Image description

মানুষ সামাজিক জীব। আদিকাল থেকেই মানুষ সংঘবদ্ধভাবে সমাজে বসবাস করতে পছন্দ করে। কিন্তু আমরা কি আদৌ সামাজিক? একুশ শতকে দাঁড়িয়ে বর্তমান সমাজের পটভূমিতে সমগ্র জাতির সম্মুখে এটি অনেক বড় প্রশ্ন। প্রতিনিয়ত সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এ প্রশ্নকে করেছে আরো জোরালো। 

সামাজিক মূল্যবোধ হলো এমন একটি ধারণা যা সমাজের রীতিনীতি ও ভালো-মন্দ নির্ধারণের মাধ্যমে মানুষের আচার-আচরণ ও কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর এই মূল্যবোধের যখন অবক্ষয় ঘটে তখন সৃষ্টি হয় নানান সামাজিক অসঙ্গতি ও নৈরাজ্যের। আর এর ভয়াবহতা কতটা করুণ ও মারাত্মক হতে পারে তা বর্তমান সমাজব্যবস্থার প্রেক্ষিতে সহজেই অনুমেয়। 

বর্তমান বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় যতগুলো সমস্যা রয়েছে তার মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় সবার শীর্ষে। সততা, ধৈর্য্য, কর্তব্যনিষ্ঠা, শিষ্টাচার, দেশপ্রেম এবং পারস্পরিক মমত্ত্ববোধ ও কল্যাণবোধের বিপরীতে হিংসা-বিদ্বেষ, ক্রোধ, লোভ, দুর্নীতি ও পারস্পরিক দ্বন্দ্ব সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জেঁকে বসেছে। সামাজিক মূল্যবোধ ও নৈতিক অবক্ষয় যে, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জেঁকে বসেছে, একটি সভ্য ও শান্তিপূর্ণ সমাজব্যবস্থা সেখানে কেবল বইয়ের পাতায় লেখা রূপকথার গল্পের মতো। আর এসব নেতিবাচকতার প্রধান শিকার আমাদের যুব সমাজ। 

আঠারো ও উনিশ শতকের হতদরিদ্র সনাতন সমাজব্যবস্থার নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা ও সামাজিক মূল্যবোধ আজকের আধুনিক সমাজব্যবস্থায় প্রায় বিরল। বর্তমান যুগের হিংসা, অহংকার, বর্বরতা, এবং বিকৃত চিন্তাভাবনা ও বিকৃত রুচির মহামারিতে ভুগছে বর্তমান স্বাধীন সার্বভৌম স্মার্ট বাংলাদেশের সমাজের প্রতিটি স্তর। 

বর্তমানে সমাজের মানবিক বৈশিষ্ট্যও যেন মুখ থুবড়ে পড়েছে। অনেক সমাজ সংস্কারকদের দেখা যায় সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে অন্যকে তুলোধোনা করছেন। নিজেরা নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে সাধারণকে আশ্বাস দিচ্ছেন। একটি সমাজব্যবস্থার যখন, শিক্ষা, মানবিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা, অশ্লীলতা, যৌন নির্যাতন ও হয়রানি, পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শন, মেধার অবমূল্যায়ন, অনিয়ম, দুর্নীতি, খাদ্যে ভেজাল, ফাইলের নিচে বিনিময় ইত্যাদি সব কিছুতেই পিছিয়ে পড়ে তখন সে  সমাজব্যবস্থা কিসের ওপর ভর করে উঠে দাঁড়াবে? সামাজিক এই সমস্যাগুলোর কারণে জাতিগতভাবে আমরা সব কিছুতেই পিছিয়ে পড়ছি। 

