মানুষ মানুষের জন্য জীবন জীবনের জন্য একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না? না পেতে পারে না যদি সেই মানুষকে চোর সন্দেহ করা হয়। চোর সন্দেহে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্দয় নির্যাতনের ইতিহাস গড়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় মেধাবী শিক্ষার্থী। ফজলুল হক মুসলিম হলের কয়েকজন ছাত্র গত ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ তারিখে তোফাজ্জল নামের এক যুবককে চোর ভেবে অত্যাচার করতে শুরু করে। অমানুষিক নির্যাতন তোফাজ্জলকে আজীবনের জন্য পরপারের বাসিন্দা করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ওই অত্যাচারের ভিডিও দেখলে মানব হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হবেই।
জানা যায় নিহত তোফাজ্জলের জন্মস্থান বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার কাঠালতলি ইউনিয়নে। দীর্ঘদিন ধরে মানসিক অস্থিরতায় নিমজ্জিত ছিল তোফাজ্জল। আশ্চর্যের বিষয় হলো প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের মেধাবীরা একজন মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষের স্বরূপ নির্ণয়ে ব্যর্থ। আসলেই কি একজন মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষের স্বরূপ নির্ণয়ে ব্যর্থ ঢাবি শিক্ষার্থী পরিচয়ধারী ওই খুনিরা নাকি নিজেরাই মানসিক ভারসাম্যহীন? নাকি নির্যাতিতের আর্তনাদে কেবলই পৈশাচিক আনন্দ প্রাপ্তি? নাকি একজন অসহায় লোককে নির্মম প্রহারের মাধ্যমে নিজেদের শৌর্যবীর্য প্রদর্শনের আকাক্সক্ষা? নাকি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক ব্যর্থতার বার্তা সমগ্র দেশে জানান দেয়া?
প্রাগৈতিহাসিক অনুযায়ী আজ থেকে প্রায় চল্লিশ হাজার বছর আগে পৃথিবীতে বাস করতো মানব প্রজাতি নিয়ান্ডারথাল। পৃথিবী থেকে নিয়ান্ডারথাল মানব প্রজাতি ধ্বংসের জন্য অন্যতম দায়ী হচ্ছে হোমো সেপিয়েন্স অর্থাৎ মানুষ। প্রাথমিক পর্যায়ে নিয়ান্ডারথাল প্রজাতিকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করে মানুষ। অপেক্ষাকৃত উন্নত মস্তিষ্ক ও বুদ্ধির জোরে মানুষ নিয়েন্ডারথাল মানব সম্প্রদায়কে বিলুপ্ত করে দিয়েছিল। সেই হিংস্রতার বীজ এখনো রয়ে গেছে মানুষের মনে। যুগ যুগ ধরে সুযোগ পেলেই নিঃসঙ্কোচে ভিন্নমতাবলম্বী স্ব-প্রজাতি হত্যা করেছে মানুষ। পেশিশক্তি বা অস্ত্রের বাহাদুরি ছাড়াও কৃত্রিম খাদ্য সংকট তৈরি করে পরোক্ষভাবে স্বজাতি হত্যা করেছে মানুষ। সভ্যতার নামে পৃথিবীজুড়ে হত্যালীলা চলছে সেপিয়েন্স আবির্ভাবের পর থেকেই। সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই অপশাসন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সৃষ্ট জনমত দাবিয়ে রাখা হয়েছে। চলেছে আরও নির্বিচারে অত্যাচার, নিধন ও নির্যাতন। অনৈতিক প্রতিযোগিতা মানুষকে করেছে প্রলুব্ধ, করেছে নির্বিকার, করেছে নির্মম। অন্য কোনো প্রাণীর বিরুদ্ধে নয় বরং মানুষ নিধনের জন্যই দুটি বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে।
