জুলাই আন্দোলন: বিয়ানীবাজারের কারো চোখে ‘ভালো আছে’ দেশ, কারো চোখে ‘নেই’

জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছরের মাথায় বিয়ানীবাজারের সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির যে হিসাব, তাতে আশা-নিরাশা দুই-ই আছে। যোগ-বিয়োগ করে ‘হতাশার’ হিসাব দেওয়া ব্যক্তিদের কেউ কেউ বলছেন, জুলাই আন্দোলনের এক বছরে দেশে গুণগত কোনো পরিবর্তনই আসেনি। ‘আগের চেয়েও খারাপ’ হয়েছে দেশের অর্থনীতি। জানমালের নিরাপত্তা কমেছে। ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন আসেনি রাজনীতিতে।
আর দেশের অবস্থা যারা আগের চেয়ে ভালো দেখছেন, তারা অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানো, মূল্যস্ফীতি কমে যাওয়া, মানুষের নিরাপত্তা কিংবা সরকারি সেবার মান বাড়া, প্রশাসনে দূর্নীতি হ্রাস, গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসার সম্ভাবনার মত যুক্তিকে সামনে আনছেন। তারা বলছেন, এই সময়ে দেশে কোন গুম হয়নি, মানুষ কথা বলার স্বাধীনতা পেয়েছে।
কোটা সংস্কার থেকে সরকার পতনের দাবিতে রূপ নেওয়া জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল মোবাইল ফোনে আর্থিক লেনদেনের ব্যবসা করা কাউসার আহমেদের। অভ্যুত্থানের এক বছর পরে এসে কাউসার মনে করছেন, ওই আন্দোলন ছিল কথা বলার স্বাধীনতা ফিরে পাওয়া। এখন মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে দেদারছে সমালোচনা করতে পারছে। আগে সে সুযোগ ছিলনা। তারমতে, ১১ মাসে একটি গুমের খবর পাওয়া যায়নি।
নতুন অর্ন্তবর্তী সরকারের সময়ে বিয়ানীবাজারে কাংখিত উন্নয়ন হচ্ছেনা। আগেকার উন্নয়ন প্রকল্পগুলো থেমে আছে।
বিয়ানীবাজার সুজন’র সভাপতি এডভোকেট মো. আমান উদ্দিন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, “তারা মানুষের কাছে ঠিকমত পৌছাঁতে পারেনি। জনগণ যেন শান্তিতে থাকে, তোমরা সেরকম কিছু করে দেখাও। পড়ালেখা শেষ না করেই রাজনীতিতে যোগ দিছে; তার মানে লোভে পড়ছে।
“ওরা কীভাবে ক্ষমতায় যাবে, কীভাবে ক্ষমতায় থাকবে, তা নিয়েই কথাবার্তা বলতেছে। এক বছর যে হয়ে গেল, তার মধ্যে জনগণ নিয়ে তো একটা কথাও বলে নাই। সব নাকি তারা করছে ”-বলেন তিনি।
বিয়ানীবাজার উপজেলা বিএনপির প্রচার সম্পাদক ফয়েজ আহমদ বলেন, “ভাষা, আন্দোলন, বিজয় দিবস, আমার সোনার বাংলা— এগুলো যথাস্থানে রেখে ২৪-এর ইতিহাস রচনা করতে হবে।” বিয়ানীবাজার কমি্উনিষ্ট পার্টির সভাপতি এডভোকেট আবুল কাশেম বলেন, দৃশ্যমান সংস্কার হয়নি। মানুষ দ্রুত সংস্কার ও পরবর্তন দেখতে চায়।
যুব জমিয়ত নেতা হাফিজ আব্দুল্লাহ বলেন, আন্দোলনটা ‘যৌক্তিক’ ছিল; তবে পরের সময়গুলো ‘ভালো যাচ্ছে না’। তারমতে, দলীয় সরকার ক্ষমতায় এলে মনে হয় একটা লাইনে আসবে। দেশের মধ্যে শৃঙ্খলা থাকে, এখন তো কেউ কাউকে গোনে না। যে যেমনে পারতেছে চলতেছে, কাউকে কেউ মানে না। এখন সাধারণ মানুষের জন্য কোনো স্বাধীনতা নাই, কোনো অভিভাবক নাই।
