
সহস্রাধিক শহীদ ছাত্র জনতার রক্ত স্রোতে বিগত ১৭ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান হলেও গত দশ মাসে বাংলাদেশে সহিংসতা ও চাঁদাবাজির কারণে জনজীবন অস্থির হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক কোন্দল, ক্ষমতা দখলের লড়াই এবং চাঁদাবাজির সংঘর্ষে একের পর এক প্রাণহানি ঘটছে।
অপরাধ গবেষণা কেন্দ্র (সিআরসি) ও জাতীয় মানবাধিকার সংস্থার (এনএইচআরসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত সারাদেশে ১৫২টি খুনের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ঘটনা রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়েছে।
পরিসংখ্যানের ভয়াবহ চিত্র: দেশের সামপ্রতিক অপরাধ প্রবণতার পরিসংখ্যান উদ্বেগজনক। গত ১০ মাসে মোট ১৫২টি খুন রেকর্ড করা হয়েছে, যার প্রধান কারণ হিসেবে রাজনীতি, দখলদারিত্ব ও চাঁদাবাজিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই সময়ে আনুমানিক ২,১০০টিরও বেশি চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটেছে, যার ৩৫ শতাংশ সরকারি ও রাজনৈতিক আশ্রয়ে সংঘটিত হয়েছে।
গত বুধবার (১০ জুলাই) রাজধানীর মিটফোর্ড এলাকায় চাঁদাবাজির কারণে একটি নৃশংস খুনের ঘটনা ঘটেছে। হাসপাতালের ৩ নম্বর গেটের সামনে ভাঙারি পণ্যের ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ (৩৯) কে নৃশংসভাবে পিটিয়ে ও পাথর মেরে হত্যা করা হয়। সিসিটিভি ফুটেজ, মামলার এজাহার, নিহত লাল চাঁদের স্বজন ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং তদন্ত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিবরণ অনুযায়ী, হত্যার আগে লাল চাঁদকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে এবং ইট-পাথরের টুকরা দিয়ে আঘাত করে মাথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশ থেঁতলে দেয়া হয়। একপর্যায়ে তাঁকে বিবস্ত্র করা হয় এবং তাঁর শরীরের ওপর উঠে কেউ কেউ লাফায়।
বিগত দশ মাসে চাঁদাবাজির কারণে ৪৩টি খুন হয়েছে, যার বেশিরভাগই ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের মতো শহরকেন্দ্রিক। এছাড়া রাজনৈতিক কোন্দলে ৩৬টি খুনের ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ছাত্র ও যুব সংগঠনের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৬টি খুনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠলেও অধিকাংশ ঘটনারই বিচার শুরু হয়নি।
চাঁদাবাজির ধরন ও বিস্তার: নগর জীবনের প্রতিটি স্তরে চাঁদাবাজির বিস্তার লক্ষণীয়। নির্মাণ খাতে ঠিকাদারদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করা হয়, যার বেশিরভাগই স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের পকেটে যায়। পরিবহন ও গার্মেন্টস খাতে ট্রাক-বাসচালক, শ্রমিক ও মালিকদের কাছ থেকে দৈনিক চাঁদা আদায় করা হয়। বন্দর ও কাঁচাবাজারে মাসিক চাঁদার হার নির্ধারিত, যার ওপর নির্ভরশীল কিছু যুব সংগঠন। ফুটপাত ও হকার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ‘গডফাদার সংস্কৃতি’, যেখানে পুলিশ প্রশাসনের নীরব ভূমিকা লক্ষণীয়।
সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক শওকত মাহমুদ বলেন, চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ মূলত রাজনৈতিক দলসমর্থিত কিছু যুব সংগঠনের হাতে। ক্ষমতার পালাবদল হলেও এদের কাঠামো ও অপারেশনাল সক্ষমতা অপরিবর্তিত থেকে গেছে। তিনি আরও যোগ করেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামে প্রতিদিন গড়ে ৫০ কোটি টাকার বেশি চাঁদা আদায় হচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের ‘কালো কর’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাজনৈতিক মদদ ও প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা: বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সহিংসতা ও চাঁদাবাজির মূল কারণ রাজনৈতিক মদদ ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি। রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র-যুব সংগঠনগুলো এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে একদিকে চাঁদাবাজির মাধ্যমে অর্থ যোগাড় করছে, অন্যদিকে ক্ষমতার রসদ জোগাচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুব হাসান উল্লেখ করেন, রাজনীতিকে ব্যবসায় পরিণত করা হয়েছে। চাঁদাবাজি এখন দলের তহবিল ও নেতাকর্মীদের জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অপরাধ বিশ্লেষক সেলিনা পারভীন বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলো নিজস্ব বাহিনী ও চাঁদাবাজদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে যাবে, ততদিন এই সহিংসতা কমবে না।
বিচারহীনতা ও রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা: ১৬টি খুনের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ উঠলেও অধিকাংশ ঘটনার এখনও বিচার শুরু হয়নি। মানবাধিকার কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিচারে দীর্ঘসূত্রতা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে বিচারহীনতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এতে অপরাধীরা উত্সাহিত হচ্ছে। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি অপরাধীদের আরও বেপরোয়া করে তুলছে এবং জনমনে আস্থার সংকট তৈরি করছে।
দেশে প্রতিনিয়ত যে চাঁদাবাজি, খুন ও সহিংসতার ঘটনা ঘটছে, তা শুধু আইন-শৃঙ্খলার অবনতি নয়, এটি একটি গভীর রাজনৈতিক ও নৈতিক সংকটের প্রতিচ্ছবি। যতক্ষণ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলসমূহ নিজেদের চাঁদাবাজ বাহিনীর প্রতি নির্লিপ্ত থাকবে এবং প্রশাসন নিরপেক্ষ হয়ে কাজ না করবে, ততদিন এই রক্তাক্ত রাজপথের অধ্যায় থামবে না। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা, বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি।
Comments