জ্ঞানের আধার মানুষের নাগরিক অধিকার দেয়ার ক্ষেত্রে কম-বেশি হওয়ার চিত্রই বৈষম্যের ধারণা দেয়। একই প্রকৃতি বা সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট জীবের জন্য এটা হওয়ার কথা নয়, এটি বলছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, এটি ঠিক করেছে পৃথিবীর মানুষ আবার এই মানুষকেই, অধিকার বঞ্চিত করে বৈষম্য তৈরি করছে, ব্যক্তি সমাজ ও রাজনীতি এর পেছনে কাজ করেছে।
একই মানুষের কত রূপ? অথচ এটা হওয়ার কথা নয়। একজন মানুষ অপ্রকৃতিস্থ, দেউলিয়া (দায় পরিশোধে অক্ষম/ এবং আদালত কর্তৃক প্রমাণিত) হলেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ভোটাধিকার প্রয়োগ, সাক্ষ্য প্রদান ও জনপ্রতিনিধি হওয়ার ক্ষেত্রে সুবিধা পাবেন না কিন্তু খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা ও চিকিৎসার অধিকার থেকে কেউ তাকে বঞ্চিত করতে পারবেন না। অথচ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে একজন সাধারণ নাগরিক এগুলো থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এবং বিভিন্ন সময়ের শাসক ও রাষ্ট্রযন্ত্রই এই বৈষম্য করেছে।
প্রতিকার চেয়েও অনেকেই তা পাননি, ফলে শুধু সরকারের উপরই নয়, রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি মানুষের ঘৃণা জন্মছে। যদিও নাগরিক বৈষম্য হ্রাস মানুষের সুষম বিকাশে রাষ্ট্রের সংবিধানে অনেক ইতিবাচক বিষয় অন্তর্ভুক্ত আছে। ১৯৩৫ সালের ভারতীয় শাসন আইন ১৯৫৬ সালের পাকিস্তানের শাসন আইন (সংবিধান) ১৯৭২ সালের প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধান বৈষম্য লাঘবের কথা রয়েছে।
সংবিধানে নাগরিকের এই সুবিধার অন্তর্ভুিক্ত এমনি এমনি হয়নি, আন্দোলন, গ্রেফতার, জেল জুলুম হুলিয়া এবং জীবনহানীর ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এটাই যে, কেউই কথা রাখেনি, ফলে স্বাধীনতার পর সকল শাসককেই নাজেহাল হয়েই ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়েছে, এই সকল জনস্বার্থবিরোধী শাসকদের রক্ষা করেছে দেশের আইন প্রণেতারা, শাসন ও বিচার বিভাগের লোকেরা, এরা শাসকের স্বার্থ যতোটা রক্ষা করেছে সে তুলনায় জনগণের স্বার্থ দেখেনি। ধন বৈষম্যের দিক থেকে পাকিস্তান আমলে ২২ পরিবার আর আজ বাংলাদেশে বাইশ পরিবার তৈরি হয়েছে, বর্তমানে আয় বৈষম্য ১: ৮৪।
রাষ্ট্র ও জনগণের টাকা নানানভাবে আত্মসাতের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করে সেকেন্ড হোম তৈরি করা হয়েছে, দ্বি-নাগরিকত্ব আইন লুটেরা রাজনীতিক, অসাধু ব্যবসায়ী, সরকারি-বেসরকারি আমলারা কাজে লাগিয়েছে। এটি বন্ধ করার দায়িত্ব যাদের ছিল তারা সেটা না করে নিজেরাই এসব অপরাধের সাথে যুক্ত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী সরকার সামরিক সরকার এং অন্তর্বতী সরকার, এদের কাজে-কর্মে কম-বেশি স্বৈরাচারী এবং ফ্যাসিবাদী আচরণের প্রতিফলন ঘটেছিল যার বিরূপ ফল ভোগ করেছে সাধারণ মানুষ, যেটা ওই সরকারের পতনের পর মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণ দেখেছেন। সব সময় একই চিত্র দেখা গেছে, এ চক্রে লুটেরা ব্যবসায়ী, সামরিক ও বেসামরিক আমলা, মাস্তান ও মিডিয়ার কিছু মানুষ। দল রাজনীতি ও দেশ পরিচালিত হচ্ছে।
মানি-মাসেল-মিডিয়া এবং ক্রাশ, ক্রাইম, করাপশনকে নির্ভর করে। অস্ত্রধারী বাহিনী রাষ্ট্রের কর্মচারীরা সেখানে সরকারে লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার হোন, পুরস্কার হিসেবে কামিয়ে নেন অঢেল ধন-সম্পদ। বিজ্ঞান নতুন প্রযুক্তি মানুষের দক্ষতাবৃদ্ধি করায় উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে, হয়েছে প্রবৃদ্ধি তবে বণ্টনটা সুষম না হওয়ায় বৈষম্য বেড়েছে।। পুঁজিবাদী/ভোগবাদী বা চুয়ে পড়া অর্থনীতির ছিটেফোঁটা অর্থনৈতিক সুবিধা কারো কারো পকেটে ঢুকেছে। তবে ফকিরের আয় যেমন বিনিয়োগ হয় না, তেমনি প্রবৃদ্ধিনির্ভর উন্নয়নকেও উন্নয়ন বলা যায় না।
ঝরা-খরাসহ নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত সাধারণ মানুষকে ত্রাণ দিয়ে সাময়িক সময়ের জন্য আর্থিক সংকট মোচন করা সম্ভব হলেও মনোজগতের এই আকাল কীভাবে দূর করা যায়? বিষয়টি নিয়ে ভাববার প্রয়োজন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিজয়ের পর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান বা শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করা এবং এখনও এই জঘন্য কাজের বিচার না হওয়ায় মনোজগতের আকালিদের সংখ্যা বৃদ্ধির যে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা, তাতে মুরুব্বিদের সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন হবে, সরকার এ নৈরাজ্যের লাগাম এখই না ধরলে সংকট বাড়তে পারে।
১৯৪২ সালের সর্বজনীন মানবাধিকারের ৩০টি ধারা, পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশের নাগরিকদের সুবিধা আর পুঁজিবাদীদের মধ্যে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের নাগরিক সুবিধার বিষয়গুলো তৃতীয় বিশ্বের স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের মানুষকে আশাবাদী করেছিল। ভারতের সংবিধান যতোটা নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করেছিল সেই তুলনায় পাকিস্তানের সংবিধান করেনি, সাম্প্রদায়িক সংবিধান মানুষের অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়ার পরিবর্তে ধর্মের অজুহাত দেখিয়ে নাগরিকদের মধ্যে বিভাজন ও বৈষম্য তৈরি করেছিল, যার কারণে ৮০ ভাগ মুসলমানের দেশেও ইসলামী সংবিধানকেও অকার্যকর এবং তাদেরকে নির্বাচনে পরাজিত হতে হয়েছিল, কিন্তু পাকিস্তানি স্বৈরাচার ও তাদেরে এদেশীয় দালাল রাজাকার আলবদর, আল-শামস এবং চীন-আমেরিকার স্বাধীনতাবিরোধী চক্রান্তকে ৯ মাসের যুদ্ধে, ৩০ লক্ষ মানুষের জীবনদান এবং ২ লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিল।
পকিস্তান স্বৈরশাসকদের অগণতান্ত্রিক শাসনের প্রতিবাদ করায় পাকিস্তানের কারাগারগুলো বামপন্থি আর জাতীয়তাবাদী কর্মীদের দিয়ে ভরা হয়েছিল। সংবিধানের ১৯(১) ধারায় সুযোগের সমতা, ১৯(২) ধারায় মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ, নাগরিকদের জন্য সম্পদের সুষম বণ্টন করা, ২৯ ধারায় নাগরিকের জন্য সরকারি নিয়োগ লাভে সুযোগের সমতা থাকবে, ৩৯ ধারায় নাগরিকের জন্য চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা, ৪১ ধারায় ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, ৩২(২) ধারায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ২৯(ক) ধারায় নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান প্রণয়ন করা হতে রাষ্ট্রকে নিভৃত করবে না।
৫৩ বছরে বিভিন্ন সময়ে সরকার পরিবর্তন হয়ে নির্বাচিত এবং অনির্বাচিত সরকার এসেছে, ১৬ বার সংবিধান পরিবর্তন করছে কিন্তু উপরোক্ত বিষয়গুলো এখনও সংবিধানে রয়েছে, কিন্তু কেউই সেটা কার্যকর করেনি। এই পরিবর্তন যতোটা না জনস্বার্থে তার চেয়ে বেশি হয়েছে শাসকের স্বার্থে। সংবিধান পালন করা নাগরিকের জন্য যেমন দায়িত্ব তেমনি সরকারেরও দায়িত্ব কিন্তু সরকার সেটা করেনি, তাইতো বার বার ছাত্র-জনতাকে বৈষম্য বিলোপ, নাগরিক অধিকার বাস্তবায়নে আন্দোলন করতে হয় আর তাদের টাকায় কেনা গুলিতে আত্মাহুতি দিতে হয় ছাত্র-জনতাকে।
জনরোষে সরকারের পতন হয়, আসে নতুন সরকার, তাতে নতুনত্ব বেশি থাকে না, অনেকটা নতুন বদলে পুরাতন মদ ঢালার মতো। চলে ধরপাকড়, কেউ যায় জেলে, কেই হুলিয়া মাথায় নিয়ে দেশ-বিদেশে পালিয়ে থাকে, দু-চারজনের হয় ফাঁসি, সাধারণ মানুষ থাকে, আতংকে। কদিন পরে আবার সব আগের মতোই চলে। লুটেরাদের লুটপাট, বিদেশে টাকা পাচার, সরকারি দলের ক্যাডারদের খাল বিল নদী দখল, ছাত্রাবাস আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিন দখল। আদু ভাই ছাত্রনেতাদের ছাত্রত্ব শেষ হয় না, মেধাবী শিক্ষার্থীরা ছাত্রাবাসে সিট না পেলেও ফেল করা আদু ভাই ছাত্রনেতারা বহাল তবিয়তে ছাত্রাবাসে অবস্থান করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দলকানা প্রশাসন তাদেরকে সমীহ করে চলে। আন্দোলনকারীদের দাবি-দাওয়া চাপা পরে যায়। নতুন শাসক আগের শাসকের পথ অনুসরণ করে। সাধারণ জনতা ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলায় পতিত হয়, এ দৃশ্য দেখে অনেকেই বলেন নৌকা লাঙ্গল-পাল্লা শীষ সব সাপের একই বিষ। তাহলে বিকল্প কি এবং কারা? তাদের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক মেনুফেস্টো কি? সেটা দৃশ্যমান না হলে আন্দেলনকারী ছাত্র-জনতা পূর্বের মতো আবারও দিক ভ্রষ্ট হবে, মানুষ জিম্মি হবে রাজনৈতিক ক্যাডার বাহিনীর কাছে, বাড়বে পাতি নেতাদের খবরদারি, মাধ্যমিকের গণ্ডি না পেরোনো পাতি নেতারাই এমএ পাস শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠানে সভাপতি হওয়ার আবদার করবে।
তবে নীতির পরিবর্তন ছাড়া ব্যক্তি বা শাসকের পরিবর্তন দেশের গুণগত পরিবর্তনের নিশ্চয়তা দেয় না, সেইসাথে বৈষম্যমুক্ত সমাজ গড়ার স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে যাবে, যেমনটি অতীতেও ঘটেছে। দেশ ও জাতি গঠনের আরেকটি সুযোগ এসেছে দায়িত্বশীলদের। এ সুযোগ হারানো ঠিক হবে না।
লেখক: অধ্যক্ষ ও কলামিস্ট
Comments