
দিন দিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে অপরাধীরা। দেশে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, খুনখারাপি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে নিত্যনতুন কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে অপরাধীরা। ছিনতাইয়ের ঘটনা থেকে শুরু চাঁদাবাজি, সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ডের মত ঘটনা ঘটছে নির্বিঘ্নে। সংকটের খবর হলো- পুলিশের তালিকাভুক্ত হয়েও রাজধানীতে সক্রিয় ৯৭২ ছিনতাইকারী।
৩০ জুন সন্ধ্যায় রাজধানীর নাজিমউদ্দিন রোডে পুরাতন জেলখানাসংলগ্ন দুই ছিনতাইকারী পেছন থেকে এসে মোরশেদ আলম তানিমকে ধরে ধারালো অস্ত্র দেখিয়ে মানিব্যাগ ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। তানিম বাধা দিলে তার পেটে চাকু মারে ছিনতাইকারীরা। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২ জুলাই ভোরে মারা যান তিনি।
এছাড়া ১৭ জুলাই রাত সোয়া ১২টার দিকে রাজধানীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর নিউ মডেল বহুমুখী হাইস্কুলের বিপরীত পাশে চাপাতি দেখিয়ে ছিনতাই করার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। শুধু পুরান ঢাকা বা ধানমন্ডি নয়, মগবাজার, মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, মিরপুর, উত্তরা, গুলশানসহ ঢাকা নগরীর প্রায় সব স্থানেই প্রতিদিনই ঘটছে ছোট-বড় ছিনতাইয়ের ঘটনা।
পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিটের তালিকায় দেখা গেছে- রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি ছিনতাইকারীর অবস্থান তেজগাঁও ও মিরপুর বিভাগে। এ দুটি বিভাগে ৩৮০ ছিনতাইকারীর নাম উঠে এসেছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। এর মধ্যে ২২৩ ছিনতাইকারীর অবস্থান তেজগাঁও বিভাগে। এছাড়া রমনা ও লালবাগ বিভাগে ২২০, ওয়ারী ও মতিঝিল বিভাগে ২০৫, গুলশান ও উত্তরা বিভাগে ১৬৭ জন ছিনতাইকারী দাপিয়ে বেড়ায়। অন্যদিকে সূত্র বলছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকাকে বলা হয় ছিনতাইয়ের হাব। এ এলাকায় ছিনতাইয়ের লোমহর্ষক অনেক ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সম্প্রতি ভাইরাল হয়েছে।
পুলিশের ছিনতাইকারীর তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তেজগাঁও বিভাগের বিভিন্ন থানায় ২০২২ সালে ২২৩ ছিনতাইকারীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এসব আসামিই ঘুরেফিরে ছিনতাই করে তেজগাঁও ও মোহাম্মদপুর এলাকায়। তবে পুলিশ বলছে, ২০২২ সালের পরও অন্তত শতাধিক ছিনতাইকারী এ এলাকায় আস্তানা গেড়েছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, রাজধানীবাসীর কাছে এখন ছিনতাই এক আতঙ্কের নাম। সন্ধ্যা নামলেই তৎপরতা বাড়ে ছিনতাইকারীদের।
সড়কের ফুটপাতে চলার পথে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধারালো অস্ত্র ঠেকিয়ে নেয়া হচ্ছে সর্বস্ব। এমনকি যানবাহন থামিয়েও প্রকাশ্যে ছিনতাই করা হচ্ছে। ছিনতাইকারীদের চাকু বা খুরের আঘাতে গুরুতর আহত হয়ে প্রাণও দিচ্ছেন অনেকে। আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে- রাজধানীর এসব ছিনতাইকারীর বেশির ভাগই পুলিশের তালিকাভুক্ত।
এমনকি কে কোন এলাকায় থাকে, তার বিস্তারিত তথ্য রয়েছে পুলিশের কাছে। শুধু তাই নয়, এই মুহূর্তে ৯৭২ জন ছিনতাইকারী যে সক্রিয়-সেই তথ্য আছে। এরপরও কেন ছিনতাইকারীদের অবাধ বিচরণ- এমন প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট সবার। মানুষ এসব কারণে স্বস্তিতে নেই। যা খুবই উদ্বেগের। সারাদেশে পুলিশ প্রশাসনের ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।
সরকারের ১ বছর সময় পেরিয়ে গেলেও আইন-শৃঙ্খলায় গতি ফেরেনি। এ অবস্থায় নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে সারাদেশ। এসব বর্বরতা বন্ধ করতে পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে কার্যকর ভূমিকা রাখাতে হবে। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সংস্থা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দেশের সব নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং ছিনতাই ও সহিংসতায় জড়িতদের আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত করাসহ এলাকাভিত্তিক সচেতনতা বাড়াতে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরি হয়ে উঠেছে।
সরকার ও প্রশাসনের উচিত কঠোর হাতে এসব অপরাধীদের দমন করা। ছিনতাই, সহিংসতা ও চাঁদাবাজি যদি বন্ধ না করা যায়, তাহলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে। তাই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোকে আরো কঠোর হতে হবে। কোনো ছিনতাইকারী রাজনৈতিক আশ্রয়ে যেন কোনো অপরাধ না করতে পারে সেই দিকে লক্ষ রাখতে হবে।
সুষ্ঠু বিচারপ্রক্রিয়া, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং অপরাধীদের সামাজিকভাবে বর্জনই হতে পারে এর স্থায়ী সমাধান। আমরা এমন একটি রাষ্ট্র চাই- যেখানে মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে, ব্যবসা করতে পারে, নির্বিঘ্নে রাস্তায় চলতে পারে, মতপ্রকাশ করতে পারে- ভয়ের কোনো বেষ্টনী ছাড়াই। এটি শুধু রাষ্ট্রের নয়- আমাদের সকলের দায়িত্ব।
Comments