
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টির কারণে কুড়িগ্রামে তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, গঙ্গাধার ও ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। ফলে জেলার নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চল প্লাবিত হয়ে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ধানের চারা, সবজিখেত ও মাছের পুকুর পানিতে তলিয়ে গেছে, যোগাযোগ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে এবং নদীভাঙনের আতঙ্কে দিন কাটছে স্থানীয়দের।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় তিস্তা নদীর ডালিয়া পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৭ সেন্টিমিটার ওপরে এবং হাতীবান্ধা উপজেলার তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে ৫২.৩০ মিটার (বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপরে) প্রবাহিত হয়েছে। দুধকুমার নদীর পাটেশ্বরী পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৬ সেন্টিমিটার ওপরে রেকর্ড করা হয়েছে। ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর পানিও বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে, যদিও কুড়িগ্রাম সেতু পয়েন্টে ধরলার পানি ২৫.৪৫ মিটার (বিপৎসীমার ৬০ সেন্টিমিটার নিচে) এবং চিলমারীতে ব্রহ্মপুত্রের পানি ২২.৩৪ মিটার (বিপৎসীমার ৯১ সেন্টিমিটার নিচে) রেকর্ড করা হয়েছে।
প্লাবিত এলাকা ও ক্ষয়ক্ষতি
কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার সরিষাবাড়ী, বুড়িরহাট, মেদনি এবং নাগেশ্বরী উপজেলার রায়গঞ্জ, কেদার, কচাকাটা, বল্লভেরখাস ও নারায়ণপুর ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, গঙ্গাধার ও ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরবর্তী চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলে পানি প্রবেশ করায় ধানের চারা, সবজিখেত ও মাছের পুকুর তলিয়ে গেছে। চরাঞ্চলের সড়ক-পথে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে, এবং বহু পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। নাগেশ্বরী উপজেলার চর বিষ্ণুপুরের বাসিন্দা শামসুল হক জানান, “পুরো চরে পানি ঢুকেছে। রাস্তাঘাট ডুবে গেছে, যাতায়াতে সমস্যা হচ্ছে। আমন ধানের ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে।”
নদীভাঙনের আতঙ্ক
তিস্তা নদীর তীব্র স্রোতে রংপুরের গঙ্গাচড়ার মহিপুরে দ্বিতীয় সড়ক সেতুর সুরক্ষা বাঁধে প্রায় ৭০ ফুট গভীর গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। এতে রংপুর-লালমনিরহাট মহাসড়ক ও হাজারো পরিবার ঝুঁকির মুখে পড়েছে। রাজারহাট উপজেলার নাজিমখাঁন এলাকায় তিস্তার পানি খালের মাধ্যমে উল্টো প্রবাহিত হয়ে ভাঙনের হুমকি তৈরি করেছে। স্থানীয় বাসিন্দা অনুকূল ও সুজন জানান, “তিস্তার পানি খালের ভেতর দিয়ে তীব্র বেগে ঢুকে ভাঙন শুরু করেছে। জিও ব্যাগ না ফেললে আমাদের বাড়িঘর ভেঙে যেতে পারে।”
পূর্বাভাস ও প্রস্তুতি
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিবুল হাসান জানান, উত্তর-পশ্চিম ও পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের কারণে রংপুর, ময়মনসিংহ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম, আসাম, মেঘালয় ও অরুণাচল প্রদেশে ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। আগামী ৫ দিন পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে, যা বন্যা পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করতে পারে। তিনি বলেন, “নাজিমখাঁন এলাকায় ভাঙন রোধে ৫০০ জিও ব্যাগ দেওয়া হয়েছিল, নতুন করে আরও ১,০০০ ব্যাগ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে বরাদ্দ সীমিত হওয়ায় সমস্যা হচ্ছে।”
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আব্দুল মতিন জানান, “সম্ভাব্য বন্যা মোকাবিলায় আমাদের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি রয়েছে। প্রয়োজনীয় খাদ্য ও সহায়তা উপকরণ মজুত আছে।” জেলা প্রশাসন বন্যাপ্রবণ ভূরুঙ্গামারী, নাগেশ্বরী, কুড়িগ্রাম সদর, রাজারহাট, চিলমারী ও চর রাজীবপুর উপজেলায় কন্ট্রোল রুম চালু করেছে। পানিবন্দি মানুষের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ চলছে।
কৃষি ও জীবিকার ক্ষতি
কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, “তিস্তা ও দুধকুমারপাড়ের বিপুল পরিমাণ আমন ধান ও সবজিখেত পানিতে তলিয়ে গেছে। ২-৩ দিনের মধ্যে পানি না নামলে সবজির ব্যাপক ক্ষতি হবে।” স্থানীয় কৃষক সিরাজুল ইসলাম বলেন, “ঘরের ভেতর কোমর সমান পানি। গবাদিপশু নিয়ে রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছি। আমার ৬ বিঘা জমির আমন ধান ও ২ বিঘা সবজিখেত পানিতে ডুবে গেছে।”
স্থানীয়দের আতঙ্ক
নাগেশ্বরী উপজেলার চর নারায়ণপুরের কৃষক দেলোয়ার শেখ বলেন, “ভোরে হঠাৎ পানি বেড়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে। একটি ছাগল ও কয়েকটি মুরগি পানিতে ভেসে গেছে। রান্না করতে না পারায় শুকনো খাবার খেয়ে বেঁচে আছি।” স্থানীয়রা জানান, পানিবন্দি মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে সরকারি রাস্তা ও বাঁধের ওপর পলিথিনের ঝুপড়িতে আশ্রয় নিয়েছে।
জেলা প্রশাসক নূসরাত সুলতানা জানান, “বন্যাদুর্গত এলাকায় কন্ট্রোল রুম চালু করা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে এবং শুকনো খাবার বিতরণ অব্যাহত আছে।”
বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্থানীয় প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে, তবে পানি বৃদ্ধি ও ভাঙনের তীব্রতা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে।
Comments