প্রতিনিয়ত দেশের কোনায় কোনায় ঘটে চলেছে গুম, খুন, হত্যা, ধর্ষণ, রাহাজানি ও বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ। এইতো গত (২৯ এপ্রিল) কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার গলিয়ারা উত্তর গ্রামের প্রবাসী জাকির হোসেন (কালন) মিয়ার একমাত্র মেয়ে তানজিম সুলতানা ঝুমুর (৯) তার স্কুল থেকে বাড়ি  ফিরছিলেন এমতাবস্থায় মফিজুল ইসলাম প্রকাশ মফু (৩৮) নামক এক নরপিশাচ তাকে রাস্তার পাশের ধান জমিতে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। একপর্যায়ে ঝুমুর চিৎকার করার চেষ্টা করলে মফু তার মুখ ও গলা চেপে ধরে। এতে সে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়। এ ঘটনায় জড়িত মফিজুল ইসলাম প্রকাশ মফু (৩৮) নামক এক নরপিশাচ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব। 

ঘটনাটি এতটাই লোমহর্ষক যে, নারায়ণগঞ্জ র‍্যাব-১১ এর অধিনায়ক তানভীর মাহমুদ পাশা সংবাদ সম্মেলনে এ ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। গণমাধ্যম এসব খবর প্রকাশ হয়েছে। বর্তমান এমন এক সমাজে আমরা বসবাস করছি যেখানে একটি শিশুও নরপিশাচ সমাজের বহুরূপী মানুষ থেকে নিরাপদে নেই।

স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে, স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে, ভাই কর্তৃক ভাইকে,বাবা-মা কর্তৃক সন্তানকে, সন্তান কর্তৃক বাবা-মাকে, বন্ধু কর্তৃক বন্ধুকে খুন এখন সমগ্র দেশে একটি নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। উদাহরণস্বরূপ-  গত (২৬ এপ্রিল) চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলায় পাইকপাড়া ইউনিয়নে বিয়ে না দেওয়ায় রানু বেগম (৫৭) নামে এক নারীকে জবাই করে হত্যা করেছে তার নিজের ছেলে রাসেল খান (২৭)। এর আগে (২০) এপ্রিল নওগাঁ জেলার বদলগাছীতে স্বামী মো. ইমরান হোসেন (২২) তার স্ত্রী আনজুম নূরে আরশিকে (১৮) শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে। 

এছাড়াও গত (১৬ এপ্রিল) ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় মাত্র পঞ্চাশ হাজার টাকার জন্য জন্য জামাই হৃদয় মিয়াকে (২৫) শ্বশুর-শাশুড়ি-স্ত্রী মিলে হত্যা করে। এছাড়াও গত (৩ এপ্রিল) গাজীপুরের কালীগঞ্জে রশিদ বাগমারা নামক এক বৃদ্ধ তার নিজের ছেলে কাউসার বাগমারা (২৩) এর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে  ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে কুড়াল দিয়ে হত্যা করেন। 

এর আগে গত বছরেরর ১৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের ইপিজেড এলাকায় সম্পত্তি ভাগাভাগির জের ধরে নিজ পিতাকে হত্যা করে ছোট ছেলে জাহাঙ্গীর। আর ঘটনা কেবল এখানেই শেষ হয়নি। খুনি জাহাঙ্গীর পিতার মৃতদেহকে খণ্ড বিখণ্ড করে খণ্ডিত অংশগুলো বিভিন্ন স্থানে ফেলে দেয় যাতে কেউ মৃতদেহ শনাক্ত করতে না পারে। এ যেন জাহিলিয়াতের যুগের নিষ্ঠুরতার এক নিদর্শন।

কিন্তু কেন এই বর্বরতা? কেন এতো অবক্ষয়? কেন খবরের কাগজ খুললেই চোখে ভাসে গুম, খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, রাহাজানি, এবং নারী ও শিশু নির্যাতনের মতো ভয়াবহ ঘটনাগুলো? এক কথায় বলতে গেলে এ সবকিছুর মূলে রয়েছে পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অভাব, আকাশ সংস্কৃতির প্রসার এবং পশ্চিমা সংস্কৃতির ভয়াল থাবা। সেই সাথে মাদকাসক্তি, পর্নো আসক্তি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর নেতিবাচক ব্যবহার ও রাজনীতিতে তরুণদের অক্লান্ত লেজুড়বৃত্তি হলো তরুণ সমাজের নেতিবাচক পরিবর্তন ও ছন্দপতনের আরো কিছু কারণ।

