Image description

১৯ শতকের শেষ দিকে জন্ম নিয়ে এক মহাকাব্যিক মননের অনন্য এক আত্মিক জাগরণের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। যিনি একাধারে সাহিত্যিক ও সাংবাদিক হিসেবে গভীরভাবে পড়তে পেরেছিলেন সেই বিংশ শতকের মানুষের মন। লাল ফৌজ ব্রিটিশ বেনিয়া আর অখণ্ড ভারতের ভূ-রাজনীতিতে বাঙালির বোধের তখনকার স্পর্শকাতরতা।  দু’শো বছরের গ্লানি টানা বাঙালি তথা পুরো অবিভক্ত ভারতবর্ষের জনমানসের মুক্তির আর্তির আবেদন ছিল তার প্রতিটা লেখনীর পরতে পরতে। কবি তার লেখনিতে সৃষ্টির আনন্দ আর মানুষের বোধে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তোলার কাজের বিরল দায়দায়িত্ব একাকীই পালন করেছিলেন ঝঞ্ঝাবায়ী এত চেতনা।

আজকের মতো সেই তখনো সাম্রাজ্যবাদের নয়া উপনিবেশবাদের তাণ্ডবে দুই দুটি বিশ্বযুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া বৈশ্বিক রাজনীতি ও সমাজ বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে রচনা করেছিলেন তার সৃষ্টির সকল অনন্য সম্ভার। যা মূলত দেশি-বিদেশি শাসককুল ও ক্ষমতাশালীদের বিরাগভাজন করেছিল বটে। তবে সময়ের প্রয়োজনে তখনকার জনগোষ্ঠীর মুক্তিতে আলোক দিশা হয়ে পথ দেখিয়েছেন। আজ শতাব্দীকাল পরে এসে সাম্রাজ্যবাদের নয়া নাটকের সংলাপ ও মঞ্চায়নের মাঠে নতুন কৌশল-ডিপ স্টেট আর অস্ত্র মাদকের মাফিয়াদের আস্ফালনের নয়া ছোবলে যখন দেশ-কাল ভারাক্রান্ত। তখন বিংশ শতকের বিবর ময়দানে সাম্রাজ্যবাদের মোকাবিলায় নজরুলের নয়া পাঠের সেই পুরোনো পাঠের আলোকে নির্দেশনা খোঁজাটাই যৌক্তিক। বিপ্লব ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য কর্ম আমাদের অন্তর্চক্ষুর দ্বার উন্মোচন করে নিশ্চিত পথ দেখাবে। আর এখানেই একজন কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামের যুগান্তকারী উপজীব্যতা।

আজকের বাস্তবতা উপলব্ধির নয়া পাঠ। অতীতের রেখে যাওয়া সৃজনী কর্মের আলোকে আজকের সমাজ বাস্তবতায় সাহিত্যিক সমাজের প্রতিনিধি ও তাদের কর্ম তৎপরতা যেমন বোঝা যায়। অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদের নয়া কৌশলের আজকের করুণ বাস্তবতা ফেস করার দিশাও পাওয়া যাবে নজরুলের সৃষ্টিশীল লেখনী ও সাহিত্য বিচারে। 

বাঙালির জাতিসত্তায় আত্ম-নির্ভরশীলতা, স্বাধীন হওয়ার আকাঙ্ক্ষা, নয়া জোয়ারে বৃহৎ জনমানুষদের জেগে উঠার প্রেরণায় উদ্বেলিত করে। দু’শো বছরের গোলামির আগল ভেঙে মানব মুক্তির পথে একজন কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের এক বিরল প্রতিভা। 
যিনি কবিতা, গানে, ভজনে, শ্যামা সঙ্গীতে, প্রার্থনা-অর্চনায় জনমানুষের একান্ত আপন হয়ে উঠে তা বিরল। তার লেখনীর সাথে বিপুলসংখ্যক জনমানস শুধু সরবে নয় নীরবে নিভৃতে এতটা মূর্ত হয়ে মিশে ছিলেন যে এর আগে তেমনি ঘটেনি বলেই মনে করা হয়। নজরুল এবং তার সাহিত্য কর্ম পুরো বাংলা ও বাঙালি জাতিসত্তার পরিচয়ের স্বরূপ হয়ে উঠে। নজরুলের লেখনীর ক্ষুরধারতা ওই সময়ে চাকায় পুরো মানব মননের আত্মার খোরাক হয়ে জনমানসের বোধে মুক্তির আনন্দে, জাগ্রত হতে উদ্বেলিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা এবং বাস্তবতার বোধের সাথে একাত্ম হওয়ার অপার সুখ দিয়েছে। যা  বিপুলসংখ্যক জনমানসের জন্য এ যেন এক আলাদা অভিপ্রায়ে ভেসে যাওযার অপার সুযোগও বটে। এক তুখোড় প্রতিভা নজরুল ইসলাম শুধু গানে কবিতায় নয় বরং সাংবাদিকতায় ওই বিংশ শতকের অনন্য এক অগ্রদূতও বটে। তিনি সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের নয়া রূপের নগ্ন মূর্তি সেকালের সকল রাজনীতিক, নীতিনির্ধারক, রাজনীতির বোদ্ধা ও মঙ্গলকামী মানুষদের চিন্তাভাবনায় খোরাক দিয়েছে। তার সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক, পাক্ষিক পত্রিকায় ক্ষুরধার লেখনী 

