Image description

মানুষের প্রয়োজনে সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম আয়েশের জন্য উন্নয়ন, অবকাঠামো, রাস্তা-ঘাট, পুল-কালভার্ট, সড়ক-মহাসড়ক, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, আলো-বাতাস, পানি, নানা রকম জীববৈচিত্র্য, গাছ-পালা, বৃক্ষরাজি, বন-পাহাড়, সাগর-মহাসাগরের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এসব কিছু মানুষের জন্য অপরিহার্য হলেও বাস্তবে অনেক সময় মানুষ ব্যক্তি স্বার্থে প্রকৃতির দান বন-বনানি, গাছ-পালা, পাহাড়, নদ-নদী, সাগর-মহাসাগর, জীববৈচিত্র্যকে ধ্বংস করছে, বিনাশ করছে। 

যদি জীববৈচিত্র্য, পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী, সাগর-মহাসাগর, সবুজ প্রকৃতিকে অক্ষুণ্ন রেখেই উন্নয়ন, অবকাঠামো, সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, যাতায়াত, আলো-বাতাস ও পানির ব্যবস্থা করা যায় তা ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সমাজ, সরকার, রাষ্ট্র দীর্ঘমেয়াদে লাভবান হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে উন্নয়নের সময় এসব ভাবনার মধ্যে এবং পরিকল্পনার সময় বিবেচনায় রাখে না মানুষ, সরকার। 

আর এর পরিণামে মানুষ, সমাজ, জাতি গোষ্ঠী, রাষ্ট্রকে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, অধিক গরম, বন্যা, অধিক বরফ পড়া, বরফ গলার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব, এগিয়ে যাচ্ছে মানুষ। একই সঙ্গে জীবন-জীবিকা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতিও হুমকিতে পড়ছে। সম্ভাব্য এই বিপর্যয় থেকে পরিত্রাণের উপায় নেই বাংলাদেশের। 

জল-জঙ্গল যেমন পৃথিবীর আদিম স্মৃতির মতো, জল-জঙ্গলের বুকে শত সহস  যাতনা তবু তারা সকলের সব দুঃখের স্মৃতি বুকে ভরে নিতে পারে। জলের দেহে যেমন আলোর অনুরণন, তাতেই জীবন সাবলীল ও সার্থকতা সঙ্গী হয়ে থাকুক অনাগত দিনে এমন প্রত্যাশা তো করাই যায়। 

পদ্মা, মেঘনাসহ শত শত নদ-নদী, বন-বনানি, পাহাড়-পর্বত, সাগর-মহাসাগর যেমন আমাদের জন্য নিত্য অপরিহার্য, নিত্যদিন তাদের সঙ্গেই বসবাস, আমাদের বেড়ে ওঠা, বেঁচে থাকা, স্নান, বাণিজ্য আরো কত কি চলে জলের বুকে? বিশ্বের যাবতীয় অনাচার থেকে, অনিষ্ট থেকে মুক্ত থাকুক নদ-নদী সাগর-মহাসাগর সেই প্রত্যাশায় হে জল, নদ-নদী, সাগর-মহাসাগর ভালো থেকো, আলো হয়ে থেকো জগতবাসীর জন্য।’

এ ক্ষেত্রে একটা দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যায় আমাদের প্রিয় ঢাকাকে কীভাবে আমরা উন্নয়নের নামে, অবকাঠামো, সুউচ্চ অট্টালিকা নির্মাণ, যোগাযোগ ব্যবস্থা সুগম ও সহজতর করার জন্য কত শত উদ্যোগ আয়োজন। এই শহরে আমরা দৌড়াই প্রতিদিন। সময়ের পেছনে, দায়িত্বের পেছনে, জীবনের এক অদৃশ্য লক্ষ্যকে, জীবনের অপরিসীম চাহিদা পূরণের পেছনে ছুটতে গিয়ে আমরা অনেকেই হাঁপিয়ে উঠি। এমন এক ক্লান্ত সন্ধ্যায়, বিকালে দুদণ্ড শান্তি, স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য প্রকৃতির কাছে, উন্মুক্ত আকাশ-বাতাস, খোলামেলা নিরিবিলি পরিবেশ খুব প্রয়োজন। 

কিন্তু চাইলেই তো ঢাকায় এমন পরিবেশ, পরিস্থিতি মেলে না হাতের কাছে। এমন একদিন আসবে যেদিন মানুষ নিজেকে মনে করবে যে, প্রকৃতি এখনো পাশে আছে, ডাকছে নিরিবিলি শান্ত পরিবেশে। প্রকৃতির কাছে, বৃক্ষের কাছে, পাহাড়ের কাছে, সমুদ্রের পাড়ে, নির্জন স্থান কেন মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ? কারণ প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়া শুধু শরীরের বিশ্রাম নয়, মনেরও প্রশান্তি মেলে। 