মানুষ হত্যার জন্য পারমাণবিক বোমা উদ্ভাবন ও প্রয়োগ করা হয়েছে। অন্য কোনো প্রাণী কখনোই সুপরিকল্পিতভাবে মানুষ হত্যার চেষ্টা না করলেও মানুষই মানুষ হত্যার জন্য নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করেছে। মানুষকে লক্ষ্য করে বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। পারমাণবিক অস্ত্রসহ মানুষ মারার সরঞ্জাম দেশে দেশে মজুত কিংবা উৎপন্ন হয়েই চলেছে। মাটির বুক চিরে কৃষিকাজের প্রবৃত্তিই মানব সভ্যতার অগ্রগতির প্রথম সোপান। মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মাটিতে উৎপাদিত শস্যে সবার সমান অধিকার। এই অমোঘ সত্য তাচ্ছিল্য করেছে মানুষ। মানুষের শক্তিশালী দল তুলনামূলক কম শক্তিশালী দলকে বঞ্চিত করেছে। এক-একটা দেশ-মহাদেশের আদি অধিবাসীদের আধুনিক অস্ত্র ও দুর্বুদ্ধিতে পরাস্ত করেছে। জঙ্গলে নির্বাসিত করেছে। নির্বিচারে হত্যা করেছে। দাস বানিয়ে নির্মমভাবে কাজ করিয়ে নিয়েছে। নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করেছে। মাটির ভেতরে জমে থাকা খনিজ পদার্থ ও জ্বালানি তেল সংগ্রহের জন্য এক-একটি আবাসস্থল থেকে তাদের উচ্ছেদ করেছে। ভূখণ্ডে আধিপত্য বিস্তারের নেশায় অন্যের ভূখণ্ড ছিনিয়ে নিয়েছে। মানুষে মানুষে চরম বিরোধিতা সৃষ্টি করেছে। কবির ভাষায় ‘মানুষ হতে মানুষ আসে/ বিরুদ্ধতার ভিড় বাড়ায়/ তুমিও মানুষ আমিও মানুষ/ তফাৎ শুধু শিরদাঁড়ায়”।
একসময় শুধু দেশ দখলের জন্য যুদ্ধ হতো। মহাবীর হিসেবে পরিচিত দিগি¦জয়ী আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট এর অনেক নাম। কিন্তু ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় আলেকজান্ডার একটি করে দেশ যুদ্ধের মাধ্যমে জয় করেছে। মানুষ হত্যা করেছে। সম্পদ লুট করেছে। নিজের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। এই অত্যাধুনিক যুগেও দেশ দখল চলছে। অন্য দেশের খনিজ সম্পদ ও তেল দখলে এনে বাণিজ্য বৃদ্ধির যুদ্ধও ছড়িয়ে গেছে মানচিত্রময়। আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদ দখলের জন্য গত শতকে আমেরিকা ও রাশিয়ার দড়ি টানাটানি চলেছে। দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার তেলের দখল নিতে বিভিন্ন কৌশলে যুদ্ধ চালাচ্ছে পশ্চিমা শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহ। বর্তমানে দেখতে পাচ্ছি রাশিয়া-ইউক্রেন ও ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্রের লক্ষ্যই সাধারণ মানুষ, নারী, শিশু। মোট কথা মানুষই মানুষের বিপদের উৎস। সর্বত্র তথ্যসর্বস্ব জ্ঞান বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু মানব মন বিকশিত হচ্ছে না বরং স্বার্থসর্বস্ব ব্যক্তিত্বই তৈরি হচ্ছে।
মানুষ আজ ক্ষমতাবান ও স্বেচ্ছাচারী। মানুষের শিকার মানুষ। তোফাজ্জলের মতো অতি সাধারণ কোনো মানুষকে নির্দ্বিধায় অবলীলায় হত্যা করেও খুনিরা বিচলিত হয় না। একটুও অনুতপ্ত হয় না। নেই কোনো অনুশোচনা। মানবিক বোধের এই ক্রমবিলুপ্তই কি ভবিতব্য? মানুষের মানবিক সত্তা ক্রমক্ষীয়মাণ। মানবতার যে যৎসামান্য চর্চা হয় তার বিন্দুমাত্রও চর্যা হয় না। সভ্যতার শিক্ষাই হলো মানবতা। সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে মানবতারও উন্নতি হওয়া উচিত। মানবতার উন্নতি হলে মানুষের ভেতরে সহমর্মিতা, সহানুভূতি, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, ভালোবাসা ইত্যাদিরও মানোন্নয়ন হয়। কালের নিয়মে আরও উৎকৃষ্ট, উন্নততর মানবতার দিকে ধাবমান হয়। আবার মূল্যবোধের অবক্ষয় হলে মানবতারও অবক্ষয় হয়। মানব সভ্যতা ও মানবতা অসীম সম্ভাবনাময়। বিপন্ন মানবতার বিচিত্র দৃশ্য প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত একইভাবে বিরাজমান।
মানুষ শিক্ষিত হয়েছে, আধুনিক প্রযুক্তির সাথে তালে তাল মিলিয়ে চলতে শিখেছে কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতির যুগেও মানব মনের সহিংসতা, রক্তপাত, হানাহানি, বিদ্বেষ, প্রতিহিংসাপরায়ণতা দূর হয়নি। শুধু শান্তিতে বেঁচে থাকতে পৃথিবীতে মানুষের উদ্যোগ-উদ্যমের শেষ নেই। কিন্তু সুস্থভাবে বেঁচে থাকার দুর্নিবার আকাক্সক্ষা আজ কেন আতংকে পরিণত হয়েছে? শান্তির বাতাবরণ নষ্ট করে কেন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে অশান্তির দাবানল? ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর বুয়েটের শেরেবাংলা হলে আবরার ফাহাদকে নির্যাতন করে পিটিয়ে হত্যা করেছিল বুয়েট ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী। আবরারের সেই করুণ মৃত্যুতে ভেসে উঠেছিল ছাত্র রাজনীতির পৈশাচিকতা। ২০২৪-এ এসে রাষ্ট্র-ক্ষমতার পালাবদলের পর বস্তুত ক্যাম্পাসে দৃশ্যমান কোনো ছাত্র রাজনীতি নেই। তারপরও একই ঘটনার রক্তাক্ত পুনরাবৃত্তি দেশবাসীকে হতাশ করেছে। তোফাজ্জলের খুনিরা আবারও প্রমাণ করে দিল মানুষের ঘরে জন্ম নিলেই মানব হওয়া যায় না। মানব হওয়ার জন্য মানবিক গুণাবলির চর্চা অপরিহার্য। জীবনে মানবিক গুণাবলি অর্জন করেই মানুষ থেকে মানব হতে হয়। যারা অনেক বেশি মানবিক গুণাবলির অধিকারী তারা ‘মহামানব’ বলে অভিহিত হন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের কয়েকজন শিক্ষার্থী মানুষ নির্যাতনের যে সাইকো ইতিহাস সৃষ্টি করলো তাকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়? তোফাজ্জল কোনো হিংস্র প্রাণী ছিল না। বাংলায় কথা বলা খাঁটি বাঙালি মুসলিম ছেলে তোফাজ্জল। তোফাজ্জলকে নির্যাতনের সময় একটিবারের জন্যও ঘাতকরা মনে করেনি সে মানুষ, সে বাঙালি, সে মুসলিম। যে ছাত্র সমাজের নেতৃত্ব সহজেই গ্রহণ করে নিয়েছে সমগ্র বাংলাদেশ সেই ছাত্র সমাজের একি চিত্র? ছাত্রদের হৃদয়ে এখন না দেখছি মানবতা আর না দেখছি মনুষ্যত্ব।
মানবতা ও মনুষ্যত্ব শব্দদ্বয় ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে জানা যায় নিহত তোফাজ্জল হোসেন চরদুয়ানী গ্রামের মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে। তিনি ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। অল্প সময়ের ব্যবধানে তার মা, বাবা ও বড় ভাই মারা যান। ছেড়ে যায় প্রেমিকাও। সব মিলিয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছে তোফাজ্জল। ক্ষুধার জ্বালা মেটাতেই হয়তো ঢাবি ক্যাম্পাসে গিয়েছিল তোফাজ্জল। টর্চার করে হত্যার আগে তোফাজ্জল হোসেনকে ভাত খেতে দিয়েছিল খুনি শিক্ষার্থীরা। সে বুঝতেই পারেনি এই ভাতই তার জীবনের শেষ খাওয়া। প্রশংসাও করেছিল সেই খাবারের। খাবার খাওয়ানোর পরপরই চলে পুনঃপুন নির্যাতন। এ যেন মানবতার এক মহাপরাজয়। মানবজাতির ইতিহাসই কী তাহলে মানবতা পরাজয়ের ইতিহাস। মানবজাতির পরাজয় কী তাহলে মানবতা-সংহারক বিকৃত চিন্তা-চেতনার মধ্যে নিহিত? প্রশ্ন থেকেই যায় উত্তর জানা নেই।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট
মানবকণ্ঠ/আরএইচটি
Comments