বিশেষ করে সম্পাদকীয় মানুষের বহুল আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে। তার সেসব লেখনিতে টুইস্ট, রম্যতা, শব্দ, কথা ও ছন্দের ভাব ভাষা মানুষদের প্রবল আনন্দ দিয়েছে। একই সাথে মানুষকে সমসাময়িক ইস্যুতে সচেতনতা জ্ঞান প্রজ্ঞার জোগান দিয়ে পথ দেখিয়েছে। ‘নবযুগ, ‘লাঙ্গল’, ‘ধূমকেতু’র জনপ্রিয়তা জনমানুষের ভালোবাসায় উদ্বেলিত হয়েছে বটে তবে শাসন-শোসকের রক্তচক্ষুর বিষ বাষ্পে নজরুলের জীবন হয়েছে হুলিয়াময়। শেষ পর্যন্ত কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠের অবর্ণনীয় দুঃখ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে বিশ্বে রাষ্ট্রের ফোর্থ স্টেট ‘সংবাদ পত্রে’ দমন-পীড়নের নজির সেই বিংশ শতকের বিশ-ত্রিশের দশকেই স্থাপিত হয়েছে। তার লেখনী ধারায় সমসাময়িক কালের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, শাসককুলের নির্মমতা সবই নির্মমতার নজির করে রেখেছে। আর একজন কবি-সাহিত্যিক ও সাংবাদিকের মেরুদণ্ড কতটা জোরালো দেশপ্রেম আর মানব কল্যাণের সেই অনন্য নজির আজও বিরল। হালের বিভাজনের রাজনীতিতে দেশে দেশে বহির্বিশ্বের নানান রাষ্ট্র ও ডিপস্টেটের কুশীলবরা কতটা সরব তা সাম্রাজ্যবাদের নয়া ছোবল।

তাদের তরফে অন্ধকারের শক্তিধরদের কালো ছায়া রাষ্ট্র সমাজ এবং জনমানুষের জীবন-স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করছে বটে! তবে সেই অপশক্তির স্বরূপ উন্মোচন করে সাধারণ মানুষদের আলোকিত করার কোনো প্রতিনিধি নেই। আজকে এদেশের সমাজ বাস্তবতায় ‘কালচারাল জেনোসাইড’র করাল গ্রাসে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রকাশ ও পথ দেখানোর বোদ্ধা আড়ালেক্স-চাচা আপন প্রাণ বাঁচা নীতিতে। তখন এদেশের জনমানসের মধ্যে দেশপ্রেমের ঝঞ্ঝা আরো একবার উঁচু করে তুলে ধরবেন সেই শক্তির নিশ্চয়তা সাধারণ মানুষের বোধে আরো বিভ্রান্তি বাড়িয়ে তোলে।

আজ শতাব্দীকাল পরে সেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নয়া উত্থান কালের ঘেরাটোপে রাষ্ট্র সমাজ একপ্রকার অবরুদ্ধ। তখন সাধারণ জনমানুষে মননে ধাক্কা দিয়ে তাদের সঠিক বোধে ও চেতনায় ফেরাতে নেই কোনো দিকপাল। যিনি হবেন বিতর্ক সমালোচনার ঊর্ধ্বে থাকা একজন পরীক্ষিত পজিটিভ শক্তির আঁধার। আজ শত বছর পরেও একজন কাজী নজরুল ইসলাম এতটা প্রাসঙ্গিক তা বলে বোঝানোর নয়। একজন সাহসী বিপ্লব ও বিদ্রোহের চেতনাধারী কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক কাজী নজরুল ইসলামের উপস্থিতি আজ পলে পলে উপলব্ধি করছি। সাহসে, সাম্যে, ভালোবাসা ও প্রেম-বিরহে ভক্তিতে সম্মানে কি মানব প্রজাতি কি নারীদের যে মহতী সংবেদনশীলতায় যেভাবে তিনি উচ্চ আসনের মর্যাদায় আসীন করে গেছেন তার মত আর কে কবে করতে পেরেছে! না তার মত করে কেউ অনন্য এক মননের কাণ্ডারির দেখা পায়নি এদেশ জাতি, বাঙলা ও বাঙালি। 

বাঙালি ও বাংলার বিরহ, বিদ্রোহী ও বিপ্লবের কবি কাজী নজরুল ইসলাম আজও, তার সৃষ্টিশীল কর্ম ও ব্যক্তিত্বের গুণে শতাব্দী কাল পরেও পরম প্রাসঙ্গিক। নজরুলের সৃষ্টিশীল লেখনী আমাদের সময়ের বাস্তবতায় পথ দেখাবে এটাই প্রত্যাশা।

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক