
গাজীপুর মহানগরীর পূবাইল থানার হায়দরাবাদের তালগাছিয়ার টেক এলাকায় শিশু বলৎকারের অভিযোগে জনতার হাতে আটক ও গণধোলাইয়ের শিকার আখলাদুল জামে মসজিদের ইমাম রইজ উদ্দিনের (৩২) কারাগারে মৃত্যুর ঘটনায় বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপি)। বুধবার রাতে টঙ্গীতে নিজ কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (অপরাধ দক্ষিণ) এন এম নাসিরুদ্দিন ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ ও উদ্ভূত পরিস্থিতি সাংবাদিকদের জানান।
পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত রোববার (২৭ এপ্রিল) সকাল সাড়ে ১১টার দিকে পূবাইলের হায়দরাবাদ এলাকায় রইজ উদ্দিন এক শিশুকে বলৎকারের চেষ্টা করলে স্থানীয় জনতা তাকে আটক করে মারধর শুরু করে। খবর পেয়ে পূবাইল থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখে প্রায় দুই থেকে তিনশ’ উত্তেজিত জনতা রইজ উদ্দিনকে মারধর করে আটকে রেখেছে। পুলিশ গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে নিজেদের হেফাজতে নেয়।
আহত রইজ উদ্দিনকে দ্রুত চিকিৎসার জন্য টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসা শেষে দুপুর পৌনে দুইটার দিকে তাকে পূবাইল থানায় আনা হয়। এর আগেই, দুপুর সোয়া বারোটায় ভুক্তভোগী ১৪ বছর বয়সী কিশোরের বাবা মাইনুদ্দিন বাদী হয়ে রইজ উদ্দিনের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ এর ৯(১) ধারায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়েরের পর নিয়ম অনুযায়ী রইজ উদ্দিনকে দুপুর আড়াইটার দিকে আদালতে পাঠানো হয়। আদালত শুনানি শেষে তাকে গাজীপুর জেলা কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
উপ-পুলিশ কমিশনার এন এম নাসিরুদ্দিন জানান, কারাগারে থাকা অবস্থায় সোমবার রাত তিনটার দিকে রইজ উদ্দিন অসুস্থ বোধ করলে কারা কর্তৃপক্ষ দ্রুত তাকে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে গাজীপুর জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. শহীদ উল্লাহ ও পুলিশের উপস্থিতিতে লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. এএনএম আল মামুন ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন। এরপর লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও জানান, মামলাটি বর্তমানে তদন্তাধীন রয়েছে। স্থানীয় সাক্ষীদের জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে এবং ঘটনাস্থল থেকে আলামত জব্দ করা হয়েছে। এছাড়াও, এই মামলায় যৌন হয়রানির শিকার আরও পাঁচজন ভিকটিম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ এর ২২ ধারা অনুযায়ী আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
উদ্বেগ প্রকাশ করে উপ-পুলিশ কমিশনার এন এম নাসিরুদ্দিন বলেন, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এবং ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে তদন্ত প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। তারা থানা ঘেরাও, মানববন্ধন, মহাসড়ক অবরোধ, মিছিল, প্রতিবাদ সভা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ও অপপ্রচার চালিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করছে। পুলিশ এই ধরনের কর্মকাণ্ডকে স্বাভাবিক আইনি ও বিচারিক প্রক্রিয়ায় অযাচিত হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছে এবং সকলকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছে।
উল্লেখ্য, গণধোলাইয়ের শিকার ইমামের মৃত্যুকে পরিকল্পিত হত্যা দাবি করেছে তার পরিবার। এ ঘটনায় সোমবার রাতে ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে ওই ইমামের স্ত্রী পূবাইল থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। অন্যদিকে, বুধবার গাজীপুর জেলাপ্রশাসক কার্যালয়ের সামনে ইমামকে নাটকীয়ভাবে হত্যা করা হয়েছে দাবি করে মুফতি গিয়াসউদ্দিন তাহেরীর নেতৃত্বে গাজীপুর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের ব্যানারে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়াও, সারা বাংলাদেশে এই সংগঠনসহ কিছু সংগঠন বিচারের দাবিতে সভা-সমাবেশ অব্যাহত রেখেছে।
Comments