনুঘটক।
তরুণ উদ্যোক্তা তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে শুধু রাষ্ট্রীয় নীতি বা আর্থিক সহায়তাই যথেষ্ট নয়; পরিবারের ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক সহায়তায় পরিবার আগে। ব্যবসা শুরুতে অনেক অনিশ্চয়তা থাকে। পরিবার যদি সাহস জোগায়, তরুণ ঝুঁকি নিতে পারে। অনেক সময় প্রথম পুঁজি আসে পরিবার থেকেই। পরিবার ও আত্মীয়স্বজন তরুণের সিদ্ধান্তকে সম্মান করলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে।
ব্যবসা শুরুতে সাফল্য নাও আসতে পারে। পরিবার যদি ধৈর্য ধরে পাশে দাঁড়ায়, তরুণ হতাশ হয় না। সমাজ তরুণ উদ্যোক্তার সামাজিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে পারে। সমাজ যদি নতুন উদ্যোগকে সম্মানিত করে, ব্যর্থতাকে তিরস্কার না করে বরং অভিজ্ঞতা হিসেবে মূল্যায়ন করে, তবে উদ্যোক্তা সংস্কৃতি বিকশিত হয়। অনেক দেশে উদ্যোক্তারা সমাজনায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। বাংলাদেশেও যদি আমরা সমাজে উদ্যোক্তাদের মর্যাদা দিই, তবে তরুণরা আরও বেশি উদ্যোগ নিতে সাহসী হবে।
চাকরি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সবাই তো চাকরি পাবে না। প্রতিবছর লাখ লাখ তরুণ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে, অথচ সরকারি-বেসরকারি চাকরির দরজা সীমিত। এই বাস্তবতায় তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়াই সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি। কারণ উদ্যোক্তা মানে শুধু নিজের কর্মসংস্থান নয়, অন্যের জন্যও সুযোগ সৃষ্টি করা। তরুণ উদ্যোক্তা শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক পরিবর্তনেরও চালিকা শক্তি। তারা কর্মসংস্কৃতি বদলায়, সমাজে নতুন মূল্যবোধ যোগ করে, আত্মনির্ভরতার সংস্কৃতি তৈরি করে।
তরুণরা উদ্যমী, নতুন চিন্তাধারার প্রতি উš§ুক্ত এবং ঝুঁকি নিতে সাহসী। প্রযুক্তির যুগে তারা দ্রুত নতুন কিছু শেখে ও প্রয়োগ করতে পারে। বাংলাদেশের তরুণরা তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি, গার্মেন্টস, ক্ষুদ্র ব্যবসা, স্টার্টআপ, এমনকি ফ্রিল্যান্সিংয়েও নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। এ শক্তিকে উদ্যোক্তা হওয়ার দিকে পরিচালিত করা গেলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে আরও শক্তিশালী হবে।
উদ্যোক্তা হওয়ার পথে অনেক বাধা আসে যেমন: পুঁজির অভাবে তরুণদের ব্যবসা শুরু করার মতো পর্যাপ্ত অর্থ নেই, ব্যাংক ঋণ পেতেও হয়রানি হয়। প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার অভাবে উদ্যোক্তা হতে হলে ব্যবসায়িক পরিকল্পনা, বিপণন, ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জ্ঞান থাকা দরকার, যা অনেক তরুণের নেই। দুর্নীতি ও জটিল আমলাতন্ত্র এ লাইসেন্স, অনুমোদন ইত্যাদিতে জটিলতা উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত করে। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাল ফলে নতুন ব্যবসা ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা থাকে, ফলে তরুণরা নিরুৎসাহিত হয়। বাজার প্রতিযোগিতায় বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে স্থানীয় তরুণ উদ্যোক্তারা পিছিয়ে পড়ছে। এসব দূর করতে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে একসাথে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের আকাশে আজ সবচেয়ে বড় তারাটি তরুণ সমাজ।
