Image description

বসন্তের আগমনী বার্তা নিয়ে আসে যেমন শিমুল, পলাশ, তেমনি প্রকৃতিতে গ্রীষ্মের আগমনের জানান দেয় কৃষ্ণচূড়া। পথের ধারে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে কৃষ্ণচূড়া ফুল ফুটে থোকায় থোকায়। দেখে যেন মনে হয় সবুজের বুকে মিশে আছে লাল। কবির ভাষায়, ‘কৃষ্ণচূড়ার রাঙা মঞ্জুরি কর্ণে, আমি ভুবন ভুলাতে আসি গন্ধে ও বর্ণে’। কৃষ্ণচূড়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য এর অফুরন্ত প্রস্ফুটনের ক্ষমতা। এ কারণেই বোধকরি নিসর্গসখা দ্বিজেন শর্মা এর নাম দিয়েছিলেন ‘পুষ্পপাগল’। শহরকে পুষ্পশোভিত করে তুলতে এই বৃক্ষের ভূমিকা অনন্য।

ঢাকা শহরে কৃষ্ণচূড়ার সবচেয়ে বড় সমাহার জাতীয় সংসদ ভবনের ক্রিসেন্ট লেক সংলগ্ন সড়ক। এছাড়া বিজয় সরণি, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, আগারগাঁওয়ের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের চারপাশ, রমনা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, বেইলি রোড, হাতিরঝিল, কাকরাইল ও বিমানবন্দর সড়কে কৃষ্ণচূড়ার লাবণ্যময় সারির দেখা মেলে। 

কৃষ্ণচূড়ার ফুল উজ্জ্বল লাল ও হলুদ বর্ণের। পাপড়িগুলো প্রায় আট সেন্টিমিটারের মতো লম্বা হতে পারে। কৃষ্ণচূড়ার পাতা সবুজ। প্রতিটি পাতা ৩০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার লম্বা ও ২০ থেকে ৪০টি উপপত্রবিশিষ্ট। এর বৈজ্ঞানিক নাম ডেলোনিক্স রেজিয়া (Delonix Regia), যা ফ্যাবেসি (Fabaccae) পরিবারের অন্তর্গত। ইংরেজিতে এটি পরিচিত ফ্লেম ট্রি (Flame Tree) হিসেবে। 

বৃক্ষসখা দ্বিজেন শর্মা জানাচ্ছেন, আফ্রিকার মাদাগাস্কার  থেকে উনিশ শতকের প্রথম দিকে এই গাছ প্রথমে ইউরোপ, তারপর উপমহাদেশে আসে। সে হিসেবে বাংলা মুলুকে কৃষ্ণচূড়ার আবির্ভাবের বয়স তিন শ বছরের মতো। 

আবার কৃষ্ণচূড়া কখন যেন আমাদের চেতনার অনুষঙ্গেও জড়িয়ে গেছে। কবি শামসুর রাহমান কৃষ্ণচূড়াকে দেখেছিলেন ভাষা শহীদের ‘ঝলকিত রক্তের বুদবুদ’ হিসেবে। লিখেছিলেন সেই অমর পংক্তি- 
‘আবার ফুটেছে দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া থরে থরে শহরের পথে 
কেমন নিবিড় হয়ে। 
কখনও মিছিলে কখনও-বা 
একা হেঁটে যেতে যেতে মনে হয়-ফুল নয়, 
ওরা শহীদের ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ, স্মৃতিগন্ধে ভরপুর। 
একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদের চেতনারই রঙ।’ 

গাছের নিচেও কৃষ্ণচূড়ার আগুনে রঙ শোভা পায়। ঝরা ফুলের এই সৌন্দর্য দেখার আসল সময় ভোরবেলা। কৃষ্ণচূড়ার আরেক নাম গুলমোহর। উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিল্পী ‘মেলোডি কিং’ মোহাম্মদ রফির গানেও এসেছে এই ফুলের কথকতা। রফি গেয়েছিলেন, ‘গুলমোহরের ফুল ঝরে যায়, 
বনে বনে শাখায় শাখায় 
কেন যায় কেন যায় 
বাহারের মন ভেঙে যায়...’। 

