Image description

লালনগীতি সম্রাজ্ঞী ফরিদা পারভীনের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে শিল্প ও সংস্কৃতি অঙ্গনে। শনিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) রাতে ৭২ বছর বয়সে ঢাকার ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুতে যেন 'আকাশও কাঁদছে'—এমনটাই মন্তব্য করলেন অনেক ভক্ত।

রোববার সকালে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তার মরদেহ আনা হয়। মুষলধারে বৃষ্টি উপেক্ষা করেও সেখানে ভিড় করেন অসংখ্য গুণগ্রাহী ও ভক্ত। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব শুরু হয়। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সরকারি প্রতিষ্ঠান, যেমন- জাতীয় কবিতা পরিষদ, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে তার কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।

ফরিদা পারভীনের অবদান স্মরণ করে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, তিনি কেবল একজন শিল্পী নন, বরং একজন 'সাধক' হিসেবে লালনের গানকে মধ্যবিত্ত বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন। তার গায়কীর মধ্যে এক ধরনের 'মধ্যবিত্ত ভাব' ছিল, যা দিয়ে তিনি মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন। অধ্যাপক আজম আরও বলেন, ফরিদা পারভীন একাই একটি নতুন ঘরানা তৈরি করতে পেরেছিলেন, যা একজন শিল্পীর জন্য অত্যন্ত বিরল।

গবেষক তপন বাগচী মন্তব্য করেন, ফরিদা পারভীন লালনের গানকে আখড়াবাড়ি থেকে বের করে এনে প্রতিটি বাঙালির কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যে, লালনের গানের পাশাপাশি আধুনিক গানের শিল্পী হিসেবেও তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। তার গাওয়া 'তোমরা ভুলেই গেছ মল্লিকাদির নাম' গানটি এক সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তপন বাগচী আরও জানান, ২০০৮ সালে জাপান সরকারের 'ফুকুওয়াকা এশিয়ান কালচার' পুরস্কার প্রদানের সময় বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করা হয়েছিল যে, তার কণ্ঠ বিশ্বের সেরা শিল্পীদের সমপর্যায়ের।

বিএনপির সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক চিত্রনায়ক উজ্জ্বল বলেন, ফরিদা পারভীনের শূন্যতা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। তিনি আশা প্রকাশ করেন, তার মতো গুণী শিল্পী যেন আরও উঠে আসতে পারে, সেজন্য একটি উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন।

চলচ্চিত্র নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন বলেন, ফরিদা পারভীন প্রমাণ করেছেন যে, শিল্পচর্চা আসলে একটি সাধনার বিষয়। তিনি তার কাজ নিয়ে গবেষণার এবং নতুন প্রজন্মের কাছে তার ইতিহাস তুলে ধরার উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান।

শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ফরিদা পারভীনের স্বামী গাজী আবদুল হাকিম সবাইকে ধন্যবাদ জানান। তিনি জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজার পর তার মরদেহ কুষ্টিয়ায় নিয়ে যাওয়া হবে, সেখানেই তাকে দাফন করা হবে।

১৯৫৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বর নাটোরে জন্ম নেওয়া ফরিদা পারভীন রাজশাহীতে বেড়ে ওঠেন। নজরুলগীতি দিয়ে তার সংগীত জীবন শুরু হলেও, পরে তিনি লালনের গানের প্রতি আকৃষ্ট হন। তার মতে, লালনের গানই তাকে সবার মাঝে পরিচিতি এনে দিয়েছে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, 'সত্য বল সুপথে চল' গানটি তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।

লালনের গানকে বিশ্বমঞ্চে পরিচিত করার পাশাপাশি তিনি পেয়েছেন একুশে পদক (১৯৮৭), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩) এবং জাপান সরকারের 'ফুকুওয়াকা এশিয়ান কালচার' পুরস্কার (২০০৮) সহ অসংখ্য সম্মাননা। তিনি ঢাকার তেজকুনি পাড়ায় 'অচিন পাখি সংগীত একাডেমি' প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের কাছে লালন চর্চা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন।