Image description

দেশটা যেনো একটা মগের মুল্লুক। দেশে দুর্নীতির বেড়াজালে আজ ছেয়ে গেছে। যেখানেই যে কাজেই যাই না কেন আমরা, তাতে সবার প্রথম চোখে পড়বে দুর্নীতি। দুর্নীতির পরিমাণ এতোটা বেড়ে গেছে পুরো দেশে যে, দুর্নীতির কথা শুনতে শুনতে সাধারণ মানুষ বিরক্ত। দুর্নীতি বা চাঁদাবাজি না থাকলে দেশ শক্তিশালী অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হতে পারত আরও অনেক আগে। এ বিষয়ে বলারও কোনো সন্দেহ থাকার কথা না। সব সেক্টরে দুর্নীতি যেন সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চেষ্টা করছে এবং অতীতে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হলেও দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। অর্থাৎ দুর্নীতির মামলাগুলো দেখলে মনে হয় জিরো টলারেন্স নীতি সঠিকভাবে কার্যকর হয়নি। ফলে দেশের অর্থনীতি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ, হাজার হাজার কোটি টাকা প্রতারণার মাধ্যমে অন্য দেশে পাচার করা হয়েছে। যা খুবই দুঃখজনক। এসব অর্থ দেশের উন্নয়নের কাজে বিনিয়োগ করা যেত। 

গণমাধ্যম মারফত জানা যায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারি কর্মকর্তারা কানাডার টরন্টোসহ বিভিন্ন দেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছে, যা রাজনীতিবিদদের চেয়েও বেশি। ২০২৪ সালে অনেক বড় বড় আমলা এবং পুলিশের বড় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ প্রকাশ পায়, যা খুবই নিন্দনীয়। আর এই পাচারের পরিমাণটা আরো বিস্তরভাবে প্রকাশ পেয়েছে গত ৫ আগস্টের পরে। অসাধু রাজনীতিবিদ, দুর্নীতিবাজ কিছু সরকারি কর্মকর্তা এবং লোভী ব্যবসায়ীরা বিশ্বব্যাপী নিরাপদ গন্তব্যগুলোতে প্রচুর পরিমাণে অর্থ পাচার করেছে। তারা পরিবারের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে বিদেশে তাদের প্রশ্নবিদ্ধ সম্পদ বিনিয়োগ করে যাচ্ছে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। 

অতীতে এই প্রসঙ্গে ২৮টি মামলা হয়। যার মধ্যে রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা এবং কয়েকজন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ ছিল। এসব মামলার ফল কি? যা সাধারণ জনগণের নিকট প্রকাশ করা উচিত, তাতে সরকারের স্বচ্ছতা বাড়বে। অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি ব্যাংক এবং নন ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই)-এর উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। পি কে হালদার একাই কানাডায় ৩,৫০০ কোটি টাকা পাচার করেছে, যা চারটি এনবিএফআই থেকে ঋণ হিসেবে নিয়েছিল। সেও গোপনে দেশ ত্যাগ করে। বর্তমানে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা দেশে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে। এটাও অনুসন্ধান করা দরকার, বিদেশে কত টাকা পাচার করেছে তারা। এছাড়াও এনবিআরের মতিউর সাহেবের কত টাকা বিদেশে আছে তাও তদন্ত করা দরকার। দেশের অর্থনৈতিক সংকটের মূলে রয়েছে এসব অর্থ পাচার।

গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বর্তমানে প্রতি বছর যে ভয়াবহ আকারে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়েছে, এভাবে চলতে থাকলে ২০৩০ সালে এটি ১৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অর্থ পাচারের এই প্রবণতা বাংলাদেশের উন্নয়নকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাধাগ্রস্ত করবে। 

অর্থনীতি সমিতির তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ এর ছাত্র আন্দোলনের আগেই বাংলাদেশ থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাচার হয়েছে ১১ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা। বাস্তবে আরও বেশি হতে পারে। এরপর তো ২০২৪ এর আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিত বিষয়টি আছেই। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এসব অপরাধ শক্ত হাতে দমন করতে হবে। তা না হলে আর্থিক খাতকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। যার পরিণতি কারও জন্য সুখকর হবে না। এমনকি মহামারি করোনার সময়ও থেমে থাকেনি দুর্নীতি।

বৈশ্বিক এই সংকটে অসাধু ব্যবসায়ীরা মাস্ক ও অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রী নিয়ে যা করেছে, তা অতীতের অনেক দুর্নীতিকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। এছাড়াও ত্রাণ নিয়ে কিছু জনপ্রতিনিধি অনেক অপকর্মের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ ছিল। সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরে নানা রকম অপকর্ম হয়ে থাকে। এসব পেতে অনেক সুস্থ মানুষকে রোগী হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পরবর্তীতে আর্থিক সহায়তা অনুমোদন হলে তারা ১০ বা ১৫ শতাংশ পায়, বাকি টাকা অসাধু ব্যক্তিদের পকেটে যায়। অর্থাৎ প্রকৃত গরিব রোগীরা তাদের আর্থিক সহায়তার টাকা থেকে বঞ্চিত হয়।

বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) নেয়া বিসিএসের ক্যাডার এবং নন-ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রশ্ন ফাঁস করে অনেক কর্মকর্তা রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যায়। প্রশ্ন ফাঁস করে হাজার হাজার কোটি টাকা এসব অসাধু কর্মকর্তারা আয় করেছে। যা অবশ্যই নিন্দনীয়। এসবের কঠোর বিচার হওয়া উচিত। প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির গাড়িচালক আবেদ্য আলীসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এই চক্র ৯ বছর ধরে বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল। শুধু এদেরকে আটক করলে হবে না, এদের মূল হোতাকেও ধরতে হবে। এমন বিচার করতে হবে যাতে কেউ আর এসব প্রশ্ন ফাঁস করে অবৈধ টাকা উপার্জনের কথা চিন্তা না করে।

সম্প্রতি বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) কর্তৃক প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচক ২০২৪-এ বাংলাদেশের স্কোর ২০২৩ এর তুলনায় এক পয়েন্ট কমে ২৩ এবং ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী অবস্থানের দুই ধাপ অবনতি হয়ে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫১তম স্থান পেয়েছে। বাংলাদেশের এবারের স্কোর ২০১২ সাল থেকে ১৩ বছরে সর্বনিম্ন।  এটা কিছুটা হলেও ইতিবাচক। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক এ বিষয়ে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কারণ, দুর্নীতি বা চাঁদাবাজি কিন্তু বন্ধ হয়নি। তাই দুর্নীতিকে আরও কমিয়ে নিয়ে আসা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। দুর্নীতি আমাদের সমাজের জন্য বড় বাধা। যা দেশ বা জাতিকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। যা দেশের উন্নয়নকে বিঘ্নিত করছে।

অতীতে অবৈধ অস্ত্র, মাদক ও বিদেশি মুদ্রা রাখার অভিযোগে মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনিরকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তার করেছে। ভূমিদস্যুতার মাধ্যমে অনেক ব্যক্তি অসংখ্য প্লটের মালিকও হয়েছে। এভাবে সমাজে আরও অনেক গোল্ডেন ব্যক্তি রয়েছে। তাদের খুঁজে বের করতে পারলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে আরও শক্তিশালী হবে। তাই দুর্নীতি ও অর্থ পাচার রোধে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও কঠোর হতে হবে। বিভিন্ন সেবা পেতে নিয়মিত ঘুষ দিতে বাধ্য হয় সাধারণ নাগরিকরা। যেমন-ভূমির দলিল নিবন্ধন সেবায় সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী কোনো জমি কেনার পর তার দলিল নিবন্ধন করতে হয়। কিন্তু সরকারের বাধ্যতামূলক এ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে গিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়তে হয় নিবন্ধনের জন্য আসা মানুষদের। দুর্নীতি দমন কমিশনও অতীতে সরকারি ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসগুলোতে দুর্নীতির নানা উৎস চিহ্নিত করেছে। 

এরপরও অনিয়ম-দুর্নীতির রাশ টানা সম্ভব হয়নি। যাতে লাভবান হচ্ছে ক্রেতা ও সাব-রেজিস্ট্রার। এক্ষেত্রে ক্রেতাকে মোটা অঙ্কের ব্যাংক ড্রাফট দিতে হচ্ছে না। এক কোটি সাশ্রয় হলে সাব-রেজিস্ট্রারকে ৩০ লাখ টাকা ঘুষ দিতেও দলিল গ্রহীতার কোনো ওজর-আপত্তি থাকছে না। এভাবেই রেজিস্ট্রেশন সেক্টরে ভয়াবহ অনিয়ম-দুর্নীতি চলছে। যে কারণে একদিকে যেমন সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে, অপরদিকে এ পেশার ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হচ্ছে। দুর্নীতি আমাদের জীবনে একটি কালো অধ্যায়। তাই দুর্নীতি বন্ধে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল সংক্রান্ত কর্মপরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হওয়া একান্ত প্রয়োজন। 

দুর্নীতি কমাতে ইতিবাচক নানা পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে যেমন- যেসব কর্মকর্তা সততা এবং ন্যায়-নীতি নিয়ে কাজ করবে তাদের আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। নৈতিক সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে পুরস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে। দুর্নীতি প্রতিরোধে জাতীয় ঐক্য দরকার এবং কঠোর কিছু নীতি কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের ভূমিকা রাখতে হবে। 

সব দেশেই দুর্নীতি কম বেশি হয়ে থাকে তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভিন্ন। কারণ, এখানে দুর্নীতির গভীরতা ও ব্যাপকতা এমন পর্যায়ে গেছে, যা কমানোর জন্য শুধু আইন করলে হবে না, দরকার বাস্তব প্রয়োগ এবং বিচার হতে হবে দৃষ্টান্তমূলক। দেশের বিভিন্ন খাতে যে অতুলনীয় অর্থনৈতিক সম্ভাবনা রয়েছে তা দুর্নীতির জন্য আমরা অর্জন করতে পারছি না। তাই দুর্নীতির মূল থেকে বিনষ্ট করতে না পারলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়তে পারে।

আমাদের সকলের উচিত দুর্নীতিকে না বলা এবং দুর্নীতি রোধে ব্যাপকভাবে সোচ্চার হওয়া। তাহলে সোনার বাংলা বিনির্মাণে আমরা ভূমিকা রাখতে পারবো বলে বিশ্বাস করি। দুর্নীতিকে হটাতে পারলেই আমাদের বাংলার সামনের দিকে এগোতে আরও বেশি বোধগম্য হবে আমাদের অর্থনৈতিক বিষয় ও আমাদের নাগরিক জীবনমানের মর্যাদা। কিন্তু আমরা এই দুর্নীতি হটাতেই পিছপা। আজ অবধি দেশ স্বাধীনের পর দুর্নীতি ছাড়া কিছুই করতে পারছি না, কেন পারছি না? কেনই বা আমরা পারব না। এর পেছনে কী আছে সেই বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট