Image description

ধর্ষণ এখন একটি নিত্যদিনের ঘটনা মনে হচ্ছে। প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললেই চোখে পড়ে কোথাও না কোথাও কোনো নারী, কোনো মেয়ে, কোনো শিশু ধর্ষিত হয়েছে। এটা যেন এখন এই সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য এক মহামারী আকার ধারণ করেছে। নারীর মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে তার সতীত্ব। সমাজে যে নারীর সম্ভ্রম হারিয়ে যায়, তাকে মানসিক ও সামাজিকভাবে চরম হেয় প্রতিপন্ন হতে হয়। 

শুধু সম্ভ্রম হারানো নারী বা মেয়েকেই নয়, তার পরিবারের মানুষও সমাজের মধ্যে হীনম্মন্যতায় ভোগে, মানুষের মুখ এড়িয়ে চলে। কিন্তু কোনো এক নরপশুর দ্বারা যে নারী বা মেয়ের সম্ভ্রম হানি হলো, সতীত্ব নষ্ট হলো সেই নরপশুর কি ঠিকঠাক বিচার হচ্ছে? সমাজ ও রাষ্ট্রের আইন কি ঠিকঠাক প্রয়োগ হচ্ছে?  

গত জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসের খবরের কাগজ দেখলে দেখা যায় আটাশটিরও বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। শুধুমাত্র গত বাহাত্তর ঘণ্টায় ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে সতেরোটিরও বেশি। বিগত সালের দিকে তাকালে যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায় তা সত্যি লোমহর্ষক ব্যাপার। “দুই মাসে খুন ধর্ষণের ঘটনা ৭৭৪।” 

তবে গত কয়েক দিনে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে। এর মধ্যে বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণ, এমনকি শহীদ মিনারে ফুল দিতে গিয়ে চতুর্থ শ্রেণির শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এরকম একটা ঘটনা নয়, রেফারেন্সসহ কয়েকটা ঘটনা উল্লেখ করা যাবে। এছাড়াও ধর্ষককে বাঁচানোর প্রবণতাও দেখা যায় কিছু মহলকে। কদিন আগে এক ধর্ষকের পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি সে নাবালক বলে! ধর্ষক আবার নাবালক হয়? 

তাহলে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক ধর্ষককে প্রটেক্ট করা হচ্ছে এখন সে সাবালক নয় বলে তাকে ২/৩ বছর পর ছেড়েও দেয়া হবে? অস্বাভাবিক কিছুই না। চার মাস একটা মেয়েকে আটকে রেখে নির্যাতন করে তাকে মেরেই ফেলল যে শয়তান, সে পার পেয়ে যাবে তথাকথিত সাবালক নাবালক আইনের এখতিয়ারে! আর একটি ঘটনা, এক শিক্ষক তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করেছে। কিন্তু মহামান্য সাংবাদিক মহাশয় ধর্ষকের মুখ ব্লার করে খবর প্রকাশ করেছেন।

এখানে কী মুখ ব্লার করার কারণ? এই শিক্ষক নাবালক নাকি অতি বয়স্ক বলে সম্মানী? আহা কি নৈতিকতা বোধ দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়! এদিকে ধর্ষণ বা যৌন হয়রানি প্রতিরোধ করার বিষয়ে রাষ্ট্রের তেমন কোনো তৎপরতা তো দেখা যাচ্ছে না। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের আখের গোছানোর জন্য সোচ্চার হলেও ধর্ষণের বিরুদ্ধে মুখ খুলছে না। মানববন্ধন বা বিচারের বিষয়ে কথা বলছে না। কোনো কোনো ঘটনায় দেখা যাচ্ছে ধর্ষক কোনো এলিট ক্লাস বা অঢেল সম্পদের মালিক হওয়ার কারণে পার পেয়ে যাচ্ছে।

প্রশ্ন জাগে এসবের প্রতিরোধ করা যায় কীভাবে? কীভাবে আমাদের নারীদের নিরাপদে রাখা যায়? আমি বলব সোজা হাতে ঘি না উঠলে আঙুল বাকাতেই হবে। ধর্ষকের প্রতি কোনো সহানুভূতি দেখানো যাবে না। ধর্ষণ একটি বিশ্বব্যাপী মহামারীতে পরিণত হয়েছে। এর শাস্তি বিভিন্ন দেশের আইন অনুসন্ধান করলে দেখা যায় ভারত, ইরান, চীন, গ্রিস, রাশিয়াসহ এশিয়া-ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। 

তবে যুক্তরাষ্ট্র, নরওয়েসহ উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ৩০ বছর কারাদণ্ড। আর বাংলাদেশে বিদ্যমান আইনে ধর্ষণের ঘটনায় সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর ৯ নম্বর ধারায়ও ধর্ষণের ঘটনায় সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের কথা বলা আছে। 

তবে এ আইনে ধর্ষণের ফলে মৃত্যু হলে সে ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের কথা বলা আছে। ৯ এর (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে, তাহলে সে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে।’ এরপর ৯(২) ধারায় আছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা উক্ত ধর্ষণ-পরবর্তী তাহার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিতা নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যূন এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে।’ 

এ ছাড়া ৯(৩) ধারায় আছে, ‘যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের ফলে উক্ত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন, তাহা হইলে ঐ দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যূন এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে।’ নয় এর (৪) নং ধারা, ‘যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারী বা শিশুকে-(ক) ধর্ষণ করিয়া মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করে, তাহলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে।’

বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৩৭৬ ধারায় বলা হয়েছে, ‘ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।’ এই ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি ধর্ষণের অপরাধ করে, তবে সে ব্যক্তি যাবজীবন কারাদণ্ডে অথবা ১০ বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং তদুপরি অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে, যদি না ধর্ষিতা স্ত্রীলোকটি তার নিজ স্ত্রী হয় এবং সেই স্ত্রী ১২ বছরের কম বয়স্কা না হয়।’ এই আইনগুলো অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় অতি সামান্য।

প্রশ্ন হচ্ছে, এরপরও কি আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ হচ্ছে? এখন পরিস্থিতি ও নারীদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের দাবি, ‘ধর্ষণের একমাত্র শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড। ধর্ষক সাবালক বা নাবালক হোক, শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সব ধর্ষকের শাস্তি হবে এক। বিচার প্রক্রিয়া অতি দ্রুত শেষ করতে হবে, দোষী প্রমাণ হলেই জনসমক্ষে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। যেন ধর্ষিতাকে বছরের পর বছর হয়রানির শিকার হতে না হয়।’ 

এছাড়াও ধর্ষণের বিরুদ্ধে সচেতন সমাজকেই কথা বলতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে। আইনের আওতায় এনে কঠিন শাস্তি প্রদান করতে হবে।বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে এই ভয়াবহ মহামারী ‘ধর্ষণ’ প্রতিরোধ করা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।  এছাড়াও আইন পরিমার্জনের সাথে সাথে দরকার আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন করা।  তবেই  আমাদের সমাজ সুন্দর ও সভ্যভাবে গঠন হবে। 

লেখক: শিক্ষার্থী