এমন পরিবেশে মন বলে, ‘তুমি অনেক ব্যস্ত, কিন্তু একটু থেমে দাঁড়াও দুদণ্ড শান্তি, স্বস্তি এবং প্রশান্তির জন্য। যারা বোঝেন, যারা ভাবেন, যারা বুঝেছে তারা জানেন অবসরে প্রশান্তির জন্য আকাশটা একটু বেশি নীল হলে, বাতাসটা নির্মল হলে, পাশে গাছ-গাছালি, পাখ-পাখালির কিচিরমিচির হলে ভালো হয়। কিন্ত শহুরে এই সভ্যতায় পরিবেশসম্মত উন্মুক্ত উদ্যান কোথায়, ‘নীল দিগন্ত কোথায়?’ এই বিশ্বাস, ধারণাকে সামনে রেখে মানুষকে শহর ছেড়ে প্রকৃতির কাছে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করা। 

ধীরে ধীরে এই গুরুত্ব বিবেচনায় বিশ্বব্যাপী ‘নেচার রিমাইন্ডার ডে’- পালন করে আসছে। যা বিশ্বের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। যদিও এ নিয়ে তেমন প্রচারণা নেই। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবার নির্ধারত তারিখে হ্যাশট্যাগে ঝড় ওঠে। বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে এই দিনের আলাদা একটা মানে আছে আমাদের দেশে ‘দিগন্ত’ মানে কেবল আকাশ আর মাটির মিলনরেখা নয়, মানে শান্তির খোঁজ। 

সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনার হাওরে দাঁড়িয়ে দেখা যায় এক অনন্ত নীল জলরাশি যেন নিজেকেই ফিরে পাওয়া। অনুরূপ সাজেকে কিংবা রাঙ্গামাটির পাহাড় যখন মেঘে ঢেকে যায়, তখন মনে হয়, পৃথিবীটা এমনই সুন্দর। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে সাগরে মুহুর্মুহু গর্জন, আদৌ ঢেউ মন কাড়ে ভ্রমণপিপাসুদের। কুয়াকাটার সৈকত, যেখানে সূর্য ওঠে আর ডোবে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলে শহরের সব শব্দ নিঃশব্দ হয়ে যায়। 

এই দিনে কেউ বেরিয়ে পড়েন প্রকৃতির দিকে হয়তো একা, হয়তো প্রিয় কারও হাত ধরে। কেউ হয়তো শহরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কফির কাপ হাতে দিগন্তে তাকিয়ে থাকেন। কেউ ফোনটা বন্ধ করে রাখেন সারাদিন, যেন বাইরের পৃথিবীর বদলে নিজের ভেতরের শব্দ শুনতে পান। প্রযুক্তিনির্ভর ও যান্ত্রিক জীবনে ব্যস্ত মানুষের মধ্যে প্রকৃতির গুরুত্ব তুলে ধরা দরকার। 

মানসিক শান্তি ও ভারসাম্যের জন্য দিগন্তের প্রশান্ত দৃশ্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়া। শহুরে জীবনের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে সৃজনশীলতা ও জীবনের আসল সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়ার অনুপ্রেরণার জন্য দরকার প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়া। আজ না হয় একটু সময় নিয়ে দিগন্তের দিকে তাকাই। হয়তো পাখির ডাক শুনব, হয়তো গোধূলির আলোয় মায়া জাগবে মনে। 

হয়তো বুঝে যাব জীবনটা এত জটিল নয়, আমরা একটু জট পাকিয়ে ফেলেছি। শতবর্ষী করচের জলাবনে যেতে যেতে কত কী চোখে পড়ে, এক টুকরা জলাবনে এখনো মানুষকে কাছে টানবার আকর্ষণ করছে। কিংবা মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওরপাড়ের অন্তেহরিতে এক টুকরা জলাবনে এখনো মানুষকে কাছে টানবার আকর্ষণ আছে। 

মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কাদিপুর গ্রামে সকালটা অন্য রকমভাবে আসে। এটি কাউয়াদীঘি হাওরপাড়ের একটি গ্রাম। ওই গ্রামের পথ ধরে এগিয়ে গেলে সামনে পড়ে অন্তেহরি, এটি রাজনগর উপজেলার আরেকটি গ্রাম। অন্তেহরিও কাউয়াদীঘি হাওরের কোলঘেঁষে শত বছর ধরে প্রাণ-প্রকৃতির অংশ হয়ে গেছে। বর্ষায় হাওরের উত্তাল ঢেউ সামলে এই গ্রামে মানুষের বাস। যতদূর চোখ যায় অবারিত রুপালি জলের ভাঁজ করা শীতলপাটি। শীতে আরেক প্রকৃতি। দিগন্তজুড়ে শুধু বিস্তীর্ণ সবুজ। উড়ে যায় পরিযায়ী পাখির ঝাঁক। 

এই অন্তেহরি গ্রামকে ছুঁয়ে শত বছরের পুরনো করচ গাছে নীরবে-নিভৃতে তৈরি হয়েছে এক টুকরা ‘জলাবন’। ওখানে জলে শরীর ডুবিয়ে পুরো বর্ষাটাই পার করে এই গাছেরা। মৌলভীবাজার শহরতলির মৌলভীবাজার-কুলাউড়া সড়কের চাঁদনীঘাট থেকে উত্তর দিকে একাটুনা-জগৎপুর হয়ে অন্তেহরির দিকে গেছে একটি পাকা সড়ক। 

অন্তেহরির ওই জলাবনের দিকে ‘যেতে যেতে পথে’ কাদিপুরে তখন মৌসুমি মাছের হাট জমে গেছে। এখানে হাটের মানুষ, ঘাটের মানুষ খুব বেশি না হলেও একরকমের প্রাণ আছে। কেউ রাতে কাউয়াদীঘি হাওর থেকে ধরা মাছ নিয়ে এখানে এসেছেন। কেউ এসেছেন পাইকারি দরে মাছ কিনে শহরে নিয়ে যেতে, কেউ গ্রামে গ্রামে ফেরি দিয়ে ওই মাছ বিক্রি করবেন। কিছু ক্রেতাও আছেন, যারা হাওরের টাটকা মাছ কিনতে এখানে ছুটে এসেছেন। একটা স্বল্পস্থায়ী হাট জমে কাদিপুরের ওই স্থানে। 

কারও ডোলায় চিংড়ি মাছ, কারও ডোলায় পুঁটি-টেংরাসহ বারো জাতের মাছ। কারও ডোলায় শিং-মাগুর, চ্যাং, কৈ, ভেদা, নানা রকম গুঁড়া মাছ। মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওরপাড়ের কাদিপুরে ডোলায়-পাত্রে রাখা হাওরের নানা জাতের মাছ। মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওরপাড়ের কাদিপুর থেকেই অন্তেহরি গ্রামের শত বছর বয়সী করচ গাছগুলোকে চোখে পড়ে। 

সেই কবে গাছগুলো এখানে মাথা তুলতে শুরু করেছিল, তা বলার মতো কেউ আর বেঁচে নেই। স্থানীয় মানুষেরা জানেন, তাদের বাপ-দাদারাও যেমন এই গাছগুলো দেখে গেছেন, এখন তারাও দেখছেন। স্থানীয় লোকজনের ধারণা, এই গাছ কেউ রোপণ করেনি। হাওরপাড়ে প্রকৃতির আপন নিয়মে জলাভূমির অন্যসব গাছের মতো এরাও এখানে কোনো এক সময় শেকড় পুঁতেছে। তারপর ধীরে ধীরে বাতাসের বুকে ডালপালা মেলেছে। 

সেই যে সংসার পেতেছে তারা, এখনো আছে। আগে অনেক গাছ ছিল। নানা দুর্যোগ-দুর্বিপাকে অনেকটাই হারিয়ে গেছে। তারপরও এখনো সব কিছু একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। এখনো বর্ষা এলে এই করচ গাছগুলো এক টুকরা জলাবন হয়ে ওঠে। বৈশাখের সময় থেকে কাউয়াদীঘি হাওরে পানি বাড়তে থাকে, তখন হাওর ভরা অবাধ জলের থই থই। তখন করচের গাছগুলো পানির তলায় ডুবতে থাকে।

পানি যত বেশি, তাদের শরীরও ততই ডুবে। অনেকেই দুদণ্ড শান্তির সন্ধানে ওই জলাবনের কাছে কখনো দুপুর, কখনো বিকালের সময়টিকে পার করতে ছুটে আসেন মানুষ। কিশোরগঞ্জের মিঠামইন হাওর, সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরের বিস্তীর্ণ জলরাশি বর্ষায় মানুষকে কাছে টানে। অন্যদিকে, স্থানীয়দের ভাষ্য, এবার এই আষাঢ়েও কাউয়াদীঘি হাওরে খুব বেশি পানি হয়নি। 

অন্য বছর এই সময়ে যতটা পানি হতো, এবার তার চেয়ে অনেক কম পানি হয়েছে। কিছু কিছু করচ গাছের গোড়া অনেকটা শুকনা মাটিতে ভেসে আছে। অন্য বছর এই সময়ে গাছগুলো সারা শরীর ডুবিয়ে থাকে, এবার একটু একটু করে পানি হচ্ছে। তবে নৌকা নিয়ে জলাবনে ভেসে বেড়াতে কোনো সমস্যা নেই। ওখানে জলের সঙ্গে জলের খেলা চলছে। 

‘কালের যাত্রার ধ্বনি’ কেউ শুনছে কি শুনছে না, ওখানে হাওর-জলের ইতিহাস সঙ্গে করে ‘জলাবন’ স্থির হয়ে থাকে। আহ্বান থাকবে আসুন আমরা সম্মিলিতভাবে প্রকৃতিকে, জলকে, জলাধারকে, বন-বনানিকে, নদ-নদী, সাগর-মহাসাগর, পাহাড়-পর্বতকে অক্ষুণœ রেখে, রক্ষা করে জীবন-জীবিকার প্রয়োজন সমূহ মেটাবার চেষ্টা করি। তাহলে প্রকৃতিও বাঁচবে, মানুষও বাঁচকে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট