
কাজী নজরুল ইসলাম। এক বিস্ময়কর প্রতিভার কবি। সাহিত্যিক, শিল্পী, গীতিকার, সুরকার, স্বাধীনতা সংগ্রামী। সর্বোপরী একজন পরিপূর্ণ মানুষের নাম। তাঁকে এই কয়েকটি অভিধায় অভিহিত করে সম্পূর্ণ প্রকাশ অসম্ভব। আমি আজ শুধু বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর ভাবনা, অনুভব চিত্রায়িত করার চেষ্টা করব।
আমরা জানি পশ্চিম বাংলার মরুভূমি প্রায় শুষ্ক, নিরস, রাঢ় অঞ্চলে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। শৈশবে পিতৃহারা সহায় সম্বলহীন এক সাহসী আশাবাদী মানুষের নাম কাজী নজরুল ইসলাম। শৈশবের উচ্ছ্বলতা বাদ দিয়ে জীবনের প্রয়োজনে ত্রিশালনিবাসী রফিজুল্লাহ্ দারোগার পশ্চাদ অনুসরণ করে সুজলা সুফলা শষ্য শ্যামলা তৎকালীন পূর্ববঙ্গের সোনার মাটিতে তাঁর প্রথম আগমন।
ষড়ঋতুর দেশে মা, মাটি ও মানুষের সঙ্গে তাঁর সখ্য। বোধ করি তখনই বাংলাদেশের প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা তৈরি হয়। এখানকার মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা, প্রকৃতির প্রতি এক অপার্থিব প্রেম–এ সবকিছুর বীজ বপন হয়ে গিয়েছিল। তারই ফলে যত দিন সুস্থ ছিলেন, শত ব্যস্ততার ভিতরেও বারবার চলে এসেছেন এই সোনার দেশে। যদিও সে সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত দুরূহ ছিল। তাঁর প্রেম, আবেগ প্রবণতা, বিয়ে–সবই হয় এই দেশে। এবার একটু ফিরে যাই পিছনে।
প্রাণোচ্ছল ভাবপ্রবণ নজরুল কোনোদিনই কোনো জায়গায় স্থির থাকতে পারতেন না। চুরুলিয়া থেকে আসানসোল, কলকাতা, অতঃপর বাংলাদেশের চুয়াডাঙ্গা, ফরিদপুর, কুমিল্লা, রাজবাড়ী, ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম-সব যেন তাঁর অতি‑ভালোবাসার জায়গা। যেন তাঁর চিরচেনা, মাতৃভূমির মতো কোমল সুরভিত। এই বাংলাদেশের খাল, বিল, নদী-সব তাঁর চির চেনা। বারবার তাঁর লেখায় উঠে এসেছে এই দেশের, এই উপত্যকার কথা, প্রকৃতিরূপ বর্ণনার কথা। উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি কবিতা, গানের পঙ্ক্তি উল্লেখ করা বোধহয় সমীচীন হবে।
১. একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী।
২. শ্যামলা বরণ বাংলা মায়ের রূপ দেখে যা আয় রে আয়।
৩. নম: নম: নম: বাংলাদেশ মম, চির মনোরম, চির মধুর।
৪. এই আমাদের বাংলাদেশ, এই আমাদের বাংলাদেশ।
উল্লেখিত প্রত্যেকটি গানে আমাদের বাংলাদেশের মানুষ, প্রকৃতির কথা বিবৃত হয়েছে। দুটি লোকগানের কথা উল্লেখ্য–
১. পদ্মার ঢেউরে মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা যারে।
২. মেঘবরণ কন্যা থাকে মেঘলা মতির দেশে।
সব গানই যেন তৎকালীন পূর্ববঙ্গের প্রতিচ্ছবি ও চিত্ররূপ। প্রত্যেক পঙ্ক্তিতেই দেশের মোহময় অবয়ব। ষড়ঋতুর প্রতিটির বর্ণনা ও তার সাথে আপামর মানুষের সংস্কৃতি, সামাজিকতা, ধর্মাচারণ–সব যেন নিপুনরূপে প্রতীয়মান। উদাহরণস্বরূপ: “একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী” গানটি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। এই গানের পরতে পরতে বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের কথা নিপুনভাবে চিত্রিত হয়েছে। একই গানে কী অনিন্দ্যসুন্দরভাবে ছয়টি ঋতু ও তার অনুষঙ্গ কাব্যময় হয়ে উঠেছে।
গ্রীষ্মে আম‑কাঁঠালের মধুর গন্ধ, বর্ষায় কেতকী‑যুঁথিকা যেন ঝর ঝর বৃষ্টির সাথে অবিরাম ধারায় ঝরে। শরতে শাপলা‑শালুক দিয়ে সাজানো প্রকৃতি যেন শিউলি ছোপানো শাড়ি পরে সাজিয়ে তোলে ধরনীকে। অঘ্রাণে আমন ধানের সুঘ্রাণ আমাদের মাতিয়ে তোলে আনন্দে। শীতের শূন্য মাঠে উদাসী বাউলের গান, মাঝিদের ভাটিয়ালি, সেই সাথে কীর্ত্তনের মাতাল করা আয়োজন আমাদের মাতিয়ে তোলে আনন্দে। তারপরই বসন্তে হাজারো রাঙা ফুলে সেজে ওঠে প্রকৃতি।
শিমুল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া, ফুলের সৌরভ আর সৌন্দর্যে ধরনী সেজে ওঠে অনাবিল অপরূপ রূপে। আবার দেখি তিনি তাঁর কাব্য ও গানের শিরোনামগুলোর নামকরণ করার সময় এই দেশ ও প্রকৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। উল্লেখ্য তাঁর বিখ্যাত কিছু কাব্য গ্রন্থের নাম: দোলনচাঁপা, সন্ধ্যামালতি, রাঙাজবা, চন্দ্রবিন্দু, ফনিমণসা, সন্ধ্যা ইত্যাদি। পদ্মার ঢেউরে এই গানে চিরায়ত বাংলার ভাটিয়ালি ও মাঝিমাল্লাদের স্মৃতি বিধূরতা বিমর্ষ করে দেয় বারবার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তাঁর সম্পর্ক জীবন‑মরণের–বোধকরি সবাই তা জানি। ১৯২৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় মুসলিম সাহিত্য সমাজের প্রথম বার্ষিক সম্মেলন। সেখানে নজরুলকে উদ্বোধক হিসেবে আমন্ত্রন জানানো হয়। সেই অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী সংগীত হিসেবে বাংলা একাডেমীর বর্ধমান হাউজে যে গানটি রচনা করেছিলেন, সেটির প্রথম পঙ্ক্তি–“আসিলে কে গো অতিথি উড়ায়ে নিশান সোনালী।” উক্ত অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী সংগীত হিসেবে তিনি নিজে উদাত্ত গলায় গেয়েছিলেন এই গান।
আরেকটি বিশেষ গানের কথা উল্লেখ করব। “আমি পুরব দেশের পূরনারী, গাগরী ভরিয়া এনেছি গো অমৃতবারি।” এই গানের প্রেক্ষাপটটি এতই মজার যে, উল্লেখ না করে পারছি না। একবার নজরুল তাঁর প্রিয় ছাত্রীকে সঙ্গে করে স্টিমারে ঢাকায় আসছেন। সেই যাত্রায় গোয়ালন্দ ঘাটের ঘটনা–
স্টিমার ঘাটে নোঙর করার সাথে সাথে চারপাশে ছোট ছোট নৌকা এসে দাঁড়াতে শুরু করল। কলকতার মেয়ে সুপ্রভা সরকার ডেকে দাঁড়িয়ে অপার বিষ্ময়ে দেখছিলেন সেই দৃশ্য। স্টিমারের পাশে নৌকাগুলি ভিড়ার সাথে সাথে দুঃসাহসী পূর্ববঙ্গের মেয়েরা নৌকাগুলিতে ঝাপ দিয়ে পড়ছিল। একে খরস্রোতা পদ্মা, তায় স্টিমার থেকে ঝাঁপিয়ে ছোট নৌকায় পড়া–সুপ্রভা সরকার ভয়ে জড়সড়ো হয়ে দেখছিলেন সেই দৃশ্য।
কাজী নজরুল ইসলাম একটু দূর থেকে সবকিছু অবলোকন করছিলেন। সুপ্রভা সরকার ভয়ে ভয়ে কবিকে বললেন তাঁর কথা। কবি নজরুল বলেছিলেন, “ওরা পূর্ব বঙ্গের নারী অসীম সাহসী ও শক্তিশালী।” কাজেই ওদের কাছে বিষয়টি খুব সহজ। উল্লেখ্য গানটি ওই স্টিমারেই রচনা করে ঢাকা বেতারে প্রথম বর্ষ উদ্যাপন অনুষ্ঠানে শিল্পী সুপ্রভা সরকারকে দিয়ে গাইয়েছিলেন।
লেখাটি শেষ করতে চাই। কারণ বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর ভাবনা ও লেখা নিয়ে নাতিদীর্ঘ পুস্তক রচনা করা সম্ভব। এখানে সে সুযোগ নেই। তবুও আরও দুয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোকপাত করে শেষ করব।
১৯২৯ সালে ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার আলবার্ট হলে কলকতার বিখ্যাত মনিষীদের উৎসাহ ও উপস্থিতিতে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বাঙালির জাতীয় কবি ঘোষণা করা হয় আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সভাপতিত্বে। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ছিলেন প্রধান অতিথি। আরও উপস্থিত ছিলেন ব্যারিষ্টার এস ওয়াজেদ আলী এবং শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক।
অবিভক্ত ভারতবর্ষের সকল বাঙালির পক্ষ থেকে মহাআড়ম্বরে কাজী নজরুলকে বাঙালির জাতীয় কবি হিসেবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। মাত্র ৩০ (ত্রিশ) বছর বয়সী এক টগবগে যুবককে জাতীয় কবি ঘোষণা পৃথিবীর সাহিত্য ইতিহাসে বিরল। যদিও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭২ সালের ২৪ মে তাঁকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি ঘোষণা করা হয়। অসুস্থ নির্বাক কবিকে ধানমন্ডির ২৮ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে স্ব-পরিবারে রাখা হয় ও জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়ে অতি যত্নে আমৃত্যু রাখা হয়।
তারপর ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট, ১২ ভাদ্র ঢাকা পিজি হাসপাতালে পরলোকগমন করেন এই মহান কবি। তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী মসজিদের পাশেই সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয় তাঁকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশেই শায়িত আছেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলা ভাষা ও ভাষাভাষী মানুষ যতদিন থাকবেন, নজরুল ততদিন বেঁচে থাকবেন তাঁর সাহিত্য ও সংগীতের বৈভবের মধ্যে।
নজরুলের অসাধারণ দক্ষতা, সৌন্দর্যপ্রিয়তা, রসবোধ আমাদের বাংলাদেশের রূপবৈচিত্রকে মোহময় ও বাস্তবভাবে প্রকাশ করে। ধন্য বাংলাদেশ। ধন্য জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
লেখক: নজরুল সংগীত শিল্পী ও শিক্ষক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ইনস্টিটিউট
Comments