শুধু তাই নয়। বেকারত্ব ও হতাশা বর্তমান তরুণ ও যুবসমাজের অবক্ষয়ের আরো দুটি মূল কারণ। সঠিক কর্মসংস্থানের অভাব, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, শিক্ষক ও অভিভাবকদের আদর্শহীনতা এবং বিত্তবানদের অনৈতিকতা সমাজের প্রতিটি স্তরে যেমন বৈষম্য সৃষ্টি করেছে তেমনি কল্পনাতীত হারে বৃদ্ধি পেয়েছে বেকারত্বের হার। এর ফলশ্রুতিতে তরুণ ও যুবসমাজের একটি বৃহৎ অংশ মাদকাসক্তি, চাঁদাবাজি, চুরি-ছিনতাই-ডাকাতি, অপহরণ ইত্যাদি অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে।  

উল্লেখিত সমস্যাসমূহের ইতিবাচক পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি। কেননা এই ভয়ানক বর্বরতা ও নৈতিক অবক্ষয়ের ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি অন্ধকার ও কলঙ্কিত সমাজ অপেক্ষা করছে। আর দিন শেষে আমরা দাঁড়াব কাঠগড়ায়, আমরাই হবো প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু কিভাবে আসবে পরিবর্তন? এই পরিবর্তন শুরু করতে হবে পরিবার থেকে, দায়িত্ব নিতে হবে পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে। ছোটবেলা থেকেই সন্তানকে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষায় দীক্ষিত করতে হবে। বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করার পাশাপাশি সকল নৈতিক গুণাবলি অর্জনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। মনে রাখতে হবে বিশ্বের কোনো ধর্মই মানুষকে অসভ্য ও বর্বর হতে শেখায় না। তাই ধর্মীয় শিক্ষার বিকল্প কিছু হতে পারে না।

পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে হতে হবে আরও যুগোপযোগী এবং প্রায়োগিক। শিক্ষা ও নৈতিক শিক্ষার সমন্বয়ে তৈরি করতে হবে জাতীয় শিক্ষাক্রম। এর পাশাপাশি  সামাজিক  নিয়ম-কানুন, মূল্যবোধ ও পারস্পরিক দায়বদ্ধতা সম্পর্কে সবাইকে সচেতন হতে হবে। মনে রাখতে হবে, কেবল পেশিশক্তি বা অর্থশক্তি নয়, বরং পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও সম্প্রীতি মানুষকে প্রকৃত শক্তিশালী করে তুলতে পারে। 

বেকারত্বের করালগ্রাস থেকে তরুণ সমাজকে রক্ষা করার মাধ্যমে অনেক সামাজিক সমস্যা দূর করা সম্ভব। অন্যান্য নানা ধরনের রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলা রোধ করতে সরকারকে হতে হবে বদ্ধপরিকর ও একনিষ্ঠ। বিভিন্ন ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করাও এখন সময়ের দাবি। 

আমরা আশা রাখতেই পারি, অভিভাবক, শিক্ষক ও প্রশাসন সর্বোপরি সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ সামাজিক মূল্যবোধ ও নৈতিক অবক্ষয় রোধে যদি যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তাহলে আমাদের যুব সমাজ  হয়ে উঠবে ন্যায়-নীতি, শান্তি-শৃঙ্খলা ও আদর্শের এক মূর্ত প্রতীক। চলুন তাহলে আমাদের এবারের অগ্রযাত্রা হোক একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণের।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।


মানবকণ্ঠ/এফআই