Image description

দারিদ্র্য, অসহায়ত্ব আর ভবিষ্যতের নিষ্ঠুর অনিশ্চয়তার জালে আটকে পড়া বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের গ্রামগুলোতে গড়ে উঠেছে এক ভয়াবহ মানব পাচারের বাজার। বাইগুনি বা বিনাইয়ের মতো গ্রামে দালালদের মিষ্টি প্রতিশ্রুতির ফাঁদে পড়ে অনেকে নিজের কিডনি বিক্রি করছেন, কিন্তু পাচ্ছেন না প্রতিশ্রুত টাকা বা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা। অস্ত্রোপচারের পর দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক যন্ত্রণা আর আর্থিক প্রতারণার শিকার হচ্ছেন তারা। ভারতের হাসপাতাল, দালালচক্র এবং প্রশাসনিক দুর্বলতার ফাঁক গলে এই অমানবিক ব্যবসা ফুলে-ফেঁপে উঠছে, যার চরম মূল্য দিচ্ছেন দরিদ্র বাংলাদেশীরা।

গাইবান্ধার কালাই উপজেলার বাইগুনি গ্রামে থাকেন ৪৫ বছরের সফিরুদ্দিন। অসমাপ্ত ইটের ঘরের বাইরে বসে তিনি কেবল শরীরের ব্যথাই নয়, বয়ে বেড়াচ্ছেন ভাঙা স্বপ্নের ভারও। এক বছর আগে ভারতে গিয়ে কিডনি বিক্রি করেন সাড়ে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে। ভেবেছিলেন, টাকাটা দিয়ে সন্তানদের জন্য একটি পাকা ঘর তোলা যাবে। কিন্তু টাকা শেষ, ঘর অসমাপ্ত, আর শরীরের ক্লান্তি প্রতিদিন মনে করিয়ে দেয় সেই ভুল সিদ্ধান্তের কথা।

ভারতে যাওয়ার পুরো প্রক্রিয়া পরিচালনা করে দালালরা। ভিসা, ফ্লাইট, কাগজপত্র, এমনকি হাসপাতালের কাগজে পরিবারের সদস্য হিসেবে সাজিয়ে দিয়েছিল তারাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কার শরীরে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হলো, তা জানার অধিকারটুকুও পাননি সফিরুদ্দিন।

বাইগুনি গ্রামকে এখন অনেকেই ‘এক কিডনির গ্রাম’ বলেই চেনে। প্রায় ৬ হাজার জনসংখ্যার এই এলাকায় বহু মানুষই অন্তত একটি কিডনি বিক্রি করেছেন। ২০২৩ সালে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল গ্লোবাল হেলথে প্রকাশিত গবেষণা বলছে, কালাই উপজেলার প্রতি ৩৫ জন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে প্রতি একজন কিডনি বিক্রি করেছেন। বেশিরভাগই ৩০ বছরের কাছাকাছি পুরুষ, যাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল দারিদ্র্য। কেউ ঋণ শোধ করতে, কেউ আবার মাদকে আসক্ত হয়ে কেউ বা জুয়ার ক্ষতিপূরণ দিতে এই পথ বেছে নিয়েছেন।

বিনাই গ্রামের জোসনা বেগমের গল্পও সফিরুদ্দিনের মতোই বিষণ্ন। স্বামীর মৃত্যুর পর দুই মেয়েকে মানুষ করতে ঢাকায় পোশাক কারখানায় কাজ শুরু করেছিলেন। পরে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। ২০১৯ সালে তিনি স্বামীসহ কিডনি বিক্রি করেন ভারতে। কথা ছিল বিনিময়ে পাবেন সাত লাখ টাকা, কিন্তু হাতে আসে মাত্র তিন লাখ। এরপর স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যান।

নিজের ছোট গরুর গোয়ালের বাইরে বসে আছেন জোসনা বেগম। ভালো ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি থাকলেও এখন দিন কাটাচ্ছেন ওষুধের সঙ্গে। কিন্তু তারপরেও ক্যামেরায় ধরা দিয়েছেন হাসিমুখে। ছবি: আমিনুল ইসলাম মিঠু/আল জাজিরা

প্রতিশ্রুতি ছিল ভালো ভবিষ্যতের। কিন্তু এখন জোসনা দিন কাটান ওষুধের সঙ্গে লড়াই করে। ভারতে অস্ত্রোপচারের পর তার পাসপোর্ট আর ফেরত পাননি। এমনকি প্রেসক্রিপশনও দালালরা নিয়ে নিয়েছে।

মোহাম্মদ সাজল (ছদ্মনাম) এক সময় ঢাকায় ই-কমার্স ব্যবসা করতেন। ব্যবসার পতনের পর দেনায় ডুবে গিয়ে তিনি কিডনি বিক্রি করেন ভারতের একটি হাসপাতালে। কথা ছিল ১০ লাখ টাকার, কিন্তু হাতে পেয়েছেন সাড়ে তিন লাখ। হতাশায় পরে নিজেই জড়িয়ে পড়েন দালালচক্রে! সে সময়ে বাংলাদেশী দাতাদের ভারতে পাঠিয়ে প্রতিস্থাপন করাতেন। পরে চক্রের সঙ্গে বিরোধ হলে নিজেই আতঙ্কে ব্যবসা ছেড়ে দেন। এখন রাইডশেয়ার চালক হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু অতীতের দাগ তো আর মুছে ফেলা যায় না।

ভারতে প্রতি বছর প্রায় দুই লাখ রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপনের দরকার হয়। কিন্তু প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয় মাত্র ১৩ হাজারের মতো। আইনি জটিলতা আর অপেক্ষার সময় এড়িয়ে অনেকেই বেআইনি পথে হাঁটেন। কিডনির জন্য ২০-২৫ হাজার ডলার দিতে রাজি থাকেন অনেক ধনী রোগী, কিন্তু দাতারা পান তার সামান্য অংশ মাত্র। বাকি টাকা দালাল, জাল কাগজ প্রস্তুতকারী ও হাসপাতালের সংশ্লিষ্টদের পকেটেই যায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনি বিভিন্ন ফাঁক ব্যবহার করে দাতাদের আত্মীয় সাজিয়ে দালালরা অনুমোদন জোগাড় করে ফেলে। অনেক হাসপাতাল কাগজ দেখে অনুমোদন দিয়ে দেয়। দালালদের দাবি, কিছু চিকিৎসকও ঘুষের বিনিময়ে সহযোগিতা করেন।

বাংলাদেশে কনস্যুলার দপ্তরের এক কর্মকর্তা দাবি করেন, তারা আইনি প্রক্রিয়া যথাযথভাবে অনুসরণ করেন। কিন্তু বাস্তবে অনেকেই বলছেন, সরকারি নজরদারির ঘাটতি ও দুই দেশের সমন্বয়ের অভাবে পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না।

ভারতের চিকিৎসা পর্যটন খাতের আকার এখন ৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। এ কারণেই হাসপাতালগুলো প্রায়ই আইনি জটিলতা এড়িয়ে কিডনি প্রতিস্থাপনে আগ্রহী থাকে।

কালাইয়ের গ্রামে ফিরলে দেখা যায়, সফিউদ্দিনের মতো আরো অনেকেই কিডনি বিক্রি করেছেন। দালালের আশ্বাস, কিছু টাকার প্রাপ্তি আর স্বপ্নের লোভে তারা শরীরের একটি অংশ ছিঁড়ে দিয়েছেন। বিনিময়ে পেয়েছেন অসুস্থতা, শূন্যতা আর প্রতারণা।

এই দুষ্টুচক্র শুধু একটি গ্রামের গল্প নয়, এটি দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে গড়ে ওঠা একটি নিষ্ঠুর বাণিজ্যের নাম। সফিরুদ্দিনের কণ্ঠে শেষ কথাটি ছিল— ‘তারা শুধু আমার কিডনি নেয়নি, আমার ভবিষ্যৎও নিয়ে গেছে।’