
কথায় কথায় আন্দোলন- অনেকটা রাজধানী ঢাকা রীতিমতো দাবির শহরে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতার পালাবদলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে নানা দাবি নিয়ে ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় নেমে যায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, যাদের কারণে যানজটের এ শহরে ভোগান্তির মাত্রা আরও তীব্র হয়। প্রায় প্রতিদিনই মিছিল, সমাবেশ, অবরোধ, ঘেরাও ও আল্টিমেটাম দেয়ার মতো কর্মসূচি দেয়া হচ্ছে।
শুধু রাজপথই নয়, প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়সহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরও এর অন্তর্ভুক্ত। স্বাভাবিকভাবেই এসব কর্মসূচি ঘিরে ব্যস্ততম নগরজুড়ে সৃষ্টি হচ্ছে এক রকম অচলাবস্থা। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে কখনো থেমে থেমে আবার কখনো বিরতিহীনভাবে পালিত হচ্ছে এসব কর্মকাণ্ড। অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানসহ কর্তৃপক্ষের তরফে বিক্ষোভের বদলে আলোচনার টেবিলে আসার পরামর্শ দেয়া হলেও আন্দোলনরতদের মধ্যে কার্যত তা মানতে দেখা যাচ্ছে না।
ইতিপূর্বে বিক্ষোভ থামাতে একাধিকবার দেয়া হয়েছে নিষেধাজ্ঞা; আন্দোলনকারীদের দমাতে রাবার বুলেট, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ, লাঠিচার্জসহ নেয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। কিন্তু আসেনি কোনো ইতিবাচক ফল। এককথায়, এমন হযবরল অবস্থা যেন রাজধানীর ‘স্থায়ী সংস্কৃতি’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতি এমন হয়েছে- আঠারো কোটি মানুষের সবার কোনো না কোনো দাবি আছে। সেই দাবি মেটানোর এখনই সময়।
গত রবিবারও নানা দাবিতে একাধিক পক্ষকে বিক্ষোভ-সমাবেশ করতে দেখা গেছে। দক্ষিণ সিটির মেয়র পদে ইশরাকের শপথের ব্যবস্থা করাতে টানা বিক্ষোভ চলছে। গেজেট প্রকাশের ২২ দিন পেরিয়ে গেলেও মেয়রের চেয়ারে বসা তো দূরে থাক, শপথই গ্রহণ করতে পারেননি ইশরাক। আদালতের রায় ও নির্বাচন কমিশনের গেজেট প্রকাশের পরও কেন শপথ পাঠ করানো হচ্ছে না- এমন প্রশ্নে অভিযোগের আঙুল উঠেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও সেই মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়ার দিকে।
এ নিয়ে ক্ষুব্ধ ইশরাক সমর্থকরা গত ছয় দিন ধরে ব্লকেড কর্মসূচি দিয়ে নগর ভবন অচল করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়- গত রবিবারে চাকরিচ্যুত সেনাসদস্যদের জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান, সাম্য হত্যার বিচারের দাবিতে শাহবাগ থানা ঘেরাও, জাতীয়করণের দাবিতে শিক্ষকদের অবস্থান কর্মসূচি, বেতনের দাবিতে মাউশি ঘেরাও, বিজয়নগরে বকেয়া বেতন ও ঈদ বোনাসের ঘোষণা না দিলে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে দেশ অচলের ঘোষণা, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের কাফনের কাপড় নিয়ে মিছিল এবং হাইকোর্টের মাজার গেটের সামনে বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের।
কর্তৃপক্ষ যেই হোক, দাবি যার কাছেই হোক, কাজ একটাই রাজপথ বন্ধ করে দিতে হবে। এটাই একমাত্র রাস্তা। এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্দোলনের শুরুতে উদাসীনতা না দেখিয়ে সহজেই এসব সমস্যার সমাধান করা যেত। উত্তেজনা প্রশমনে আলোচনার মাধ্যমে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হলে ঢাকা অন্তত দাবির শহরে পরিণত হতো না। সরকারের পক্ষ থেকে বার বার বলা হচ্ছে- ‘সময় সাপেক্ষে সবার দাবি নিয়ে কথা বলা হবে।’ কিন্তু কে শোনেন কার কথা।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে- দাবি আদায়ের মৌসুম এসেছে। এ যেন মামা-বাড়ির আবদার। কবি হেলাল হাফিজ লিখেছিলেন- ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার শ্রেষ্ঠ সময় তার।’ আমাদের অবস্থা হয়েছে যৌবন থাকুক বা না থাকুক, রাস্তায় নামার এখনই সেরা সময়। দাবি আদায়ের আন্দোলনে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে অবরোধ ও বিক্ষোভ কর্মসূচিতে জনদুর্ভোগ বাড়ে। যানজটে নগরবাসীর জীবন অনেকটা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
অন্যদিকে নতুন সরকারের প্রধান কাজ দেশ সংস্কার করা, সেই কাজেও আন্দোলন বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমরা কোথায় নতুন দেশের, নতুন সরকারকে সহযোগিতা করব, তা না করে আরও বাধা দিচ্ছি- যা খুবই দুঃখজনক। দেখা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আন্দোলন যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে, ঠিক তখনই চাপের মুখে নতি স্বীকার করছে সরকার। কথা হচ্ছে- বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের দাবি থাকতেই পারে, তারা তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ে সরকারের কাছে দাবিও করতে পারেন কিন্তু পরিবর্তিত রাষ্ট্রে এভাবে আন্দোলন কোনোভাবেই কাম্য নয়।
আমরা মনে করি- যেসব দাবি আদায়ের লক্ষ্যে অথবা যেসব প্রতিবাদ হিসাবে বিক্ষোভ-অবরোধের মতো কর্মসূচি পালন করা হয়, সেসব দাবির যৌক্তিকতা বুঝে কর্তৃপক্ষের প্রথম ধাপেই আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছানো উচিত। একইসঙ্গে যারা বিক্ষোভ করছেন, তাদের প্রতিবাদ যুক্তিসংগত হলেও এমন কোনো কর্মসূচি দেয়া উচিত নয়, যা সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের কারণ ঘটায়। আমাদের মনে রাখতে হবে- এ দেশ আমার, আমাদের।
আমাদের কারণে দেশের ক্ষতি হলে সে দায়ও আমাদের নিতে হবে। তাই দাবি আদায়ের জন্য ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা জরুরি। কথায় কথায় আন্দোলনের নামে রাস্তা অবরোধ এবং নতুন সরকারকে সহযোগিতা না করা অযৌক্তিক- এ অবস্থা কোনোমতেই কাক্সিক্ষত নয়। আমরা মনে করি আলোচনার মধ্য দিয়ে যেকোনো সংকটের সমাধান করা সম্ভব। আমরাও চাই এ সমস্যার দ্রুত একটি সমাধান আসুক। তবে সময়ক্ষেপণ না করে- এ ব্যাপারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এসব বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।
Comments