Image description

বগুড়ায় অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার প্রকল্পটি ঝুলে রয়েছে ১০টি বছর ধরে। এ বিষয়ে তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়- ২০১৫ সালে তদানীন্তন সরকার উত্তরাঞ্চলে নানা ধরনের শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে স্থানীয় অর্থনীতিকে আরো গতিশীল করতে বগুড়ায় বগুড়া অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সেই অনুযায়ী ২০১৬ সালের ২৭ জুলাই বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন (বেজা)-এর গভর্নিং বডির চতুর্থ সভায় বগুড়ায় অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের বিষয়টি অনুমোদন দেয়া হয়। এবং অনুমোদনটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ব্যাপক কার্যক্রমও গ্রহণ করা হয়। 

এ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার কয়েকটি এলাকায় ২৫১ একর জমি অধিগ্রহণ কাজের সূচনাও হয়েছিল। কিন্তু জমির ক্ষতিপূরণের টাকার পরিমাণ নিয়ে জমির মালিকদের অসন্তুষ্টি মামলা পর্যন্ত গড়ালে রায় তাদের পক্ষে গেলেও প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পরবর্তীতে আরো কিছু জটিলতা দেখা দেয়। 

তখন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ-বেজা শাজাহানপুরের জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে বগুড়া-নাটোর সড়কের পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাশে প্রকল্পটির জন্য জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। সেই সিদ্ধান্তটি কার্যকর করার কাজও এখনও দৃশ্যমান নয়। অথচ বগুড়া শহরে যে এত শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠার চাহিদা, তা অনেক জেলা শহরেই নেই। উত্তরের ১৬ জেলা থেকে মানুষ বগুড়ায় আসেন ব্যবসায়িক কাজে। ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারে বগুড়ার গুরুত্ব বেড়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি।

ষাটের দশকে বগুড়া শিল্পনগরী হিসেবে পরিচিতি পেলে জেলায় কটন স্পিনিং মিল, গ্লাস ফ্যাক্টরি, ম্যাচ ফ্যাক্টরি ও সিরামিকসহ বড় ধরনের অনেক কল-কারখানা গড়ে উঠেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৪ সালে শহরের ফুলবাড়ি এলাকায় সাড়ে ১৪ একর জায়গা নিয়ে গড়ে তোলা হয় বিসিকের শিল্পনগরী। ব্যাপক চাহিদার কারণে ১৯৮০ সালেই ওই শিল্পনগরীর আয়তন আরো ১৯ একর বাড়ানো হলেও তার প্লটগুলোও দ্রুত শিল্প-কারখানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। 

এভাবে তিন দশক আগেই শেষ হয়েছে বিসিকের সবগুলো প্লট বরাদ্দ। পত্র-পত্রিকার সূত্র অনুযায়ী এরপর শিল্প উদ্যোক্তারা শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন এলাকায় জায়গা বরাদ্দের দাবি জানাতে থাকলে সব সরকারই সেই দাবির যৌক্তিকতা স্বীকার করলেও বাস্তবে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। একই অবস্থা হয়েছে বগুড়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের ক্ষেত্রেও। 

অথচ বগুড়া যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উর্বর ভূমি, তার প্রমাণ মেলে শিল্প-কারখানার ব্যাপকতাতেই। পত্র-পত্রিকার সূত্র বলছে-বগুড়ায় বিশেষ করে কৃষি যন্ত্রাংশ ও সেচ পাম্পে দেশের মোট চাহিদার ৮০ শতাংশই পূরণ হয় বগুড়ার উৎপাদিত পণ্য দিয়ে। কৃষির এমন কোনো যন্ত্র নেই, যা বগুড়ায় তৈরি হয় না। কৃষি যন্ত্রাংশ, পানি সেচের পাম্প, পাওয়ার টিলার, দ্রুত চাষের ট্রাক্টর, ম্যানুয়েল হারভেস্টর ও কম্বাইন্ড হারভেস্টরসহ আধুনিক কৃষির বড় বাজার হয়ে উঠেছে বগুড়া। এগুলো ঢাকাসহ দেশের প্রায় সর্বত্র সরবরাহ করা হয়ে থাকে।

বর্তমানে ৬০টিরও বেশি ফাউন্ড্রি শিল্পে প্রতিদিন কৃষির বিভিন্ন যন্ত্র ও যন্ত্রাংশের কাঠামো তৈরি হচ্ছে। পত্রিকা সূত্রে এ-ও জানা যায়- কৃষি যন্ত্র ছাড়াও মোটর গাড়ির কিছু যন্ত্র, গার্মেন্ট শিল্পের যন্ত্রাংশ, গভীর, অগভীর ও হাতে চালিত নলকূপ, গ্রান্ডিং মেশিনের যন্ত্রাংশ, রাইস ব্যান অয়েল, পাটের সুতা, জালি টুপি, হস্তশিল্পসহ নানান ধরনের পণ্য বানানো হচ্ছে, যার অনেকগুলো বিদেশেও রপ্তানি হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর সর্বশেষ প্রকাশিত অর্থনৈতিক শুমারি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- স্বাধীনতার আগে বগুড়ায় মাত্র ১ হাজার ৫৪২টি শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল।

২০০০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে জেলায় মাঝারি ও বৃহৎ ধরনের কল-কারখানার সংখ্যা ১ লাখ ২ হাজার ছাড়িয়ে যায়। এই সময়ের মধ্যে জেলায় ব্যক্তি উদ্যোগে অটোরাইস মিল, অটো ব্রিকস, টাইলস কারখানা, ফ্লাওয়ার মিল, অয়েল মিল, পোল্ট্রি খাতের ফিড মিল, স্পেশালাইজড কোল্ড স্টোরেজ, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেটাল ইন্ডাস্ট্রির মতো বড় বড় শিল্প গড়ে উঠেছে, তবে তা অপরিকল্পিত ও বিচ্ছিন্নভাবে। 

জায়গা না পেয়ে উদ্যোক্তারা এখন ফসলি জমি, আবাসিক এলাকায় শিল্প-কারখানা স্থাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে যেমন কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে তেমনি পরিবেশের ওপরও এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ কারণে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার খবরে বগুড়া চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ উদ্যোক্তাদের হতাশার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়- কৃষিজমি ঠিক রেখে এক স্থানে অধিক সেবা থেকে শুরু করে সব ধরনের শিল্প-কারখানা যাতে গড়ে ওঠে সেজন্য বিসিকের দ্বিতীয় শিল্প পার্ক ও অর্থনৈতিক শিল্প অঞ্চল প্রকল্প বাস্তবায়ন করা খুব জরুরি।

বিসিক সূত্রে বলা হয়- প্রস্তাবিত আধুনিক শিল্প পার্ক গড়ে তোলা হলে যেমন প্রায় আড়াইহাজার শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যাবে, তেমনি লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হবে। কিন্তু হতাশার কথা হলো- ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতা ও অন্যান্য কারণে বগুড়া অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কাজটি থমকে আছে। পত্র-পত্রিকা থেকে সর্বশেষ পাওয়া তথ্যে জানা যায়- বাংলাদেশ অর্থনৈতিক জোনের নির্দেশ অনুযায়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, শাজাহানপুরকে আহ্বায়ক করে ৮ সদস্য বিশিষ্ট যে কমিটি গঠন করা হয়, সেই কমিটি সরেজমিনে তদন্ত করে প্রায় ৩০৯ একর জমির প্রস্তাব দিয়ে জেলা প্রশাসকের দপ্তরে প্রতিবেদন দাখিল করে। 

প্রস্তাবিত জমির এরিয়া নকশা প্রস্তুত করে ব্যবস্থাপক (বিনিয়োগ) বাংলাদেশ অর্থনৈতিক জোন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও প্রেরণ করেন। এরপর থেকে বগুড়ায় অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন প্রকল্পটি পরবর্তী সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় এখনও ঝুলে আছে। বিষয়টিকে গুরুত্ব-সহকারে বিবেচনায় নিতে হবে সংশ্লিষ্ট সকলকে।

শিল্প-কারখানার ব্যবসায়ীরা বলছেন- বগুড়ায় একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হলে কারখানা মালিকরা নতুন নতুন কারখানা স্থাপন করতে পারবেন। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তারা আগের থেকে দ্বিগুণ উৎপাদন করতে পারবেন। যত উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে বগুড়ায় আয়ও ততটা বেড়ে যাবে। ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। বেকারত্ব হ্রাস পাবে। 

এজন্য বগুড়া অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করার কাজটি শিল্পের প্রসার, আয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়ার দাবি রাখে। এখন কোনো জনপ্রতিনিধি না থাকায় জেলা প্রশাসন যতটুকু উদ্যোগ নিচ্ছেন ততটুকুই কাজ হচ্ছে। তার একটি বড় দৃষ্টান্ত হলো বগুড়ার মাননীয় জেলা প্রশাসকের উদ্যোগের ফলেই বগুড়া শিগগিরই সিটি কর্পোরেশনে রূপান্তরিত হতে যাওয়া। জেলা প্রশাসন একইভাবে উদ্যোগ নিলে বহুদিন ধরে ঝুলে থাকা বগুড়া অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কাজে নতুন প্রাণ সঞ্চার হবে- এমন প্রত্যাশাই করছেন ব্যবসায়ী মহলসহ উন্নয়ন বঞ্চিত বগুড়াবাসী। 

লেখক: কবি, কথাশিল্পী ও কলামিস্ট