
সুনামগঞ্জের ছাতক-দোয়ারাবাজার রুট এখন ভারতীয় গরু-মহিষের নিরাপদ করিডোরে পরিণত হয়েছে। চোরাই পথে আসা ভারতীয় গরু-মহিষকে ঘিরে পশুর হাটগুলোতে চলছে রমরমা রশিদ বাণিজ্য। গরু-মহিষ ভারতীয় হলেও প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে ইজারাকৃত পশুর হাটের রশিদেই পাচ্ছে বৈধতা। যে কারণে এসব পশু আটক করতে ব্যর্থ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আর আটক হলেও রশিদের জোরে আদালত থেকে ছাড়িয়ে নিচ্ছে সিন্ডিকেট চক্র।
ভারতীয় গরু-মহিষকে ঘিরে দুই উপজেলায় বাড়ছে অপরাধ ও চোরাচালানের দৌরাত্ম্য। প্রায় সময় চোরাকারবারিদের হামলায় বিজিবি, পুলিশ ও সাংবাদিকরা আহত হচ্ছেন। এমনকি ভারতীয় বিএসএফের গুলিতে চোরাকারবারিদের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। রশিদের ওপর ভর করে নির্দ্বিধায় দিনে ও রাতে দোয়ারাবাজার থেকে ছাতক হয়ে শতশত ভারতীয় গরু-মহিষ যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এসব গরু-মহিষকে ঘিরে বছরে হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে ভারতে।
কোথা থেকে আসে এত গরু-মহিষ?
অনুসন্ধানে দেখা গেছে—দোয়ারাবাজার উপজেলায় নেই কোনো গরু-মহিষ উৎপাদনের খামার। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কাছেও নেই উৎপাদন সংক্রান্ত কোনো তথ্য। উৎপাদন ব্যবস্থা না থাকলেও বাজারের আশপাশে গড়ে উঠেছে গরু-মহিষ রাখার একাধিক শেড। প্রশাসনের নাকের ডগায় ভারত থেকে অবৈধ পথে আসা গরু-মহিষকে বৈধতা দিচ্ছে হাটের রশিদ।
ফলে সীমান্ত এলাকায় ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে অর্ধডজন পশুর হাট। স্থানীয় সরকারের দেওয়া ইজারার সুবাদেই এগুলো চলছে। উপজেলায় ভোগলা, বাংলাবাজার, লক্ষীপুর, লিয়াকতগঞ্জ, বালিউরা, শ্রীপুর ও নরশিংপুরসহ মোট ৭টি পশুর হাট রয়েছে। এর মধ্যে সীমান্তঘেঁষা বাংলাবাজার, ভোগলাবাজার ও নরশিংপুর পশুর হাট যেন সোনার হরিণ। এসব বাজারের ইজারা মূল্য দেড় থেকে তিন কোটি টাকা।
বাজারে দেশি পশুর তেমন ক্রয়-বিক্রয় না থাকলেও রাতের অন্ধকারে ভারত থেকে আসা গরু-মহিষের রশিদ বিক্রিই তাদের মূল ব্যবসা। ইতিপূর্বে ভোগলাবাজার রশিদ বিক্রির শীর্ষে থাকলেও বর্তমানে সেই স্থান দখল করেছে বাংলাবাজার পশুর হাট। এ বাজারের আশপাশে ভারতীয় গরু-মহিষ রাখার জন্য গড়ে উঠেছে ৮-১০টি শেড। সীমান্ত অতিক্রম করে শেডে প্রবেশ করলেই রশিদের মাধ্যমে তা দেশি পশুতে রূপান্তরিত হয়। সিন্ডিকেটের কয়েকশ সদস্য ক্রেতা-বিক্রেতা সেজেই চালাচ্ছে রশিদ বাণিজ্য।
সিন্ডিকেটের মূল হোতা কারা?
স্থানীয়রা জানান—মহিষ চোরাচালান সিন্ডিকেটের মূল হোতা নরশিংপুর বিনন্দগর এলাকার আব্দুল আজিজ, শ্রীপুরের আহাদ আলী, নরশিংপুর বাজার ইজারাদার আব্দুল মতিন ও বালিউরার সালেহ আহমদ। ভারতীয় গরু-মহিষকে ঘিরে উপজেলাজুড়ে গড়ে উঠেছে বিশাল সিন্ডিকেট।
গরু-মহিষের পাশাপাশি অবাধে দেশে ঢুকছে মাদকসহ বিভিন্ন চোরাচালান পণ্য। মাদক ও অন্যান্য পণ্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় আটক হলেও রশিদ নিয়ে নিরাপদে দেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে গরু-মহিষ। মাঝেমধ্যে সীমান্ত এলাকায় বিজিবি গরু-মহিষ আটক করলেও অভিযোগ আছে—সেগুলো লোক দেখানো মাত্র। প্রতি মাসে একটি বড় চালান বিজিবিকে ধরতে দেওয়ার সুযোগও সিন্ডিকেট তৈরি করে রাখে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সম্প্রতি ৯০টি গরু আটকের পর জিম্মাদাররা তা পরিবর্তনের অভিযোগে মামলা দায়ের করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ওই রাতে প্রায় চার হাজার গরু ভারত থেকে নামানো হলেও মাত্র ৯০টি গরু আটক করা হয়েছে আইওয়াশের জন্য।
এসব গরু-মহিষ ভারত থেকে নামাতে হুন্ডির মাধ্যমে ভারতে অর্থ লেনদেন করে থাকেন ভোগলা এলাকার মন্তাজ আলীর পুত্র সারফুল। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করেন তার শালা পলাশ আহমদ। অভিযোগ আছে—কলাউড়া গ্রামের ফয়েজ নামের এক ব্যক্তি বিজিবির নাম ভাঙিয়ে টাকা তোলেন।
এছাড়া পেকপাড়া গ্রামের মৃত আবুল হান্নানের ছেলে সাবেক ইউপি সদস্য খুরশিদ আলী, কলাউড়ার রিয়াজ উদ্দিনের ছেলে ইমাম ও কাসেম, আনোয়ারসহ অনেকে বড় চোরাকারবারি হিসেবে পরিচিত। দোয়ারার বিভিন্ন গ্রামে অন্তত ৬৭ জন সরাসরি এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। তাদের পেছনে মদদদাতা হিসেবে রয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কয়েকজন নেতা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও রশিদ কৌশল;
অভিযোগ আছে—প্রতি গরু-মহিষে ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা হারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নামে তোলা হয় ‘লাইনম্যান ফি’। আটককৃত মালামাল নিলামে তুললেও সেটি সিন্ডিকেট সদস্যরাই কিনে নেয়। অন্য কেউ কিনলে তাকে দিতে হয় বড় অংকের জরিমানা।
রাতারাতি কোটিপতি;
আনোয়ার ও নতুন আনোয়ার নামে দুই ব্যক্তি কয়েক বছর আগেও চা বিক্রি ও মোটরসাইকেল চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। বর্তমানে তারা অটেল সম্পত্তির মালিক। প্রায় ৫ কোটি টাকা খরচ করে তারা বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করেছেন।
একইভাবে সারফুল নামের এক ব্যবসায়ী ভারতের টাকা পাচার করে মালদ্বীপে ৩ কোটি টাকার হোটেল ও সিলেট শহরে দুটি বাড়ি নির্মাণ করেছেন। এলাকায়ও তার অটেল সম্পত্তি রয়েছে।
এক হিসাবে দেখা যায়—শুধু রশিদ বিক্রি করেই ইজারাদাররা বছরে হাতিয়ে নিচ্ছেন ৩৫-৪০ কোটি টাকা। গত এক মাসের হিসাবে দেখা গেছে—দোয়ারাবাজার থেকে ছাতক হয়ে প্রতি মাসে ৪ থেকে ৫ হাজার গরু-মহিষ যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। বার্ষিক হিসাবে এর বাজারমূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৬-৭ শত কোটি টাকা।
প্রশাসনের বক্তব্য;
দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অরূপ রতন সিং স্বীকার করেছেন—হাটের আশপাশে শেড গড়ে ওঠার বিষয়টি অনুসন্ধানের সঙ্গে মিল রয়েছে। বাজারগুলো সীমান্ত থেকে সদর এলাকায় স্থানান্তরের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন।
সুনামগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার (সার্কেল) মোঃ আব্দুল কাদির জানান, বাজারের রশিদ থাকায় তাদের কিছু করার থাকে না। তবে পুলিশের নামে কেউ টাকা তুললে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিজিবি ৪৮ ও ২৮ ব্যাটালিয়নের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
Comments