ঢাকার পার্কেপথে আগুনঝরা এই ফুল দিয়ে নগরবাসীর আহ্লাদের সীমা নেই।

গ্রীষ্মের এ রুক্ষ প্রকৃতিতে কৃষ্ণচূড়া, সোনালু ফুলের সৌন্দর্যের পাশাপাশি আলাদা করে নজর কাড়ছে জারুল ফুল [Lagerstroemia speciosa]। গ্রীষ্মের ফুলের মধ্যে এ ফুলের প্রতি মানুষের আবেদন অন্যরকম। স্নিগ্ধ ফুলটির রঙে মুগ্ধ হয়ে কবি আহসান হাবীব তার ‘স্বদেশ’ কবিতায় লিখেছিলেন হিজল ফুলেও [Barringtonia acutangula] এখন শোভিত চারপাশ। এই ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণে ভরে গেছে চারদিক। ছোট্ট আকৃতির লাল হিজল ফুল গাছের নিচে ঝরে পড়ে সৌন্দর্য আরও দ্বিগুণ বাড়িয়ে তোলে। 

গ্রীষ্মের আরও একটি উল্লেখযোগ্য ফুল হলো শিরীষ [Albizia lebbeck]। এ ফুলের সৌন্দর্য এদেশের অনেক কবিই নানাভাবে ব্যক্ত করে গেছেন। কবি কালিদাস শিরীষ ফুলের রূপে মুগ্ধ হয়ে ‘চারুকর্ণের অলঙ্কার’ বলে উল্লেখ করেছেন। বৈষ্ণব কবি রাধামোহনের কাছে শিরীষ ফুল হলো কোমলতার প্রতীক। প্রকৃতঅর্থেও তা-ই। প্রখর তাপদাহেও এ ফুল রীতিমতো চোখের জন্য প্রশান্তিই বটে। 

লাল সোনালু [cassia javanica] ফুলেও ছেয়ে গেছে চারপাশ। একটা সময় পর্যন্ত এ ফুলের কোনো নাম ছিলো না। লালচে গোলাপি ও সাদার সংমিশ্রণের এ ফুলের বাংলা নাম দেন অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা। তিনি লাল সোনাইল নামেই ডাকতেন। সোনালু ফুলের মতোই দেখতে। শুধু রঙে ভিন্নতা।

গ্রীষ্মের আরেক ফুল কনকচূড়া [peltophorum pterocarpum] ফুলের নামও দিয়েছেন অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা। এখন পথে বের হলেই চোখে পড়ে কনকচূড়া। উজ্জ্বল সোনারঙের এ ফুলের সৌন্দর্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় ক্লান্ত পথিকের। কনকচূড়া ছাড়াও এ ফুলকে হলুদচূড়া, পিলা গুলমোহর, হলুদ গুলমোহর নামেও ডাকা হয়।

ঢাকায় জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা, হাতিরঝিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রমনা পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেন, কল্যাণপুর, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বা বড় বড় সড়কের আশপাশে কৃষ্ণচূড়ার লাল, সোনালুর মিষ্টি হলুদ আর জারুলের মোহনীয় বেগুনি রঙে চোখ জুড়ান ক্লান্ত পথিক। তাপদাহের এ গ্রীষ্মের এমন আয়োজনই যেন মন ভালো রাখার অন্যতম উপলক্ষ। এমনকি তীব্র রোদ উপেক্ষা করেও কেউ কেউ নিজেদের ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দি করে নেন রঙিন সব ফুলের দৃশ্যপট। এসব ফুল প্রকৃতিপ্রেমীদের চোখে যেন শীতল পরশ বুলিয়ে যায়। 

এমন সৌন্দর্যে যেন হার মানে চারপাশের সব রুক্ষতা। রাধাচূড়া, ভাটফুল, মধুমঞ্জুরি, কাঠগোলাপ, কুরচি, করবীসহ নানা ফুলের চমৎকার রং গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে খানিকটা হলেও স্বস্তি দিয়ে যায়।


মানবকণ্ঠ/এফআই