জনসংখ্যার বিশাল অংশই ১৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে, তাদের হাতে আছে অমিত সম্ভাবনা, সৃজনশীলতা আর অদম্য স্বপ্ন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তারা কি শুধুই চাকরির লাইনে দাঁড়িয়ে থাকবে, নাকি নিজেদের শক্তিতে নতুন কিছু সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ তরুণ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে। সরকারি ও বেসরকারি চাকরির সুযোগ সীমিত। ফলে বেকারত্ব দূরীকরণের মাধ্যমে উদ্যোক্তা তৈরি হলে তারা নিজেরাই কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারবে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে শিল্প-বাণিজ্য বাড়ে, দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হয়। এভাবে উদ্যোক্তা তরুণরা জাতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড মজবুত করতে পারে। তরুণরা প্রযুক্তি ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আইটি, ই-কমার্স, এগ্রো-টেক, হেলথ-টেকের মতো খাতে তরুণ উদ্যোক্তাদের অবদান বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। বাংলাদেশের স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলোও ইতোমধ্যে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করছে। নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাবে।
তরুণ উদ্যোক্তা শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক পরিবর্তনেরও চালিকা শক্তি। তারা কর্মসংস্কৃতি বদলায়, সমাজে নতুন মূল্যবোধ যোগ করে, আত্মনির্ভরতার সংস্কৃতি তৈরি করে সামাজিক পরিবর্তন আনা সম্ভব। শহরকেন্দ্রিক চাকরির পরিবর্তে গ্রামে বসেই যদি তরুণরা কৃষি-ভিত্তিক বা শিল্প-ভিত্তিক উদ্যোক্তা হয়, তবে গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী হবে এবং শহরের ওপর চাপ কমিয়ে গ্রামীণ উন্নয়ন সম্ভব। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেখছি চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া তরুণ উদ্যোক্তাদের উদ্ভাবনী উদ্যোগ শিল্পায়নের গতি বাড়িয়েছে। স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমে তরুণদের অবদান ভারতকে বৈশ্বিক প্রযুক্তি কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত ভিয়েতনাম দেশটি তরুণ উদ্যোক্তাদের শক্তিতে অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত এগিয়ে গেছে। এসব দেশ দেখিয়েছে যে তরুণ উদ্যোক্তা সমাজ রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি। উদ্যোক্তা তরুণ মানেই আত্মনির্ভরতার চাবিকাঠি। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ব্যবসা, কৃষিভিত্তিক উদ্যোগ, প্রযুক্তি নির্ভর স্টার্টআপ, সবখানেই তরুণদের হাতেই রচিত হচ্ছে নতুন অধ্যায়। চধঃযধড়, ঝযড়যড়ু, ঝযড়ঢ়টঢ় কিংবা অর্গানিক কৃষির অনেক উদ্যোগ আজ আমাদের দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে। তরুণদের এই পথচলা প্রমাণ করে, তারা চাইলে বিশ্ববাজারেও জায়গা করে নিতে পারে।
তবে এই পথ মসৃণ নয়। তরুণ উদ্যোক্তারা প্রথমেই হোঁচট খায় পুঁজির অভাবে। ব্যাংকের জটিল ঋণপ্রক্রিয়া, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক হয়রানি তাদের নিরুৎসাহিত করে। অভিজ্ঞতার ঘাটতি ও বাজার প্রতিযোগিতার চাপও অনেককে মাঝপথে থামিয়ে দেয়। তবুও তারা স্বপ্ন দেখতে জানে, আর সেই স্বপ্নই হলো শক্তি।
তরুণ উদ্যোক্তা হওয়া মানে শুধু ব্যবসা করা নয়, এটি সমাজ গঠনের একটি প্রক্রিয়া। পরিবার যদি উদ্দীপনা দেয়, সমাজ যদি স্বীকৃতি দেয়, এবং রাষ্ট্র যদি নীতিগত সহায়তা দেয়, তবে তরুণরা উদ্যোক্তা হয়ে জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক অগ্রযাত্রায় অবদান রাখতে পারবে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এই যৌক্তিক পথেই নিহিত, যেখানে যুবক সমাজ কেবল কর্মসংস্থানের সন্ধানী নয়, বরং কর্মসংস্থান স্রষ্টা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।
বাংলাদেশের তরুণ সমাজ আজ এক অগ্নিশিখা, যা সঠিক দিকনির্দেশনা পেলে আলোকিত করতে পারে পুরো দেশকে। তাদের উদ্যোক্তা হওয়ার পথে রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার যদি পাশে দাঁড়ায়, তবে একদিন বাংলাদেশ রূপান্তরিত হবে এক আত্মনির্ভর, উদ্ভাবনী ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে। অতএব বলা যায়, যুবসমাজের উদ্যোক্তা হওয়া শুধু যুক্তি নয়, এটাই আগামী বাংলাদেশের স্বপ্ন, এটাই আমাদের ভবিষ্যতের ভরসা।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট
Comments