শরীয়তপুরে পদ্মার তীরে টাটকা মাছের বাজার, দিনে বিক্রি দেড় কোটি টাকা

শরীয়তপুরের জাজিরার পালেরচর বাজারে ভোর থেকেই জমে ওঠে ভিড়। পদ্মা নদী থেকে সদ্য ওঠা টাটকা মাছ দেখতে ও কিনতে জড়ো হন শত শত মানুষ। কখনো ইলিশের ঝলমলে রূপ, কখনো বিশাল বোয়ালের ঝাপটা, আবার কখনো পাঙাশ-কাতলার সারি—সব মিলিয়ে বাজার যেন জীবন্ত এক মাছের প্রদর্শনী। প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে বেলা ১১টা এবং আবার বিকেল ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দুই দফায় বসা এ বাজারে অন্তত দেড় কোটি টাকার মাছের কেনাবেচা হয়।
শরীয়তপুরকে ঘিরে বয়ে চলেছে তিনটি মহার্ঘ নদী—পদ্মা, মেঘনা ও কীর্তিনাশা। এই নদীগুলো থেকে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য খাল-বিল। জেলার প্রায় ১৫ হাজার জেলে পরিবার তাদের জীবিকা নির্বাহ করে মাছ শিকারের মাধ্যমে। প্রতিদিন নদী ও খাল থেকে গড়ে ২৫-৩০ মেট্রিক টন মাছ ধরা হয়, যার সবচেয়ে বড় অংশ বেচাকেনা হয় পালেরচর বাজারে।
জাজিরার কুন্ডেরচর এলাকার জেলে সাহাদাৎ হোসেন দুই ছেলেকে নিয়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় মাছ ধরতে যান। তিনি বলেন,
“ভোর ৫টার দিকে নদীতে যাই। দুপুরের আগেই নৌকা ভর্তি মাছ নিয়ে বাজারে ফিরি। প্রতিদিন প্রায় ১২-১৫ হাজার টাকার মাছ পাই। নদীতে এখন ভালো মাছ পাওয়া যাচ্ছে, দামও মন্দ না।”
শুরুতে পালেরচর বাজার ছিল স্থানীয় মানুষের ছোট্ট একটি হাট। মূলত নৌপথেই আসা-যাওয়া করতেন সবাই। ২০০০ সালের দিকে সড়ক যোগাযোগ চালু হলে এর বিস্তার বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে জেলেরা এখানে মাছ নিয়ে আসতে শুরু করেন, ক্রেতাও বাড়তে থাকে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী হামিদ শিকদার বলেন, “শুরুর দিকে প্রতিদিন কয়েক মণ মাছও উঠত না। এখন আমি একাই ৪-৫ লাখ টাকার মাছ বিক্রি করি। বাইরের ক্রেতা বাড়ায় বাজারে ভিড় বেড়েছে কয়েকগুণ।”
তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে পদ্মা সেতু চালুর পর। এখন ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, মাদারীপুর থেকে প্রতিদিন পাইকাররা এসে মাছ কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। ফলে পালেরচর বাজার দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় মাছের আড্ডায় পরিণত হয়েছে।
পালেরচর বাজারে যে মাছ সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়, তা হলো পদ্মার ইলিশ। ৬০০-৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজি প্রতি ২০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া—বড় বোয়াল ও কাতলা বিক্রি হয় আড়াই হাজার টাকা কেজি পর্যন্ত। চিংড়ি ও বাইম ১ থেকে ১.৫ হাজার টাকা কেজি দরে। পাঙাশ তুলনামূলক কমদামে মিলছে, তবে চাহিদা বেশি।
মাদারীপুরের শিবচর থেকে আসা ক্রেতা আল আমিন বলেন, “আমার বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য এখানে এসেছি। টাটকা ইলিশ না হলে অতিথি আপ্যায়ন জমে না। পদ্মার ইলিশের স্বাদই আলাদা।”
বাজারে শুধু ব্যবসায়ীরা আসেন না, অনেকেই আসেন ঘুরতে। মাছ কিনে পাশের হোটেলে রান্না করিয়ে খেয়ে ফেলেন টাটকা স্বাদ। ফলে পালেরচর বাজার এখন একপ্রকার ‘ফুড ট্যুরিজম স্পট’ হয়ে উঠেছে।
ঢাকা থেকে ঘুরতে আসা কয়েকজন তরুণ বলেন, “শুধু মাছ কিনতেই আসিনি। আমরা টাটকা মাছ কিনে বাজারের পাশের হোটেলে খেয়েছি। সত্যি দারুণ অভিজ্ঞতা।”
পালেরচর বাজারকে ঘিরে তৈরি হয়েছে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান। শুধু আড়তদার নয়, খুচরা বিক্রেতা, হোটেল ব্যবসায়ী, নৌকার মাঝি, পরিবহন শ্রমিক—সবার জন্য এই বাজার জীবিকার উৎস। প্রতিদিন গড়ে দেড় কোটি টাকার লেনদেন স্থানীয় অর্থনীতিকে করেছে সচল।
আড়তমালিক মোতালেব হাওলাদার বলেন, “পদ্মা সেতুর কারণে বাজার এখন আঞ্চলিক অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। প্রতিদিন লাখো টাকা লেনদেন হয়। সবাই লাভবান হচ্ছেন।”
শরীয়তপুর জেলা মৎস্য কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, তিনটি বড় নদী ও খালের ওপর নির্ভরশীল এ জেলার মাছ উৎপাদন দেশের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
ভারপ্রাপ্ত মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কাশেম বলেন, “পালেরচর বাজারে সারা দিনই টাটকা মাছ কেনাবেচা হয়। এ বাজার শুধু জেলার নয়, দেশের অন্যতম বড় মাছের বাজারে পরিণত হয়েছে। জেলেরা এখানে ন্যায্য দাম পাচ্ছেন, ক্রেতারাও পাচ্ছেন তাজা মাছ।”
পালেরচর বাজারকে কেন্দ্র করে একটি মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এখানে কোল্ড স্টোরেজ ও আধুনিক অবকাঠামো তৈরি হলে শুধু স্থানীয় নয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারেও পদ্মার মাছের সরবরাহ সম্ভব হবে।
পদ্মার বুক থেকে উঠে আসা টাটকা মাছ ঘিরে শরীয়তপুরের পালেরচর বাজার আজ দেড় কোটি টাকার বাণিজ্যের এক বিশাল কেন্দ্র। জেলে, আড়তদার, পাইকার, খুচরা ব্যবসায়ী—সবার জীবনে নতুন আলো জ্বালিয়েছে এই বাজার। পদ্মা সেতু যেমন দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নের দরজা খুলেছে, তেমনি পালেরচর মাছের বাজার হয়ে উঠেছে শরীয়তপুরের অর্থনীতি ও সংস্কৃতির এক অনন্য প্রতীক।
Comments