জুলাই আন্দোলনে নিহত শহীদ সাংবাদিক আবু তাহের তুরাবের ভাই আবু জাফর জাবুর জানান, আন্দোলনে নিহতদের বিচার নিয়ে সংশয় আছে। দ্রুত এসব বিচার কার্যক্রম শেষ করা উচিত। তার উপলব্ধি হল, আন্দোলনের সময় নতুন বন্দোবস্তের আকাঙ্ক্ষা ছিল, যেখানে জনগণ গণতন্ত্র, প্রশাসনের স্বচ্ছতা, নিরাপত্তা ও মর্যাদা পাবে। সে আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষণ আছে বলে মনে করেন তিনি।
বিয়ানীবাজার উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সরওয়ার হোসেন বললেন, “অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। বিডিআর হত্যাকাণ্ড ও শাপলা হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হইছে, যেখানে অনেকে অন্যায়ের শিকার হইছে। জিনিসপত্রের দাম কমছে, আগে অনেক বেশি দাম ছিল।”
জাতীয় নাগরিক পার্টির কেন্দ্রীয় সংগঠক শাহরিয়ার আলম সানি বলেন, “জুলাই আন্দোলনে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের অভিপ্রায় ছিল। তা কোনো তাৎক্ষণিক ক্ষোভ ছিল না। বহু বছরের রাজনৈতিক দমনপীড়ন, বৈষম্য আর লুটপাটের বিরুদ্ধে গণজাগরণ ছিল। এখন দেশ সঠিক পথেই এগুচ্ছে।
তিনি বলেন, “রাষ্ট্রপুনর্গঠনের যে আলোচনা আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, তা আজও শুরু হয়নি। প্রশাসনিক কাঠামো, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিচারব্যবস্থা কিংবা রাজনৈতিক সংস্কৃতির কোনো স্তরেই কাঠামোগত সংস্কারের ইঙ্গিত আমরা দেখতে পাচ্ছি।
বিয়ানীবাজার পৌর জামায়াতের আমীর কাজী জমির হোসাইন বলেন, গত দেড় দশকে যারা জুলুম-নির্যাতনের সঙ্গে ছিলেন, তাদের বিচার এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কারের গতি আরো বাড়ানো উচিত।
উপজেলা জামায়াতের আমীর ফয়জুল ইসলাম বলেন, “এখন নির্যাতন থেকে মানুষ বাঁচতেছে। আগে কথা বলতে পারতাম না। প্রশাসনের যা ইচ্ছা তাই করতে পারত। এই চাপটা থেকে আমরা ভালো আছি। পূর্ণ অধিকার আছে, মানুষের স্বাধীনতা আছে।
উপজেলা বিএনপির সভাপতি এডভোকেট আহমদ রেজা বলেন, বর্তমানে কোনো উচ্ছৃঙ্খলা নেই, মব হচ্ছে মানুষের ক্ষোভের বহি:প্রকাশ। তবে এটা নিয়ন্ন্ত্রণে সরকার আন্তরিক। জনগণের পাশাপাশি দেশের অবস্থাও ভালো। মব কেউ ইচ্ছা করে করতেছে, আগের হয়ত আক্রোশ ছিল। নরমালি আগের চেয়ে সবকিছুই ভালো আছে।
বেসরকারি চাকরিজীবী মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন মনে করেন, সরকার দেশের সব ধরনের সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করেছে। আর যতটুকু যা হচ্ছে, তা আন্দোলনের ফলেই সম্ভব হয়েছে। আন্দোলন না হলে সরকার এগুলো করতে পারত না। বাজারদর থেকে শুরু করে এয়ারপোর্টের সার্ভিসিং, রাস্তাঘাটের ভিআইপি মুভমেন্ট, অনেককিছুই ফলপ্রসূ হচ্ছে। অনেকগুলো সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে, সেগুলো নিয়ে কাজ হচ্ছে।
ড. ইউনুস সরকারের কার্যক্রমকে বিয়ানীবাজারবাসী কেউ কেউ ‘অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো’ দেখছেন। নিরাপত্তা, জিনিসপত্রের দাম সবই তাদের কাছে ‘স্বাভাবিক’।
Comments